বহু প্রিয়মুখ পেছনে রেখেই বাংলাদেশ প্রবেশ করছে নতুন বছরে।
Published : 31 Dec 2024, 10:01 AM
তাদের কেউ আলো ছড়িয়ে গেছেন জীবনভর, কেউবা নিজ কর্ম-গুণে ছিলেন অনন্য। বেদনার সুর ছড়িয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেও তাদের চিহ্ন চিরঅম্লান, চিরভাস্বর।
শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিক থেকে শুরু করে ২০২৪ সালে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। নতুন বছর শুরুর আগে হারানো সেই মুখগুলো দেখে নেওয়া যাক একপলক।
রবীন্দ্রনাথ সরেন
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন মারা যান ১২ জানুয়ারি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বারোকনা গ্রামে নিজের বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। ৬৬ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সরেন কিডনি ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছাড়াও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামে সহসভাপতি, কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
জাহিদুল হক
ষাটের দশকের কবি, গল্পকার, গীতিকার জাহিদুল হক মারা যান ১৫ জানুয়ারি। সংগীত শিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে তার লেখা 'আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়' গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
জাহিদুল হক বাংলা কবিতায় যুক্ত করেছিলেন নতুন মাত্রা। উচ্চকণ্ঠের বিপরীতে সংবেদী অথচ সবল উচ্চারণ তাকে বাংলা কবিতাভুবনে বিশিষ্ট স্থান দান করেছিল। কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ, গল্পে তিনি ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ।
সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমেদ
ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ সম্পাদক, প্রবীণ সাংবাদিক সৈয়দ কামাল উদ্দিন আহমেদ মারা যান ৫ মার্চ। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
সৈয়দ কামাল উদ্দিনের সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৬১ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকার মাধ্যমে। বিভিন্ন দৈনিকে তিনি কাজ করেছেন। সর্বশেষ ২০০৫ সালে তিনি হলিডে পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।
২০০১ সালে খালেদা জিয়ার শাসনামলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশনে প্রেস মিনিস্টার ছিলেন তিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে কাজ করা এ সাংবাদিক জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।
ইহসানুল করিম
জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক ইহসানুল করিম মারা যান ১০ মার্চ। ৭৩ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব। তার আগে ছিলেন রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করেন ইহসানুল করিম। পরে ভারতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর সদস্য হিসেবে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন।
সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবনে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা ছাড়াও বিবিসি, পিটিআইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন ইহসানুল করিম।
সাদি মহম্মদ
১৩ মার্চ মারা যান দেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ। নিজের ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় তার মরদেহ পাওয়া যায়।
শহীদ সলিম উল্লাহর ছেলে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার। তার ভাই শিবলী মোহাম্মদ দেশের জনপ্রিয় নৃত্যশিল্পী।
২০০৭ সালে 'আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে' অ্যালবামের মাধ্যমে তিনি সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি। ২০০৯ সালে তার 'শ্রাবণ আকাশে' ও ২০১২ সালে তার 'সার্থক জনম আমার' অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি তাকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেয়।
গোলাম আরিফ টিপু
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু মারা যান ১৫ মার্চ। ৯৩ বছর বয়সী এই আইনজীবী দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা টিপু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের রাজশাহী অঞ্চলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে ২০১৯ সালে একুশে পদক দেওয়া হয়।
গোলাম আরিফ টিপু ১৯৫৮ সালে আইনজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একাধিকবার রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন।
খালিদ
চাইম ব্যান্ডের শিল্পী খালিদ মারা যান ১৮ মার্চ । ‘কোনো কারণে, কোনো কারণেই ফেরানো গেলোনা তাকে, ফেরানো গেলোনা কিছুতেই.. সে যে হৃদয় পথের রোদে একরাশ মেঘ ছড়িয়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই’- গানের কথাগুলোর মতই হারিয়ে গেলেন তিনি।
গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ১৯৮১ সালে গানের জগতে যাত্রা করেন। ১৯৮৩ সালে যোগ দেন ‘চাইম’ ব্যান্ডে।
তিনি চাইম ব্যান্ডের ভোকালিস্ট হিসেবে জনপ্রিয়তা পান। 'সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে’, ‘কোনো কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’, ‘হয়নি যাবারও বেলা’, ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’, ‘তুমি নেই তাই’ এমন বহু শোতাপ্রিয় গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এ শিল্পী।
কুমুদিনী হাজং
ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের সাক্ষী নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার কুমুদিনী হাজং ২৩ মার্চ মারা যান।
লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজং। সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে। কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল টংক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ।
জমিদারদের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সেই সময় রাজ সেনার বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে বাতিল হয় টংক প্রথা।
জিয়া রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক জিয়া রহমান মারা যান ২৩ মার্চ। তার বয়স হয়েছিল ৬০ বছর।
অধ্যাপক জিয়া রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন।
গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলায় জন্ম নেওয়া জিয়া রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করে কানাডায় উচ্চতর ডিগ্রি নেন। শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
অধ্যাপক জিয়া রহমান ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজির বোর্ড ডিরেক্টর ছিলেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের ডিরেক্টর ছিলেন।
মহি আল ভান্ডারী
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের গীতিকার ও সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন ওরফে মহি আল ভান্ডারী ৭ এপ্রিল মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন চিরকুমার এই শিল্পী।
তিনি ‘অ জেডা ফইরার বাপ’, ‘মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়ে’, ‘মন হাচারা মাঝিরে তোর সাম্পানত চইড়তাম ন' সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ও সুরকার। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রায় সব শিল্পী তার লেখা ও সুর করা গান গেয়েছেন।
শিব নারায়ণ দাশ
বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম নকশাকার শিব নারায়ণ দাশ মারা যান ১৯ এপ্রিল। ৭৮ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তার দেহ দান করে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর কর্নিয়া দিয়ে গেছেন সন্ধানীতে।
শিব নারায়ণের তৈরি করা বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত পতাকা ধরেই হয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল।
লাল-সবুজের ভেতরে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত ওই পতাকার নকশা যারা করেছিলেন, তাদের একজন সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শিব নারায়ণ দাশ। পরে তিনি যোগ দিয়েছিলেন জাসদে।
আহমেদ সাদ
পেপার রাইম ব্যান্ডের গায়ক আহমেদ সাদ মারা যাস ২৩ এপ্রিল । ‘অন্ধকার ঘরে’র মত গানের জন্য ৯০ এর দশকের শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি পাওয়া এই গায়ক দীর্ঘদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন।
নব্বই দশকে মাত্র একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেই শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল ব্যান্ড পেপার রাইম এবং শিল্পী আহমেদ সাদ।
হায়দার আকবর খান রনো
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা, প্রবীণ রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনো মারা যান ১১ মে। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হায়দার আকবর খান রনো ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন। ৯০ দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ এরশাদ পতনের গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকলেও ২০১০ সালে মতভিন্নতার কারণে এই দলটি ছেড়ে সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন।
রাজনীতিকের পরিচয়ের বাইরে তিনি তাত্ত্বিক ও লেখক। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৩।
দুলাল তালুকদার
প্রাবাসী নৃত্যশিল্পী দুলাল তালুকদার ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের কাছে মেডফোর্ড শহরে মারা যান। এই নৃত্যশিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের রোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
দুলাল তালুকদার বাংলাদেশের বুলবুল ললিতকলা একাডেমির প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে নৃত্যশিল্পী, শিক্ষক, কোরিওগ্রাফার এবং সংগীতজ্ঞ। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার কাজে তিনি নানা ধরনের অবদান রেখেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর কিছুদিন দেশে ছিলেন দুলাল তালুকদার। তারপর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে স্থায়ীভাবে তার বসবাস শুরু ১৯৭৪ সালে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি), বোস্টন ইউনিভার্সিটি, বিশ্বখ্যাত লোকনৃত্যদল ‘মান্দালা’সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি নাচের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ড্যান্সের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
গত শতকের ষাটের দশকে সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে নৃত্য পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন দুলাল।
শফী আহমেদ
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফী আহমেদ মারা যান ৩ জুন। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
যাদের সাহসী নেতৃত্বে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল, তাদের মধ্যে শফী আহমেদ উজ্জ্বল এক নাম। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের অন্যতম শীর্ষ নেতা।
শফী আহমেদ জাসদ থেকে পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপ–কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
২০০৭ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে নেত্রকোণা–৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন শফী আহমেদ। কিন্তু সেবার আর নির্বাচন হয়নি।
অসীম সাহা
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা মারা যান ১৮ জুন। ৭৫ বছর বয়সী এই কবি ডায়াবেটিস ছাড়াও বার্ধক্যের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। পারকিনসন ডিজিজেও আক্রান্ত ছিলেন তিনি।
অসীম সাহার লেখালেখি শুরু ১৯৬৪ সালে। ঢাকার পত্রিকায় ছোটদের জন্য লেখা ছাপা হয় ১৯৬৫ সালে। সেই থেকে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর কবিতা, গান রচনা করে গেছেন কবি অসীম সাহা। সব মিলিয়ে ৩০টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।
পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায় (১৯৮২), কালো পালকের নিচে (১৯৮৬), পুনরুদ্ধার (১৯৯২), উদ্বাস্তু (১৯৯৪), মধ্যরাতের প্রতিধ্বনি (২০০১), অন্ধকারে মৃত্যুর উৎসব (২০০৬), মুহূর্তের কবিতা (২০০৬), সৌর-রামায়ণ (২০১১), কবর খুঁড়ছে ইমাম (২০১১), প্রেমপদাবলি (২০১১), পুরনো দিনের ঘাসফুল (২০১২) তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই।
আলমগীর খান
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক আলমগীর খান ১৯ জুন মারা যান। দুই মেয়াদে বোর্ডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের এই পরিচিত মুখ।
ক্রিকেটের বাইরে বরিশাল জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সবশেষ বরিশাল বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার প্রধান ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান
জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতায় খেলা চলছিল দুই গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান ও এনামুল হোসেন রাজীবের মধ্যে। এর মধ্যেই হঠাৎ লুটিয়ে পড়েন জিয়া। দ্রুত হাসপাতালে নিলেও ফেরানো যায়নি তাকে। এ বছর ৫ জুলাই প্রয়াত হন এই দাবাড়ু।
১৯৭৪ সালের ১ মে জন্ম নেওয়া জিয়ার দাবার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে ছোটবেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃ-বিজ্ঞানে পড়াশোনা করা জিয়া ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন দাবাকেই।
১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করা জিয়া ১৯৯০ সালে ফিদেমাস্টার, ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার ও ২০০২ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হন।
শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ
পিরোজপুরের ছারছীনার পীর বাংলাদেশ জমইয়াতে হিযবুল্লাহর আমির শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ ১৬ জুলাই মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি।
‘ছারছীনা দারুসুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতা শাহ নেছারউদ্দিন (রহ.) এর দৌহিত্র শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ ছিলেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদার্রেসিনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্সের মুতাওয়াল্লি।
সারা দেশে প্রায় দুই হাজার মাদ্রাসাসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
শাফিন আহমেদ
দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাফিন আহমেদ ২৫ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
২০ জুলাই ভার্জিনিয়ায় একটি কনসার্টে গান করার কথা ছিল শাফিনের। কিন্তু তার হার্ট অ্যাটাক হলে শো বাতিল করা হয়। সেদিনই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শাফিনকে, পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে; কিন্তু বাঁচানো যায়নি।
বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনের দুই মহারথী সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম এবং সুরকার কমল দাশগুপ্তের ছেলে শাফিন নিজে ছিলেন বেইজ গিটারিস্ট, সুরকার এবং গায়ক।
আশি আর নব্বইয়ের দশকে কিশোর-তরুণ শ্রোতাদের মন মাতানো ‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি’, ‘জ্বালা জ্বালা জ্বালা এই অন্তরে’, ‘ফিরিয়ে দাও’ এর মত গান দিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের মনে জায়গা করে আছেন তিনি।
আবিদুর রেজা জুয়েল
নব্বই দশকের জনপ্রিয় গায়ক হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল ৩০ জুলাই মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই, দেশে-বিদেশে চিকিৎসা আর এ সবের মধ্যেই জীবিকা চালিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছিল তাকে।
গান গাওয়ার পাশাপাশি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতাও ছিলেন এই গায়ক। যুক্ত ছিলেন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজেও।
তার প্রথম অ্যালবাম ‘কুয়াশা প্রহর’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘এক বিকেলে (১৯৯৪)’, ‘আমার আছে অন্ধকার’ (১৯৯৫), ‘একটা মানুষ’ (১৯৯৬), ‘বেশি কিছু নয়’ (১৯৯৮), ‘বেদনা শুধুই বেদনা’ (১৯৯৯), ‘ফিরতি পথে’ (২০০৩), ‘দরজা খোলা বাড়ি’ (২০০৯) এবং ‘এমন কেন হলো’ (২০১৭)।
প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ৯ অগাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।
শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান শহীদুল্লাহ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
১৯৯৮ সালে জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি অনেকগুলো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গ্যাস রপ্তানি ও গ্যাস নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল, চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন এক জালিয়াত কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া ঠেকানো, টাটার বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রকল্প ও ফুলবাড়ী রপ্তানিমুখী উন্মুক্ত খনি বিরোধী আন্দোলন, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ওস্তাদ মিহির লালা
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক ওস্তাদ মিহির লালা ১৭ অগাস্ট চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে মারা যান; তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রখ্যাত শিল্পী মিহির লালার সংগীত সাধনার ক্যারিয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময়ের। তার হাতেখড়ি হয়েছিল ওস্তাদ আবু বক্কর সিদ্দিকীর হাতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক ছিলেন মিহির লালা। ঢাকার জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি তাকে বিশেষ শিল্পী সম্মাননা দিয়েছিল।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র ‘আর্য্য সংগীত সমিতি’ ও 'সুরেন্দ্র সংগীত বিদ্যাপীঠ’ এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
গোলাম মুরশিদ
এ বছর ২২ অগাস্ট লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ। বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি।তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
বাংলাদেশের ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবগুলো দিকে গোলাম মুরশিদের পাণ্ডিত্য ছিল সুবিদিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ থেকে ১৯৭৭ সালে পিএইচডি করেন গোলাম মুরশিদ। তার সেই গবেষণাকর্ম ১৯৮৪ সালে 'হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও বাংলা নাটক' নামে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়।
গোলাম মুরশিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, উনিশ শতকের নারী জাগরণ মূলত পুরুষদের আগ্রহে এবং পুরুষদের প্রয়োজনে ঘটেছিল। বইটির বাংলা সংস্করণ পরে প্রকাশিত হয় 'সংকোচের বিহ্বলতা: আধুনিকতার অভিঘাতে বঙ্গরমণী'নামে।
তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে কালান্তরে বাংলা গদ্য (১৯৯২), যখন পলাতক (১৯৯৩), আশার ছলনে ভুলি এবং বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার আদি-পর্ব (১৯৮৬), আঠারো শতকের গদ্য: ইতিহাস ও সংকলন, বিদ্রোহী রণক্লান্ত।
আমানউল্লাহ খান
দেশের বেসরকারি সংবাদ সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ-ইউএনবি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ খান ১২ সেপ্টেম্বর মারা যান। তিনি অ্যাডভান্স ডিমেনশিয়া এবং পারকিনসন রোগে ভুগছিলেন।তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
কসমস গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান আমানউল্লাহ খান ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠান করেন ইউএনবি। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপির সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে দেশের বেসরকারি এ সংবাদ সংস্থা যাত্রা শুরু করে।
পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আমানউল্লাহ খান কসমস প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং লিমিটেডেরও কর্ণধার ছিলেন। এখান থেকে বাংলাদেশের অন্যতম পুরনো ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা কুরিয়ার প্রকাশ হয়েছে। আমানউল্লাহ খান কমনওয়েলথ জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশেনের সদস্য ছিলেন।
আজমল হোসেন খাদেম
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি আজমল হোসেন খাদেম মারা যান ১৭ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
আজমল হোসেন খাদেম বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন সত্তরের দশকে। তিনি বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ পর্যালোচনা ভিত্তিক কথিকা ‘সংবাদ প্রবাহ’ গ্রন্থনা করতেন, যা বেশ শ্রোতা নন্দিত হয়েছিল।
১৯৮৮ সালে আজমল হোসেন খাদেম ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের স্থায়ী সদস্যও ছিলেন তিনি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি কিছুদিন কাজ করেছেন।
বিমল কর
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় বিমল কর ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
বিমল কর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, চট্টগ্রাম ফুটবল খেলোয়াড় সমিতি ও চট্টগ্রাম রেফারিজ ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারাস, ফেনী ও বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার হয়ে তিনি বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছেন।
রুহুল আমিন গাজী
ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস, লবণ ঘাটতিসসহ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়া এই সাংবাদিক দৈনিক সংগ্রামে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার সরকারের সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন টানা ১৮ মাসের বেশি সময়। বিএনপি সমর্থিত পেশাজীবী সংগঠন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
অঘোর মন্ডল
ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল মারা যান ২৫ সেপ্টেম্বর। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৫৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিক।
লাল সবুজ পত্রিকা দিয়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতা শুরু করেন অঘোর। তিন দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে আজকের কাগজ, ভোরের কাগজের মত পত্রিকাতেও কাজ করেছেন।
একসময় টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নাম লেখান অঘোর। চ্যানেল আই ও দীপ্ত টিভিতে দীর্ঘদিন কাজ করার পর সবশেষ এটিএন নিউজে যোগ দেন। এটিএন নিউজের ডিজিটাল ও নিউ মিডিয়ায় বার্তা সম্পাদক হিসেবে সবশেষ কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক ঘটনার সাক্ষী হওয়া এই সাংবাদিক।
আবদুল গফুর
তমদ্দুন মজলিশের সদস্য, ভাষা সংগ্রামী ও সাংবাদিক অধ্যাপক আবদুল গফুর ২৭ সেপ্টেম্বর মারা যান।তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
আবদুল গফুর তমদ্দুন মজলিশের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথের বিক্ষোভ-সংগ্রামে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ভাষা আন্দোলনের সময়ে ‘সৈনিক’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ঢাকার আবু গিফারী কলেজ ও ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে ১৭ বছর শিক্ষকতা করেছেন আবদুল গফুর। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রকাশনা পরিচালক ও দারুল উলুমের সুপারিন্টেন্ডেট হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক আজাদ, দৈনিক দেশ, দৈনিক ইনকিলাব, ইংরেজি দৈনিক পিপল, দৈনিক নাজাতসহ আরও পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি।
আলমগীর রহমান
চার দশকের পুরনো প্রকাশনা সংস্থা 'অবসর' এর স্বত্বাধিকারী আলমগীর রহমান মারা যান ২৭ সেপ্টেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকায় সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন আলমগীর রহমান। পরে ১৯৮৫ সালে অবসর প্রকাশনীর গড়ে তোলেন। শুরুতে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল বইয়ের অনুবাদগুলো তিনি পেপার ব্যাকে প্রকাশ করেন৷
অবসর থেকে প্রকাশ হয় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস 'দেবী'। গত চার দশক ধরে এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে সাহিত্যের নানা শাখার বই বের হয়েছে।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যও ছিলেন আলমাগীর রহমান৷
বদিউল আলম
দীর্ঘদিন ধরে বয়সনজিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে ২৯ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় নেন প্রবীণ সাংবাদিক বদিউল আলম। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
বদিউল আলম গণকণ্ঠ, ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, নিউজ টুডে পত্রিকায় প্রধান প্রতিবেদক, বিশেষ প্রতিনিধি, সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি নিউজ টুডে পত্রিকায় সিটি এডিটর ছিলেন।
অর্থনীতি ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কাজ করা এই সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সব সময়ে। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সহসভাপতি, কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন পদে ছিলেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন বদিউল আলম।
একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী
সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ৪ অক্টোবর মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান খ্যাতিমান এই চিকিৎসককে রাজনীতিতে যুক্ত করতে ১৯৭৮ সালে নিজের প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রথম মহাসচিব করেন। বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থেকে ১৯৭৯, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বদরুদ্দোজা।
জিয়াউর রহমানের সরকারে তিনি উপ প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারে শিক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন বদরুদ্দোজা। পরে তিনি বিএনপি ছেড়ে ২০০৪ সালের ৮ মে ‘বিকল্পধারা বাংলাদেশ’ নামের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন।
জামালউদ্দিন হোসেন
মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি কুড়ানো জামালউদ্দিন হোসেন ১২ অক্টোবর কানাডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় শুরু করেন জামালউদ্দিন হোসেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে মঞ্চে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ান। তবে তারকা হয়ে ওঠেন টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করে।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং বেতার টেলিভিশন শিল্পী সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন জামালউদ্দিন হোসেন। নাটকে অবদানের জন্য ২০১৩ সালে তিনি একুশে পদক পান।
মতিয়া চৌধুরী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘অগ্নিকন্যা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ১৬ অক্টোবর মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
ইডেন কলেজে পড়ার সময় বাম ধারার ছাত্র রাজনীতিতে জড়ান মতিয়া চৌধুরী। ১৯৬১-৬২ মেয়াদে তিনি ছিলেন ইডেন কলেজ ছাত্রী সংসদের ভিপি। ১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা ছিল মতিয়া চৌধুরীর। আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিঝরা বক্তৃতার জন্য তাকে বলা হত ‘অগ্নিকন্যা’। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহুবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে মতিয়া চৌধুরীকে। জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।
শেরপুর-২ আসনের ছয়বারের সংসদ সদস্য মতিয়া চৌধুরী ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৩ সালে তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালে তাকে সংসদ উপনেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সর্বশেষ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকার জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দেয়।
সুজেয় শ্যাম
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী সুজেয় শ্যাম ১৭ অক্টোবর মারা যান। ৭৮ বছরের জীবনের শেষ দিনগুলো তার কেটেছে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে সুজেয় শ্যামের নাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।
এর মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘আহা ধন্য আমার’, ‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’।
তার সুর করা গানের মধ্যে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি বাংলাদেশের যে কোনো জাতীয় দিবসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সুজেয় শ্যাম। ঢাকাই চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সংগীত প্রযোজক পদ থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান সুজেয় শ্যাম। তিনি মঞ্চনাটকেও সংগীত পরিচালক হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
মনি কিশোর
এ বছর ২০ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরার বাসা থেকে নব্বই দশকের জনপ্রিয় গায়ক মনি কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হয়, ৪-৫ দিন আগেই তিনি মারা গেছেন।
মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও, টিভির তালিকাভুক্ত এই শিল্পীর জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসো’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি। তার সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তারই সুর করা, তারই লেখা।
মাসুদ আলী খান
বর্ষিয়ান অভিনয়শিল্পী মাসুদ আলী খান চিরবিদায় নেন ৩১ অক্টোবর। ৯৫ বছরের জীবনের শেষ দিনগুলো তার কাটছিল নানা অসুস্থতায়।
মাসুদ আলী খান পঞ্চাশের দশকে ড্রামা সার্কেলের হয়ে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র চালুর পর ‘ভাই ভাই সবাই’ দিয়ে তার ছোট পর্দায় অভিনয় শুরু।
দীর্ঘ অভিনয় জীবনে নাটকের পাশাপাশি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন মাসুদ আলী খান। ২০২৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।
ডা. মবিন খান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কোষাধ্যক্ষ, হেপাটোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মবিন খান মারা যান ৩১ অক্টোবর। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি ছিলেন মবিন খান। সোসাইটির ওয়েবসাইটে ডা. মবিন খানকে ‘ফাদার অব হেপাটোলজি ইন বাংলাদেশ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিভার রোগ গবেষণায় তার অবদান রয়েছে।
আফরোজা হোসেন
ছোট পর্দার অভিনেত্রী আফরোজা হোসেন মারা যান ১০ নভেম্বর। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়ে, সেই ক্যান্সার ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মেরুদণ্ডে- যা তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
২০০৮ সাল থেকে ছোট পর্দায় অভিনয় শুরু করেন আফরোজা। ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নাটকের অভিনয়ে তিনি নিয়মিত হন।
‘ঠেটারু’, ‘সূর্য অস্তের আগে’, ‘বিদেশি ছেলে’সহ বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। এই অভিনেত্রী আলোচনায় আসেন অনন্য মামুনের পরিচালনায় ‘আবার বসন্ত’ সিনেমায় অভিনয় করে।
স ম জাকারিয়া
সাবেক নির্বাচন কমিশনার স ম জাকারিয়া মারা যান ১২ নভেম্বর; তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত স ম জাকারিয়া ২০০২ সালের ১ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন সচিব হন। আলোচিত সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ কমিশনের একজন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন তিনি।
২০০৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর এক বছর দায়িত্ব পালন করে ২০০৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পুরো কমিশনের সঙ্গে তাকে বিদায় নিতে হয়।
ওস্তাদ আশীষ খাঁ
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সরোদবাদক ওস্তাদ আশীষ খাঁ ১৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার এক হাসপাতালে মারা যান।তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
আশীষ খাঁর জন্ম ভারতের মাইহারে হলেও তার পূর্বপুরুষের ভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের শিবপুর গ্রামে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাতি ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর ছেলে তিনি।
শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও সরোদবাদক হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছিল আশীষ খাঁর। 'গোল্ডেন স্ট্রিংস অফ দ্য সরোদ' অ্যালবামের জন্য ২০০৬ সালে গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি।
বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম মারা যান ১৬ নভেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত হাই কোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পর হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে যোগ দেন জলুল করিম। ২০০১ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হন।
বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের অষ্টাদশ প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জাকারিয়া পিন্টু
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ১৮ নভেম্বর মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে একঝাঁক স্বাধীনতাকামী ও সাহসী ফুটবলার ও ফুটবল কর্মকর্তা দল গঠন করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ১৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন। সেই ম্যাচ থেকে পাওয়া অর্থ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরেও জাতীয় দলের হাল ধরেন জাকারিয়া পিন্টু। তার অধীনে ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়া মারদেকা কাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ফুটবল সংগঠক হিসেবে তিনি জড়িত ছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গে।
বিচারপতি মো. রুহুল আমিন
সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগে ২৪ নভেম্বর মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
১৯৪১ সালের ১ জুন লক্ষ্মীপুরে জন্ম নেওয়া রুহুল আমিন ১৯৯২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০০১ সালের ১১ জানুয়ারি তাকে আপিল বিভাগের বিচারক করে নেওয়া হয়।
২০০৭ সালের ১ মার্চ থেকে ২০০৮ সালের ৩১ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি রুহুল আমিন।
মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ
বাংলা একাডেমির সাবেক সভাপতি ও মহাপরিচালক, গবেষক ও অনুবাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ মারা যান ২৬ নভেম্বর। ৮৫ বছর বয়সী এই গবেষক কিডনিসহ বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
বাংলা একাডেমিতে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মোহাম্মদ হারুন-উর রশিদ অভিধান প্রণয়ন ও প্রকাশ, 'আনন্দ পঠন গ্রন্থমালা' প্রকাশ, 'তরুণ লেখক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি' বাস্তবায়ন, একাডেমিতে গবেষণা, প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ এবং একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের বিপণন, একাডেমি প্রেসের আধুনিকায়নসহ নানা ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন পাঁচ বছর। পরে একাডেমির সভাপতিও ছিলেন। অনুবাদ সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমির 'আবু রুশদ সাহিত্য পুরস্কার' এ ভূষিত হন।
আবু জাফর
গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগে ৬ ডিসেম্বর মারা যান।
তার রচিত সাড়া ফেলা দেশাত্মবোধক গান ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানটি বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি গানের মধ্যে স্থান পেয়েছিল।
এই গীতিকারের অন্যান্য গানের মধ্যে রয়েছে 'তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম', 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে', 'আমি হেলেন কিংবা নূরজাহানকে দেখিনি', 'তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি'।
সনজিত আচার্য্য
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার সনজিত আচার্য্য ৯ ডিসেম্বর মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
'বাঁশখালী মইশখালী পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই চলে’, ‘ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে’, ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া জানে না’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা সনজিত আচার্য্য।
চট্টগ্রামের অনেক লোকগান, ‘হালদাফাডা’ গান, মাইজভান্ডারি ঘরানার গানে সুর, কথা ও কণ্ঠ দিয়েছেন সনজিত।
পাপিয়া সারোয়ার
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ১২ ডিসেম্বর মারা যান একুশে পদকজয়ী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। তার বয়স হয়েছি ৭১ বছর।
দর্শক-শ্রোতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘নাই টেলিফোন নাইরে পিয়ন নাইরে টেলিগ্রাম’ গানের শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারের খ্যাতি রবীন্দ্রসংগীতে। আধুনিক গানেও তিনি পরিচিত।
২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ লাভ করেন। চলতি বছর চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে রবীন্দ্রমেলায় পাপিয়া সারোয়ারকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়।
হেলাল হাফিজ
প্রেম আর দ্রোহের কবি হেলাল হাফিজ ১৩ ডিসেম্বর মারা যান। অকৃতদার এই কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটছিল ঢাকার শাহবাগের সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে।
৭৬ বছরের জীবনে খুব কম লিখেছেন হেলাল হাফিজ। তবে তার কবিতা যেমন হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান, তেমনই আবার হয়ে উঠেছিল প্রেমের চিঠির অনুষঙ্গ।
‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে।
আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় ও সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
এস এম আকরাম
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম আকরাম ১৬ ডিসেম্বর মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, ডায়াবেটিকসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন ৮০ বছর বয়সী এই সাবেক আমলা।
আকরাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। অবসরের পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি জেলা আওয়ামী লীগেরও আহ্বায়ক ছিলেন। পরে এস এম আকরাম নাগরিক ঐক্যে যোগ দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
এ এফ হাসান আরিফ
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, প্রবীণ আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ ২০ ডিসেম্বর মারা যান।
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে মন্ত্রী মর্যাদায় ভূমি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেল বিভিন্ন মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী হিসেবেও আদালতে দাঁড়িয়েছেন।
৮৩ বছরের জীবনের বেশিরভাগটা তার কেটেছে আইন পেশায়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী ছিলেন ‘এএফ হাসান আরিফ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ চেম্বারের প্রধান।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৮৫ সালের অগাস্ট পর্যন্ত তিনি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
পরে ১৯৮৫ সালের অগাস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিএনপি জামায়াত-জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
হাসান আরিফ ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা ছিলেন।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের একজন প্যানেল সদস্য ছিলেন তিনি।
মিনহাজ আহমেদ পিকলু
অর্থহীন ব্যান্ডের সাবেক গিটারিস্ট মিনহাজ আহমেদ পিকলু ২০ ডিসেম্বর মারা যান।
সেদিন রামপুরায় একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি পারফর্ম করছিলেন। পারফর্মেন্স শেষে স্টেজেই অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু বাঁচানো যায়নি। ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছিল তার।
রকস্ট্রাটা, জলি রজার্স, মাকসুদ ও ঢাকার মত ব্যান্ডের সঙ্গে বাজিয়েছেন পিকলু। সেশন গিটারিস্ট হিসেবেও অনেক ব্যান্ড এবং শিল্পীদের সঙ্গে দেখা গেছে তাকে।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে কিছুদিন তিনি ওয়ারফেজে ছিলেন। এরপর অর্থহীন ব্যান্ডে যোগ দেন ১৯৯৯ সালে।
অর্থহীনের 'রাতের ট্রেন', 'গুটি ফ্রম হেল', 'নির্বোধ', 'অদ্ভুত সেই ছেলেটি'সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় গানে গিটার বাজিয়েছেন পিকলু।
সি বি জামান
হার্ট অ্যাটাক করে ১৩ ডিসেম্বর থেকে হাসপাতালে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সি বি জামান। পরে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। ২০ ডিসেম্বর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
'উজান ভাটি' খ্যাত এ নির্মাতার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার ‘পুরস্কার’ সিনেমাটি ১৯৮৩ সালে পাঁচ বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়।
১৭৯৩ সালে চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেন সি বি জামান। 'ঝড়ের পাখি', 'উজান পাখি'সহ বেশকিছু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ ‘কুসুম কলি’ নামের চলচ্চিত্র তিনি নির্মাণ করেন।