ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি কানাডার অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিষয়টি আসন্ন নির্বাচনে ভালোভাবেই প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
Published : 18 Apr 2025, 07:45 PM
কানাডার ৪৫তম জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ২৮ এপ্রিল। যদিও এই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০ অক্টোবর। কিন্তু বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বের প্রতি বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা এবং নিজ দলের নেতাদের বিদ্রোহের কারণে নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটে। ফলে মার্ক কার্নি সংখ্যালঘু সরকারের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিও বিরোধীদের অনাস্থার মুখোমুখি হতে পারেন ভেবে সংসদ ভেঙে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সাল থেকে লিবারেল পার্টি টানা ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে।
কানাডায় সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত। সঙ্গতই সরকার গঠন নির্ভর করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর। ৩৪৩টি আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৭২টি আসন। এটি না পেলে ঝুলন্ত বা সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হয়, যেমনটি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার।
জাস্টিন ট্রুডোর শেষ সময়ে ক্ষমতাসীনদের জনসমর্থন ছিল মাত্র ১৭-১৮ শতাংশ। তবে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রুডোর পদত্যাগ এবং মার্চে মার্ক কার্নির লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। কার্নির নেতৃত্বে লিবারেলদের জনসমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মার্চে সিটি নিউজের একটি জরিপে দেখা যায়, লিবারেলদের সমর্থন ৪০ শতাংশ, আর কনজারভেটিভদের ৩৭ শতাংশ।
ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কানাডার প্রতি বাণিজ্যিক হুমকি ও কার্নির দৃঢ় প্রতিক্রিয়া এই পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে কার্নির কঠোর অবস্থান গ্রহণ কানাডিয়ানদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে আসা মার্ক কার্নি রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন না। ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপক। করোনাকালে এবং তার আগে তিনি যথাক্রমে কানাডা ও যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে সংকট মোকাবেলা করে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন।
এবারের নির্বাচনে ৬টি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে; ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি, প্রধান বিরোধীদল কনজারভেটিভ পার্টি, নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ব্লক কুইবেকওয়া (প্রদেশ ভিত্তিক আঞ্চলিক দল), গ্রিন পার্টি ও পিপলস পার্টি। তবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত ক্ষমতাসীন লিবারেল ও বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে।
এবারের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যে ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে সেগুলো হচ্ছে; ১) জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তি সম্পদের ব্যবহার, ২) জীবনযাত্রার ব্যয়, ৩) প্রতিরক্ষা খাত, ৪) বৈদেশিক নীতি, ৫) সরকারের ব্যয় হ্রাস, ৬) স্বাস্থ্য সেবা, ৭) আবাসন সংকট, ৮) অভিবাসন, ৯, অবকাঠামো উন্নয়ন ও ১০) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও শুল্ক সমস্যার সমাধান বা বিকল্প ভাবনা। এই দশটি বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবারের নির্বাচনে।
ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি (মধ্য-বাম) সামাজিক খাতে যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বলছে। সহনীয় কর ব্যবস্থাপনা তথা ধনীদের ওপর তুলনামূলকভাবে অধিক কর আরোপের পক্ষে তারা। অভিবাসন-বান্ধব সামাজিক নীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা কার্বন ট্যাক্স প্রয়োগের পক্ষে, সমলিঙ্গ বিবাহ, নারীর অধিকার ইত্যাদির জোরাল সমর্থক।
বিরোধী রক্ষণশীল দলের রাজনৈতিক অবস্থান মধ্য-ডান। তারা ছোট সরকার ও কম করের পক্ষে। ব্যবসা-বান্ধব অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি সহজ করার পক্ষে। তাদের অভিবাসন নীতি তুলনামূলকভাবে কঠোর। কার্বন ট্যাক্সবিরোধী, তার পরিবর্তে তারা প্রযুক্তিভিত্তিক জলবায়ু নীতি-ব্যবস্থার পক্ষে। আধুনিকতার সমন্বয়ে ঐতিহ্যবাহী সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষাকে তারা অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি অনেকটা বাম ধারার রাজনৈতিক দল। তারা ধনীদের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপ করার পক্ষে, এছাড়া সম্পদ কর, বৃহৎ শিল্প ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। অধিক সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক, যেমন সর্বজনীন ঔষধ সেবা, সুলভ আবাসন ব্যবস্থা তাদের প্রধান সামাজিক নীতি। সামাজিক ন্যায়বিচার, আদিবাসীদের জীবনমান উন্নতি, এলজিবিটিকিউ ও শ্রমিক অধিকারের পক্ষে। প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব শক্তিশালী নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করা তাদের প্রধান নীতি।
নির্বাচনের আর মাত্র দশ দিন বাকি থাকলেও দলগুলো এখনো আনুষ্ঠিানিকভাবে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেনি। তবে শীঘ্রই তা ভোটারদের হাতে পৌঁছাবে। ইশতেহার ভোটারদের প্রভাবিত করতে ভূমিকা রাখে। এখানে শুধু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিলেই হয় না, সেই প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে, ওই অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে, কোথায় কীভাবে খরচ হবে, তা বাস্তবায়নের রূপরেখাসহ বিস্তারিত জানাতে হয়। শুধু এটা করব, ওটা করব বললেই হয় না।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পরিবর্তন এই নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ডনাল্ড ট্রাম্প কানাডাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ হিসেবে গণ্য করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, যা কানাডিয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ট্রাম্পের এই নীতি মোকাবেলায় কানাডার উপযুক্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন। অনেকে মনে করেন, মার্ক কার্নি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি।
মার্চ মাসে ন্যানোস রিসার্চের জরিপে দেখা যায়, ৩৬% ভোটার ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে ভোটের প্রধান প্রভাবক হিসেবে বিবেচনা করছেন, আর ২৯% অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি কানাডার অর্থনীতি ও বাণিজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই বিষয়টি ভোটে ভালোভাবেই প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা ‘কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস’ (সিএসআইএস) দাবি করেছে, চীন ও ভারত এই নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করতে পারে। ‘ফেডারেল ইলেকশন ওয়াচডগ’ জানিয়েছে, চীনের একটি গ্রুপ মার্ক কার্নির পক্ষে উইচ্যাটের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, কনজারভেটিভ নেতা পিয়েরে পলিয়েভের পক্ষে ভারত জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যদিও পলিয়েভ এটি অস্বীকার করেছেন। কানাডার নিরাপত্তা সংস্থা এই হস্তক্ষেপ রোধে সতর্ক রয়েছে।
নির্বাচনকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের জরিপের ফলাফল প্রকাশ করছে। এসব জরিপে লিবারাল ও কনজারভেটিভদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিবিসি-এর বিশ্লেষণে লিবারেলদের সমর্থন ৪৪ শতাংশ, কনজারভেটিভদের ৩৬.৯ শতাংশ। এতে দেখানো হয়েছে লিবারেলরা ২০১টি আসন নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে, আর কনজারভেটিভরা পেতে পারে ১১৬টি আসন। টরন্টো স্টারের জরিপ অনুসারে, লিবারেল ৪২ শতাংশ ও ১৮১ আসন, কনজারভেটিভ ৪০ শতাংশ ও ১৩০ আসন পেতে পারে। ন্যানোস রিসার্চের জরিপ অনুযায়ী, লিবারাল ৪৫ শতাংশ, কনজারভেটিভ ৪৪ শতাংশ সমর্থন পেতে পারে। কানাডার আরেক প্রভাবশালী মিডিয়া সিটিভি ও গ্লোবাল মেইলের জরিপে লিবারাল ৪৪.৮ শতাংশ, কনজারভেটিভ ৩৭.৮ শতাংশ, এবং ৫০ শতাংশ ভোটার কার্নিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করেন।
লিবারেল ও কনজারভেটিভদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। কানাডায় নির্বাচনের পূর্বে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বিতর্ক জনমত নির্ধারণে প্রভাব রাখে। গত ১৬ ও ১৭ এপ্রিল ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের মাঠে বিরোধী পলিয়েভ প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হলেও বিতর্কে ততটা ছিলেন না। বিতর্কের পর তাৎক্ষণিক জরিপে দেখা যায়, লিবারেলদের সমর্থন কিছুটা কমেছে। টরন্টো স্টারের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে, লিবারেল ৪২.৪ শতাংশ ও ১৭৭ আসন, কনজারভেটিভ ৪০.২ শতাংশ ও ১৩০ আসন পেতে পারে।
বিতর্কের মূল বিষয় ছিল কানাডার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক, বাণিজ্য যুদ্ধ, জীবনযাত্রার ব্যয়, জ্বালানি, জলবায়ু, সার্বভৌমত্ব, অভিবাসন ও বৈদেশিক নীতি। গুরুত্বপূর্ণ ওই বিতর্ককে চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও মাঠের হাওয়া ও জনমত লিবারেলদের পক্ষে স্থিতিশীল, তবে ২৮ এপ্রিলই চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ হবে কোন দল ক্ষমতায় আসছে এবং কে হচ্ছেন এই বৈশ্বিক বাণিজ্যিক ঝড়ে কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী— মার্ক কার্নি না পিয়েরে পলিয়েভ?