সোশ্যাল মিডিয়াকে সংবাদের সূত্র হিসেবে না নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরে ঘটনাস্থলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
Published : 19 Apr 2025, 04:16 PM
রাজশাহীতে পেঁয়াজচাষির আত্মহত্যা নিয়ে পরপর দুদিন দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই সংবাদ দুটির শিরোনাম ছিল, “রাজশাহীতে পেঁয়াজচাষির আত্মহত্যা: নেটিজেনরা ‘ধুয়ে দিচ্ছে’ পরিবারকে, বাস্তবতা ভিন্ন” এবং “পেঁয়াজচাষির মৃত্যু: ‘ফেসবুক গল্পের’ উৎস খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এল যে ঘটনা”। এই ঘটনার মূল উৎস কয়েকজন তরুণের ধারণ করা টিকটকের ভিডিও, যেখানে দেখা যায়, একজন বৃদ্ধ রেললাইনে ট্রেনের নিচে আত্মহত্যা করেছেন।
গত সপ্তাহের শেষের দিকে দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত খবর দুটির তথ্য অনুযায়ী, প্রথমে একজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী ভিডিওটির একটি স্ক্রিনশটসহ একটি পোস্ট আপলোড করেন। এরপর ওই একই টেক্সটের পোস্ট অনেকে শেয়ার করেন। কেউ স্ক্রিনশট দিয়েছেন, কেউ টিকটক ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। মূল পোস্টে লেখা ছিল: ‘ওই বৃদ্ধের স্ত্রী আট মাস আগে মারা যান। এরপর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে কিছুদিন বাবাকে রাখার পর আর রাখতে চাননি। এ নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়। এমনও রাত গেছে, বৃদ্ধ সারা রাত উঠানে ছিলেন, ছেলেরা দরজা খোলেনি। মৃত্যুর দিন সকালে দুই ছেলের বউয়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয় এবং তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে ছেলেরা, তার জিনিসপত্র উঠানে ফেলে দেয়। এরপর স্টেশনে ভোর থেকে বসেছিলেন। দুপুর পর্যন্ত কিছু খাননি। পরে আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গেছে।’
ভাইরাল হওয়া পোস্ট থেকে ধারণা করা যায়, পারিবারিক অশান্তি ও স্ত্রীহীন একাকীত্বের কারণে বৃদ্ধ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। ঘটনাটি আবেগপ্রবণ এবং আমাদের সমাজের পরিচিত চিত্রের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়।
পোস্টটির সত্যতা যাচাইয়ে একজন সংবাদপত্রের প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারেন, ভাইরাল পোস্টটি পুরোপুরি একটি বানানো গল্প! আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির নাম মীর রুহুল আমিন, বয়স ৭০ বছর। তিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার মাঝপাড়া বাউসা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একজন পেঁয়াজচাষি। তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম এখনো জীবিত এবং তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা চাকরি ও বিয়ের কারণে অন্যত্র থাকেন। বাউসা গ্রামের বাড়িতে কেবল এই বৃদ্ধ দম্পতি বসবাস করতেন।
পারিবারিক, স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে প্রতিবেদক জানতে পারেন, পেঁয়াজ চাষের জন্য মীর রুহুল আমিন একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে তাকে মোটা অঙ্কের কিস্তি পরিশোধ করতে হতো। এবার পেঁয়াজের ফলন খারাপ এবং দাম কম হওয়ায় ঋণ শোধ করতে না পারার দুশ্চিন্তায় তিনি হতাশায় ভুগছিলেন। গত ১৫-২০ দিন ধরে তিনি কথাও কম বলছিলেন। এই কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে পরিবারের ধারণা।
এই ঘটনাটি নতুন মিডিয়ার অবাধ তথ্যপ্রবাহের একটি বাস্তব চিত্র। মূলধারার সাংবাদিকতায় আমরা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা, পক্ষপাতিত্ব, সাংবাদিকের তথ্য অনুসন্ধানের দক্ষতা, সংবাদকক্ষের পণ্য হিসেবে সংবাদ এবং সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব নিয়ে সমালোচনা করে আসছি। তথ্যপ্রবাহ যখন একমুখী থেকে দ্বিমুখী হয়, অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাবে পাঠক এবং দর্শকরাও তথ্যপ্রদানকারী হয়ে ওঠেন, তখন আমরা উৎফুল্ল হয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, তথ্য এখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত হয়েছে।
কিন্তু তথ্য কী আসলেই উন্মুক্ত হয়েছে? নাকি এক ধরনের পক্ষপাত থেকে আরেক ধরনের পক্ষপাতের মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে? সাংবাদিকতা শাস্ত্রে, যুদ্ধক্ষেত্রে সংযুক্ত সাংবাদিকতা (জার্নালিজম অব অ্যাটাচমেন্ট) নামে এক ধরনের সাংবাদিকতার প্রচলন ছিল। ১৯৯০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ায় যুগোস্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডার সংঘর্ষের কাভারেজ প্রসঙ্গে বিবিসির যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা মার্টিন বেল এই ধারণার কথা বলেছিলেন। সংযুক্ত সাংবাদিকতা হলো ঘটনার পাশাপাশি সাংবাদিকের নিজস্ব বোঝাপড়া ও আবেগীয় প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা। এতে সাংবাদিকের ‘আত্মবাদী দৃষ্টিভঙ্গি’ প্রতিফলিত হওয়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীতে ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের সময় ‘এমবেডেড সাংবাদিকতা’ নামে আরেকটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এতে গণমাধ্যমগুলো মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিক পাঠাত, আর সাংবাদিকরা সামরিক বাহিনীর দেওয়া রিপোর্টই সংবাদ হিসেবে পাঠাতেন। এই সংবাদগুলোকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে অভিহিত করায় এটিও সমালোচনার মুখে পড়ে।
বর্তমান তথ্যবহুল সমাজে তথ্য জানার পরিমণ্ডলে সংযুক্ত বা এমবেডেড সাংবাদিকতার চেয়ে ভিন্ন কোনো বৈশিষ্ট্য কি আমরা দেখছি? উপরন্তু সাংবাদিকের বা প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এখন তথ্যে ‘আমিত্বের’ ছোঁয়া পাওয়া যাচ্ছে।
মানুষের মনস্তত্ত্বের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো সমর্থনমূলক পক্ষপাত (কনফার্মেশন বায়াস)। অর্থাৎ আমরা যা পূর্ব থেকেই বিশ্বাস করি, নিজের মধ্যে ধারণ করি, ওই তথ্যগুলোই আমরা দেখার চেষ্টা করি। আর আমাদের পূর্ব বিশ্বাসের বিপরীত তথ্যগুলোকে উপেক্ষা করি বা এড়িয়ে যাই। এই ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। তবে ১৯৬০-এর দশকে মনোবিজ্ঞানী পিটার ক্যাথকার্ট ওয়াসনের গবেষণার মাধ্যমে এটা কাঠামোগত রূপ পায়। তিনি দেখান, মানুষের মধ্যে এমন তথ্যই খুঁজে পাবার প্রবণতা কাজ করে যা তাদের বিদ্যমান বিশ্বাসকে নিশ্চিত করে।
পেঁয়াজচাষির আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর বানানো গল্প এই মানসিকতারই প্রতিফলন। টিকটকের ভিডিও দেখে প্রথম ব্যবহারকারী নিজের বিশ্বাসের ভিত্তিতে গল্পটি রচনা করেন। আর এই পোস্টটা তাদের কাছেই পৌঁছেছে, যারা এই ব্যক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। ওই একই বিশ্বাসধারণকারীরা কোনো ধরনের সত্যতা যাচাই ছাড়াই পোস্টটা শেয়ার করেন। ফলে এটা বলাই যায় যে, তথ্যে এখন ‘আমিত্বের’ প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।
এই তথ্যবিভ্রাট সমাজে অরাজকতার পরিবেশ তৈরি করছে। এই মনস্তত্ত্বের কারণে আমরা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষের প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়ছি। সোশ্যাল মিডিয়া এই প্রাচীন মানসিকতাকে আরও শক্তিশালী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেইসবুক ব্যবহারকারীরা বিপরীত মতের ব্যক্তিদের ব্লক, মিউট বা আনফ্রেন্ড করতে পারেন। এমনকি তাদের ওয়ালে শুধু তাদের পছন্দের বিজ্ঞাপনই দেখা যায়। এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া একটি ‘ফিল্টার বাবল’ তৈরি করেছে, যেখানে ব্যক্তির পছন্দ অনুযায়ী তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পৌঁছে যায়।
এর ফলে শুধু ভ্রান্ত তথ্য ছড়াচ্ছে না, সমাজে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন বাড়ছে। পেঁয়াজচাষির আত্মহত্যার এই ঘটনা বর্তমান সাংবাদিকতার জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ। সোশ্যাল মিডিয়াকে সংবাদের সূত্র হিসেবে না নিয়ে তথ্য অনুসন্ধানের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রথমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরে ঘটনাস্থলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পাঠক ও দর্শকদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানো সম্ভব।