বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি বিশ্বের ৫০ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছেন, যেখানে নিম্ন-আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। এই বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অদক্ষতার জন্ম দিচ্ছে।
Published : 18 Apr 2025, 04:21 PM
বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি একটি নাজুক ও অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের বোঝা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মতো জটিল সমস্যাগুলো এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই সমস্যাগুলো কেবল সাময়িক নয়, বরং দীর্ঘদিনের কাঠামোগত ত্রুটি ও অপরিকল্পিত নীতির ফল। অর্থনীতিবিদ বেন রিডলি সম্প্রতি আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এই সংকটের কারণ এবং একটি ন্যায্য, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
সংকটের মূল কারণ
বিশ্ব অর্থনীতি বর্তমানে বহুমুখী সংকটের সম্মুখীন। এই সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বৃদ্ধি: ২০২২-২০২৪ সালে বিশ্বের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী গড় মুদ্রাস্ফীতি ৬.৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে। এর জেরে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান সুদের হার বাড়িয়েছে, যা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করছে।
২. বৈশ্বিক ঋণের বোঝা: বিশ্বব্যাংকের ২০২৫ সালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ঋণের পরিমাণ ৩০৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৩৩০০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা বিশ্ব জিডিপির প্রায় ৩৩০ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষ করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, এই ঋণের বোঝায় জর্জরিত। শ্রীলঙ্কা (২০২২) ও জাম্বিয়ার (২০২০) মতো দেশ ঋণ খেলাপির শিকার হয়েছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করে।
৩. ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা: রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন ঝুঁকি যোগ করেছে। এই যুদ্ধ জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে, যা নিম্ন-আয়ের দেশগুলোর জন্য বিপর্যয়কর। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৩৪.৫ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তন এখন অর্থনীতির জন্য একটি গুরুতর হুমকি। ২০২৩ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্বব্যাপী ৩৮০ বিলিয়ন ডলারের ( ৪২ লাখ কোটি) ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি কৃষি, অবকাঠামো এবং জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ধরনের দুর্যোগ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের সুযোগ না দিয়ে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে।
৫. বৈষম্যের বৃদ্ধি: অক্সফামের ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি বিশ্বের ৫০ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছেন, যেখানে নিম্ন-আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ২ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। এই বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অদক্ষতার জন্ম দিচ্ছে।
প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতা
বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা মূলত নব্য-উদারবাদী পুঁজিবাদ এবং বিশ্বায়নের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, তার দুর্বলতাগুলো স্পষ্ট। ২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকট এই ব্যবস্থার ঝুঁকিগুলো প্রকাশ করেছিল, যখন ব্যাংকিং খাতের অতিরিক্ত ঝুঁকি এবং নিয়ন্ত্রণহীন আর্থিক বাজার বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেয়। এরপর কোভিড-১৯ মহামারী সরবরাহ শৃঙ্খল ও বৈশ্বিক বাণিজ্যের দুর্বলতা উন্মোচন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মহামারীর সময় চীনের লকডাউনের কারণে সেমিকন্ডাক্টরের ঘাটতি বিশ্বব্যাপী অটোমোবাইল শিল্পে সংকট সৃষ্টি করে।
এছাড়া, প্রচলিত অর্থনৈতিক মডেল পরিবেশের ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার জলবায়ু সংকটকে তীব্র করছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশগত বিপর্যয় বিশ্ব অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি।
নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান সংকট একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে জোরালো করছে। এই নতুন ব্যবস্থার লক্ষ্য হবে:
নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কৌশল
নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. করপোরেট নিয়ন্ত্রণ ও কর সংস্কার: বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর কর ফাঁকি এবং শ্রম শোষণ রোধে কঠোর নীতি প্রণয়ন করতে হবে। ২০২১ সালে ওইসিডি/জি২০-এর উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম করপোরেট কর (১৫ শতাংশ) চালু করা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে, এই নীতির বাস্তবায়ন এবং আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
২. ঋণ ত্রাণ ও উন্নয়ন সহায়তা: উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণের বোঝা কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলোকে ঋণ মওকুফ বা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, জি২০-এর ডেট সার্ভিস সাসপেনশন ইনিশিয়েটিভ (ডিএসএসআই) ২০২০-২০২১ সালে ৪৬টি দেশকে ১২.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ স্থগিত করতে সাহায্য করেছে।
২. সবুজ অর্থনীতির প্রসার: নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি এবং পরিবেশবান্ধব শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ভারতে বায়ু শক্তি প্রকল্প এই দিকে অগ্রগতির উদাহরণ।
৩. ন্যায্য বাণিজ্য নীতি: বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে এমন বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে হবে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে। বর্তমানে, উন্নত দেশগুলোর ভর্তুকি এবং বাণিজ্য বাধা দরিদ্র দেশগুলোর কৃষি ও শিল্প পণ্যের বাজার প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে।
৪. সামাজিক উদ্যোগ ও সহযোগিতামূলক অর্থনীতি: সামাজিক উদ্যোগ এবং সহযোগিতামূলক অর্থনীতির মডেল, যেমন মাইক্রোফাইন্যান্স এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক ব্যবসা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক এবং ভারতের আমুল কো-অপারেটিভ এই ধরনের মডেলের সফল উদাহরণ।
সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব
নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে সরকার, বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। যুব সমাজের আন্দোলন, যেমন গ্রেটা থুনবার্গের ফ্রাইডে ফর ফিউচার বা বাংলাদেশের জলবায়ু আন্দোলন, এর উদাহরণ।
এছাড়া, প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল অর্থনীতি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বচ্ছ আর্থিক লেনদেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা উন্নত করা যেতে পারে। তবে, এই প্রযুক্তিগুলোর অপব্যবহার রোধে নীতিগত কাঠামো প্রয়োজন।
সংকটকে সুযোগে রূপান্তর
বর্তমান সংকটকে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ইতিহাসে বড় সংকটগুলো প্রায়ই নতুন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩০-এর মহামন্দার পর কেইনসীয় অর্থনীতি এবং ব্রেটন উডস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একইভাবে, বর্তমান সংকট আমাদের একটি ন্যায্য ও টেকসই অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায় বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অস্থিরতা একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিফলন। মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ, ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় প্রচলিত অর্থনৈতিক মডেল আর কার্যকর নয়। একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি, যা ন্যায্যতা, টেকসইতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এই পরিবর্তনের জন্য সরকার, বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজ এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যদি আমরা এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারি, তবে বিশ্ব অর্থনীতি কেবল স্থিতিশীলতাই অর্জন করবে না, বরং একটি নিরাপদ, সমতাভিত্তিক এবং টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।