আমাদের জন্য ছেলের রেখে যাওয়া প্রিয় কুকুর লায়লাকে ত্যাগ করা ছিল কঠিন। আবার আমরা এমন কিছুই করতে চাইনি যা আমাদের ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আমাকে ভালো করে জানতে হয়েছিল ধর্মীয় বিধানে কুকুর নিয়ে কি বলা আছে?
Published : 19 Apr 2025, 08:34 PM
কুকুর ও পাখি দুটি প্রাণীই এক সৃষ্টিকর্তার তৈরি। পাখি আকাশে উড়তে পারে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কুকুরকে পাখা দেননি বলে সে উড়তে পারে না। তাই বলে পাখিকে ভালোবাসব আর কুকুরকে ঘৃণা করব?
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ঈদ নিয়ে যে কার্টুনটা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন, সে কার্টুনটিতে একটা পাখির ছবিও আছে। আকাশ উড়া পাখির চেয়ে মাটিতে থাকা কুকুর আমাদের নিকট প্রতিবেশী। অথচ কার্টুনে কুকুরের ছবি থাকায় জামায়াতের আমির ফেইসবুকে লিখলেন, ‘ঈদের মত একটি পবিত্র ইবাদাতকেও কটাক্ষ’ করা হয়েছে। তার প্রশ্ন ‘ঈদ শুভেচ্ছা কার্টুনে কুকুরের ছবি’ এ কেমন অদ্ভুত আচরণ?' কার্টুনটা প্রকাশের জন্য ‘প্রথম আলো’কে ক্ষমা চেয়ে সেটি প্রত্যাহারের দাবিও করেছেন জামায়াতের আমির।
এরই মধ্যে জামায়াতের আমিরের এই প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু তার ওই পোস্ট যে একই সঙ্গে আমাদের দেশে কুকুর নিয়ে বহুকালের বৈরিতাকেও উসকে দিয়েছে, তা বলাবাহুল্য।সর্বোপরি তার রয়েছে অনুগত অনেক অনুসারী।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন একটি দেশে বাস করি, যে দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালে ‘কে ভালো মুসলমান’ তা যাচাই করতে গিয়ে পাকিস্তানিরা তিরিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। বাঙালিদের ওপর রীতিমতন জাতিগত নিধন চালানো হয়েছে। লক্ষ প্রাণের বিনিমিয়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে এখনও সর্বপ্রাণের প্রতি সবার ভালোবাসা দেখতে পাই না। অবশ্য কথাটা এমন ঢালাওভাবে বলাও ঠিক নয়, নতুন প্রজন্মের অনেককেই পথের কুকুর-বিড়ালের প্রতি যত্নশীল হতে দেখছি আজকাল। তারা পাখির জন্য বাসা তৈরি করে দেওয়া, খাবার জোগানোর কাজ করছে স্বেচ্ছাশ্রমে এবং নিজস্ব অর্থায়নে। তবে তাদের সংখ্যাটা এখনও খুব বেশি নয় বলে অনুমান করা যায়।
দেশে থাকতে দেখতাম, বেশির ভাগ লোকই কুকুর দেখলে ঠ্যাঙাত। কত কত কুকুরকে দেখতাম পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরছে খাবারের সন্ধানে। অনেক কথা বলা হতো কুকুরকে নিয়ে– নাপাক, নোংরা, স্পর্শ লাগলে নামাজ হবে না। ধর্মের দোহাই দিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হতো যেন কুকুরকে দয়া দেখানো, করুণা করা বা পোষা প্রাণী হিসেবে রাখা– সবই ধর্মবিরোধী কাজ। বেশিরভাগ লোকই এখনও এগুলোকে যাচাই-বাছাই করার কোনো প্রয়োজনবোধ করেন না। বরং কেউ কেউ কুকুর নিয়ে কুসংস্কারগুলোকে সর্বব্যাপ্ত করার কাজে নেমে পড়েছেন।
কুকুর নিয়ে এই সব সংস্কার এমনিতেই হয়নি। কুকুর থাকে আমাদের খুব কাছে, বাড়ির উঠোনে, ঘরের বারান্দায় এবং বাড়ির কাছের রাস্তায়। সারাক্ষণ খাবার ও পানীয়ের জন্য বিরক্ত করতে থাকে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ লোকের এমন কোনো উদ্বৃত্ত খাবার থাকে না যে নিজেরা খেয়ে বাড়তিটুকু কুকুরকে দেবে। এককালে অনেক পরিবারে দেখেছি ভাতের ফেন কাকে দেওয়া হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে হতো, উঠোনের কুকুরটাকে, না অভুক্ত যে ভিক্ষাপ্রার্থী ‘একটু ফেন হলেও দিবেন গো মা, বড্ড খুদা লাগছে’ বলে কান্না করছে তাকে। মানুষের এই অপারগতার সঙ্গে ধর্মের দোহাই যুক্ত করে দেওয়ায় নিষ্ঠুরতা বেড়েছে। মানুষ বিরক্ত হয়ে কুকুরকে আঘাত করত, দিনে দিনে জীর্ণ কুকুরগুলো জীর্ণতর হতো। কুকুরদের প্রতি মানুষের অন্যায় আচরণের জন্যই আমরা বাংলাদেশে অনেক ‘পাগলা কুকুর’ দেখি, যারা মানসিকভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, অনেক সময় মানুষকে কামড়ও দেয়।
কুকুর নিয়ে আমার নিজের ভাবনাও খুব আলাদা ছিল না। তবে আমার ভাবনা আমূল বদলে দিয়েছে ফাহিমের মৃত্যু। ফাহিম সালেহ বাংলাদেশে একটি পরিচিত নাম। সে 'হেকহাউস' কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশে স্টার্টআপ টেকনোলজির বুনিয়াদ রচনা করেছিল। অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং, কুরিয়ার, লজিস্টিকস, খাবার ডেলিভারি সেবাদানকারী কোম্পানি ‘পাঠাও’ ওর হাতেই যাত্রারম্ভ করেছিল। ফাহিমকে ম্যানহাটনে তার নিজের বাসায় হত্যা করে এক ঘাতক। ফাহিম সেই ঘাতককে তার কোম্পানিতে একটা চাকরি দিয়েছিল যেন সে তার দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। বিনিময়ে সে ফাহিমের চার শত হাজার ডলার চুরি করে ফাহিমকে সরিয়ে দিল এই সুন্দর পৃথিবী থেকে। আমি অকাল প্রয়াত এই ফাহিমের দুর্ভাগা পিতা।
ফাহিমকে যখন নিজের বাসভবনে হত্যা করা হয়, তখন তার বাসায় ছিল তারই পোষা ছোট্ট কুকুর, নাম লায়লা। লায়লার তখন বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। আমি ও ফাহিমের মা রায়হানা সন্তান হারানোর বেদনায় উদ্ভ্রান্ত। আমাদের উদ্ভ্রান্ত জীবনে এসে যোগ দিল ছোট্ট কুকুর লায়লা। দুই মাসের ছোট্ট লায়লাকে আমাদের কাছে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না।
ফাহিমের লায়লা এখন আমাদের পাহারাদার। কখনও কখনও আমার পথপ্রদর্শক। আমার বাসার আশপাশে কোনো আগন্তুককে দেখলে সে ঘেউ ঘেউ করে। কোনোভাবে আমাদের বাসার মূল দরজা খোলা থাকলে, সে বসে পাহারা দেয়, নয়তো চিৎকার করে আমাদেরকে জানান দেয়। সবচেয়ে বড় কথা সে আমাকে সকাল-বিকাল পথ দেখিয়ে হাটতে সাহায্য, যার জন্য আমি আমার অনেকগুলো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। অনেক অন্ধকে আমি দেখেছি পোষা কুকুরের সাহায্যে পথ চলতে। কুকুর কখনও কখনও আক্ষরিক অর্থেই অন্ধের ষষ্টি হিসেবে গণ্য হয়।
লায়লাকে ঘরে রাখার অনেক আগেই, বাংলাদেশ থেকে কুকুর নিয়ে যে সংস্কারগুলো নিয়ে এসেছি, সেগুলো ফাহিমের মা ও আমাকে বিচলিত করেছিল। আমাদের জন্য ছেলের রেখে যাওয়া প্রিয় কুকুর লায়লাকে ত্যাগ করা ছিল কঠিন। আবার আমরা এমন কিছুই করতে চাইনি যা আমাদের ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আমাকে ভালো করে জানতে হয়েছিল ধর্মীয় বিধানে কুকুর নিয়ে কি বলা আছে? আমি আমার কয়জন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম। সবার মুখে দেশ থেকে নিয়ে আসা সংস্কারগুলোর পুনরাবৃত্তি শুনতে পেলাম, কুকুর নাপাক, নোংরা, পোশাক-আশাকে স্পর্শ লাগলে নামাজ হবে না ইত্যাদি পুরানো কথা। ইমাম সাহেরাও খুব দৃঢ় কোনো উপদেশ দিতে পারলেন না।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নিজেই পবিত্র কোরানের অনুবাদ পুরোটা পড়ব এবং রসুল (স:) এই নিয়ে কি বলেছেন জানতে চেষ্টা করব। এর বাইরে অন্য কারা কি বলেছেন বা বলছেন তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি পবিত্র কোরান শরিফের অনুবাদ পুরোটা পড়লাম, বেশ কয়েক দিন সময় লাগল পড়তে।
আমি কুকুর নিয়ে কিছু ঘটনার কথা পেলাম কোরান শরিফে। কোরানের সুরা কাহাফে আল্লাহতালা বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলেছেন। এর মধ্যে একটি আসহাবে কাহাফের ঘটনা। এই ঘটনার নামেই মূলত সুরাটির নাম রাখা হয়। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কুকুরের বীরোচিত ভূমিকার কথাও কোরানে আলোচিত হয়েছে। আরবি ‘আসহাবুল কাহাফ’ শব্দের অর্থ গুহাবাসী। পবিত্র কোরানে এমন একদল যুবককে আসহাবুল কাহাফ বলা হয়েছে, যারা একজন খোদাদ্রোহী অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে বাঁচতে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আল্লাহ তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় সুরক্ষা দেন এবং ৩০০ বছর পর্যন্ত ঘুমন্ত অবস্থায় রাখেন। সুরা কাহাফের ১৪টি আয়াতে আসহাবে কাহাফের আলোচনা এসেছে। সেই আলোচনায় যুবকদের সংখ্যা এবং তারা কত দিন সেই গুহায় ঘুমিয়ে ছিলেন তা এসেছে। তবে ঘটনাটি কখন ঘটেছিল এবং কোথায় ঘটেছিল— এ ব্যাপারে কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। আসহাবে কাহাফের ঘটনায় কুকুরটির কথা মোট চারবার এসেছে। যেমন, এক আয়াতে আল্লাহতালা বলেন, ‘তুমি মনে করবে— তারা সজাগ, অথচ তারা ছিল ঘুমন্ত, আমি তাদের ডানে-বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম। আর তাদের কুকুরটি গুহার দরজার সামনে তার সামনের পা দুটি প্রসারিত করে ছিল। তুমি যদি তাদের দেখতে, তাহলে অবশ্যই পেছন ফিরে পালিয়ে যেতে, আর অবশ্যই আতঙ্কিত হয়ে পড়তে।’
মহান আল্লাহ গুহামুখের যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, তাতে কুকুরের পা ছড়িয়ে বসে থাকা ছিল অন্যতম। এরপর আসহাবে কাহাফে আরও তিনবার কুকুরটির কথা এসেছে। যেমন, আল্লাহতালা বলেছেন, কিছু লোক বলবে, তারা ছিল তিনজন, চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আর কিছু লোক বলবে, তারা ছিল পাঁচজন, ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর, অজানা বিষয়ে সন্দেহপূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে। আবার কিছু লোক বলবে, তারা ছিল সাতজন, আর অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর।
বোখারী শরিফের এক হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহতালা একজন ব্যাভিচারী ইহুদি নারীকে ক্ষমা করে তার জন্য বেহেশতে বরাদ্দ করেছিলেন, কারণ তিনি একটি মুমূর্ষু কুকুরকে কুয়া থেকে পানি এনে খাইয়েছিলেন। অন্য একটা হাদিসে কি কি কারণে কুকুর পোষা যায় সেই নির্দেশিকা দেয়া হয়েছে, যেমন: ঘর পাহারা ও শিকারের প্রয়োজনে। এইসব নিয়ে নানান জন নানা মতবাদ ছড়িয়েছেন, অনেকেই বিনা কারণে বিতর্ক ছড়িয়েছেন। কুকুরের লালা সম্পর্কেও অনেক কথা বলা হয়েছে। কুকুরের লালা অবশ্যই বর্জনীয়, যেমন যে কোনো প্রাণীর বর্জ্যই বর্জনীয়।
আমি সৌভাগ্যবান আমি কোরান শরিফটা পড়েছিলাম। আমি অনেক কিছু শিখেছি, আমাদের ধর্ম যে কত উদার। এরপর লায়লাকে আমাদের কাছে রাখতে আমার আর কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়নি। অন্যদের কথা শুনে ফাহিমের আদরের লায়লাকে রাস্তায় ছেড়ে দিইনি তার জন্য আমি গর্বিত।
আমাদের ধর্ম এত পরিষ্কার করে আমাদেরকে এইসব বিষয়ে পথ দেখিয়েছে, তবু আমরা কেন এত কলহ করি? সুরা কাহাফেই আল্লাহতালা বলেছেন, ‘এই কোরানে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমা দিয়েছি, তবু মানুষ অধিকাংশ বিষয়ে কলহপ্রিয়।’
কুকুর খুবই পরিষ্কার প্রাণী, যেহেতু ওদের গায়ে ঘাম হয় না ওদের গায়ে কোনো গন্ধ নেই। ঘরে চোর ডাকাত ঢুকলে প্রথমেই আপনার কুকুর টের পাবে। সমাজের উপকারে আমরা কতভাবে যে কুকুরকে ব্যবহার করি। লুকানো বোমা খুঁজে পেতে, কোথায় ড্রাগ আছে খুঁজে বের করতে পুলিশ বাহিনী সবসময় কুকুর ব্যবহার করে থাকে।
আমাদের দেশে বেশিরভাগ কুকুর বাড়ির বারিন্দায়, উঠানে বা রাস্তায় থাকে। আমরা যদি ওদেরকে একটু খাবার দিই, পানি দিই এবং ওদেরকে কোনো অত্যাচার না করি তাহলে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের ওপর খুশি হবেন। আমাদের রসুলের একটা প্রিয় বিড়াল ছিল নাম ‘মুয়েজ্জা’। বিড়াল, কুকুর, হরিণ, শালিক, ফড়িং, দোয়েল– ওরা সব প্রজাতিই আল্লাহতালার তৈরি জীব। আমরা কেন কুকুরদেরকে ঘৃণা করব, কেনইবা তাদেরকে অবজ্ঞা করব?
২০২৫ সালের বইমেলায় উপস্থিত থাকব বলে ঢাকায় গিয়েছিলাম এবার। একদিন সন্ধ্যার দিকে মেলা থেকে বেরিয়ে গাড়ি কোথায় খোঁজ করছিলাম। ফুটপাতে দেখলাম একজন যুবক চাটাই বিছিয়ে গেঞ্জি, রুমাল এইসব কি কি যেন বিক্রি করছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা নেড়ি কুকুর এসে তার পাশে দাঁড়াল, কুকুরটার পিঠে লাল দগদগে একটা ঘা। যুবকটি একটা অয়েমেন্টের টিউব বের করে কুকুরটার পিঠের ঘায়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা আজকে আর পাবি না, তিন বার হইয়া গেছে, কাল আবার দিব।’ ফুটপাতের অল্প আলোতেও আমি স্পষ্ট দেখলাম, কী মমতা ফুটপাতের একটা দোকানদারের, পথের একটা কুকুরের প্রতি। আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে লোকটার দিকে কতক্ষণ চেয়ে রইলাম, তিনি তখন আবার তার খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
আরও পড়ুন