দিনশেষে তাই সেরা হওয়ার হাজার বছরের পুরনো মারামারিই দেখতে পাই আমরা— কখনো ঢাকা কলেজের গেটে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, আবার কখনো পাড়ার মোড়ে কিংবা রাজপথে।
Published : 17 Apr 2025, 10:09 AM
ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজ— রাজধানীর এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা সেই ‘চিরশত্রু’ তকমার মতো। বাইরের কেউ দেখলে ভাববে, এরা বুঝি কোনো পুরনো যুদ্ধের উত্তরসূরি। এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা হুটহাট রাস্তায় নামে, একে অপরকে দেখে গর্জে ওঠে, তারপর শুরু হয় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া, ইট-পাটকেল, চিৎকার, মোবাইলে ভিডিও, ভাইরাল স্ট্যাটাস! কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে, ‘এরা মারামারি করল কেন?’ সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই সব কিছু কেমন ঝাপসা হয়ে যায়।
ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজ— এই দুই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে রাজধানীবাসীর এখন আলাদা একটা প্রস্তুতি থাকে। যেমন: আকাশ মেঘলা দেখলে লোকজন ভাবে ছাতা নেবে কিনা, তেমনি মিরপুর রোডে নামার আগে লোকজন ভাবে, ‘আজকে কাদের শিফট?’ কারণ, সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন এই দুই কলেজের কিছু তরুণ শিক্ষার্থী হঠাৎ রাস্তায় নামেন— আর তখন ঢাকা শহরের মানুষ বোঝে, প্রকৃতির মতোই এই মারামারিও একটা চিরচেনা ঋতু চক্রের অংশ!
গত ১৫ এপ্রিলের ঘটনাটাই ধরা যাক। দুপুরের রোদের তাপে ঢাকার গনগনে রাস্তায় হঠাৎই চিৎকার-চেঁচামেচি, ভাঙচুর আর ছুটোছুটিতে এক মুহূর্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আবারও ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমেছে। রাজধানীবাসী দম বন্ধ করে নিউজফিডে চোখ রাখে, ট্রাফিক সিগন্যালের বদলে কারা এখন রাস্তায় সিগন্যাল দিচ্ছে তা বুঝতে।
এর মধ্যেই সাংবাদিক ভাই সাহস করে একজন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘স্যার, এরা মারামারি করল কেন?’ পুলিশ ভাই কিছুক্ষণ থমকে রইলেন, এক অদৃশ্য চাপে পড়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে গভীর দার্শনিক ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনারা দেখেছেন দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করেছে। আসলে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না— কেন এরা মারামারি করেছে।’
এই একটা বাক্যে যেন আমাদের সমাজের একটা মহাজাগতিক অসহায়তা ফুটে উঠল। এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও স্বীকার করছে— ‘আমরা কিছু জানি না ভাই, আল্লাহর উপরই ভরসা।’
পুলিশ প্রমাণ পেয়েছে, এই মারামারির পেছনে কোনো প্ররোচনা নেই। আছে শুধু ‘সেলফ-এস্টিম’ নামক ভাইরাস। আসল কথা হলো, ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘কারণ’ নামক জিনিসটা লাক্সারি আইটেম। ওদের মারামারির কারণ খুঁজতে গেলে কেবল একটাই উত্তর মিলবে: ‘সেরা হবার নেশা’। একে অপরকে দেখলেই ওদের ব্রেনে অটো-প্লে হয়— ‘এই যে! ওই গ্রুপটা আমার চেয়ে সেরা হবার ভান করছে? থাপ্পড় মারতে হবে!’
এই ‘বেহুদা যুদ্ধ’কে আমরা ‘বাংলাদেশি সিনড্রোম’ বলতে পারি— যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠত্বের ধারক ভাবে। ঢাকা কলেজের ছাত্র মনে করে, ‘আমরা তো ব্রিটিশ আমলের লিগ্যাসি!’ সিটি কলেজের ছাত্র কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়, ‘আমাদের ক্যাম্পাসে গাছের সংখ্যাই বেশি!’ অথচ পরীক্ষার রেজাল্ট খুললে দুই পক্ষই ফার্স্ট-সেকেন্ডের লড়াইয়ে ব্যস্ত... সেটা অন্য ইস্যু।
এই দুই কলেজের ছাত্ররা কেন মারামারি করে, তার উত্তরটা সহজে পাওয়া যায় না। কোনো জমি-জমা নেই, প্রেমিকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘাত না, রাজনৈতিক সংঘর্ষ তো নয়ই। এদের সমস্যা একটাই— কে বেশি ‘সেরা’! আসলে এই দুই কলেজের কচিকাঁচারা, প্রত্যেকে নিজেদেরকে ‘সেরা’র সেরা ভাবে। তাদের মনে এই বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে যে তারা যা, তাই যেন জগতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। তাদের কলেজের গেটের বাইরে পা রাখা মাত্রই তারা এক অদৃশ্য অহংকারের চাদরে নিজেদের মুড়ে ফেলে। কেউ যদি ভুলেও তাদের দিকে চোখ তুলে তাকায় কিংবা সামান্য উঁচু গলায় কথা বলে, ব্যস! অমনি তাদের ভেতরের ‘সেরা’ নামক সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে। ‘কত বড় সাহস! আমি হচ্ছি সেরা! আমাকে কথা শোনায়!’— এই মন্ত্র জপতে জপতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্তারক্তিতে। ওরা নিজেরাই নিজেদের ‘লেজেন্ড’ ধরে নেয়। এই ‘সেরা’ ভাবার পেছনে কোনো পরীক্ষার ফলাফল নেই, নেই কোনো প্রতিযোগিতার সূচি, নেই কোনো মানদণ্ড— আছে শুধু এক অলৌকিক বিশ্বাস, ‘আমি সেরা, কারণ আমি এ কলেজে পড়ি। এবং যদি কেউ আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে, তবে তার জবাব দিতে হবে রক্ত দিয়ে।’
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই সংঘর্ষের আগে-পরে কাউকে কোনো যুক্তিপূর্ণ কারণ জিজ্ঞেস করলে পাওয়া যাবে রেফারেন্সহীন কিছু সংলাপ— ‘ওরাই আগে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়েছিল।’
—‘ওরা বলে ওদের কলেজ নাকি সেরা!’
— ‘আমার ফ্রেন্ডকে অপমান করছে। আমি কি চুপ থাকতে পারি?’
এই যুক্তিগুলো যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়, তবে নিশ্চিত ভাবেই ‘অবিবেচ্য সাহস’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জিতবে।
ঢাকা কলেজ আর সিটি কলেজের এই কিশোর-তরুণদের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায়, এরা আসলে গভীর এক আত্মপরিচয়ের সংকটে আছে। সমাজ তাদের বলেছে— ‘তুমি পড়াশোনায় ভালো করো, তাহলে সেরা হবে!’ কিন্তু সেই পড়াশোনার সংজ্ঞা যদি হয়, ‘নিজের কলেজ নিয়ে গর্ব করা, আর অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের থাপ্পড় দেওয়া,’ তাহলে তো সব জ্ঞানই খালি গুলি হয়ে উড়ে যাবে।
পুলিশ ভাই ঠিকই বলেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না।’ আল্লাহ নিশ্চয়ই জানেন। তবে সব ধর্মই বলে, ‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে চিন্তা করতে, প্রশ্ন করতে, ভালোবাসতে।’ এই মানুষ কবে বুঝবে, কে ‘সেরা’ সেটা একটা ধোঁকা!
এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের লড়াই আসলে একটা ছায়াযুদ্ধ, যেখানে মূল সমস্যা নিজের মধ্যে। এরা নিজেরাই জানে না, এতো রাগ, এতো বিদ্বেষ কোথা থেকে আসে। মাঝেমধ্যে কোনো নিরীহ পথচারী বা সিএনজি ড্রাইভার পড়ে যায় দুইপক্ষের মাঝে— তখন তারা বুঝে, ‘এটা কেবল কলেজ লড়াই না, এটা একটা সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন।’
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, এ দেশে ‘সেরা’ হবার প্রতিযোগিতা শুরু সত্যযুগে। মহাভারতের কর্ণ-অর্জুন থেকে আজকের কলেজ স্টুডেন্টস— সবাই একই রেসের ঘোড়া। বাংলাদেশ নামক এই জনপদে প্রায় সবাই ‘সেরা’ রোগে আক্রান্ত। কেউ ভালো গায়, বলে আমি সেরা। কেউ ভালো খায়, বলে আমি সেরা। কেউ গার্ডার বসায়, কেউ পদ্মা সেতু বানায়, কেউ টিকটকে নাচে— সবাই ভাবছে, ‘আমিই সেরা’। এখানে রিকশাচালক থেকে শুরু করে অফিসের কেরানি, পাড়ার ভাই থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক— কমবেশি সবাই নিজেদেরকে কোনো না কোনোভাবে ‘সেরা’ মনে করে। এই ‘সেরা’ত্বের বিষ এমনভাবে আমাদের রক্তে মিশে গেছে যে এর কোনো চিকিৎসা আজ পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি।
তাই তো আমরা দেখি, সামান্য একটা বিষয় নিয়েও এখানে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। একজন আরেকজনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে নারাজ। রাস্তায় দুটো গাড়ি সামান্য ধাক্কা খেলেই হাতাহাতি, সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতেই রক্তারক্তি। এই ‘সেরা’ হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমরা ভুলে যাই পারস্পরিক সম্মান, সহমর্মিতা আর ভালোবাসার কথা। দিনশেষে তাই সেরা হওয়ার হাজার বছরের পুরনো মারামারিই দেখতে পাই আমরা— কখনো ঢাকা কলেজের গেটে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, আবার কখনো পাড়ার মোড়ে কিংবা রাজপথে।
আসলে আমাদের বোঝা উচিত, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য মারামারি করার কোনো প্রয়োজন নেই। সত্যিকারের শ্রেষ্ঠত্ব আসে জ্ঞান, বুদ্ধি, আর মানবিক গুণাবলি থেকে। অন্যের প্রতি সম্মান জানানো এবং সহনশীলতা দেখানোই একজন মানুষকে প্রকৃত অর্থে ‘সেরা’ করে তোলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাদের সেই ‘সেরা’ রোগের জীবাণু যে বড় শক্তিশালী! তাই হয়তো পুলিশ কর্মকর্তার মতোই আমাদেরও শেষ পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে— ‘আসলে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না—কেন এরা মারামারি করে।’ আর এই মারামারি চলতেই থাকবে... হয়তো অনন্তকাল।