দিনের বেলা বার বার হাই তোলা মানে ঘুম কম হয়েছে। যা থেকে দীর্ঘমেয়াদে নানান রোগ হতে পারে।
Published : 19 Apr 2025, 03:42 PM
হাই তুলছেন সারাক্ষণ? ঘুম ঘুম-ভাব কাটাতে গিয়ে দিনের মধ্যভাগের পরে তিন-চার কাপ চা-কফি পান করা হয়ে যাচ্ছে, তারপরও কমছে না হাই তোলা- এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে সাংঘাতিক রকমের ঘুমের অভাব ঘটছে।
আর এই অবস্থা থেকে দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ স্লিপ মেডিসিন (এএএসএম)’য়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, মায়ো ক্লিনিক’য়ের স্লিপ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং পুলমনোলজিস্ট (ফুসফুস রোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. এরিক ওলসন এই বিষয়ে সিএনএন ডটকম’কে বলেন, “বিস্তৃত পরিসরে নিদ্রাহীনতা একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ নিউরোলজি’, ‘দি ন্যাশনাল সেফটি কাউন্সিল’ এবং ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান’সহ ২৫টি চিকিৎসা-বিষয়ক প্রতিষ্ঠান এই প্র্রকাশনাকে অনুমোদন দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “রাতে ভালো ঘুমের পাশাপাশি অন্তত পক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা না ঘুমালে ডায়াবেটিস, বিষণ্নতা, হৃদ ও বৃক্কের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। আর এই রোগগুলো হয়ে থাকলে আরও বাজে হতে পারে পরিস্থিতি।
অনেকেই মনে করেন, একঘেয়ে মিটিংয়ের কারণে অফিসে ঘুম লাগতেই পারে।
তবে শিকাগো’র ‘নর্দানওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি’স ফাইনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিন’য়ের স্নায়ুবিদ্যা ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টেন নুটসন বলেন, “রাতে ভালো মতো পর্যাপ্ত ঘুম হলে, মিটিং যতই একঘেয়ে লাগুক, কখনই ঘুম আসবে না। দিনের বেলা ঝিমুনিও লাগবে না।”
এই অধ্যাপক আরও বলেন, “দিনে অতিরিক্ত ঘুম লাগা ও কাজের গতি কমে যাওয়া হতে পারে লুক্কায়িত শারীরিক সমস্যার লক্ষণ।”
যদি কারও এমন হয়, তবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।
গোপন বিপদ
“সব সময় ঘুম ঘুম-ভাব কাজ করলে দেহ অদ্ভূত সব কাজ করতে শুরু করে। যেমন- বার বার হাই তোলা, এর মানে হতে পারে অপর্যাপ্ত ঘুম হওয়ার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন”- মন্তব্য করেন ‘এএএসএম’য়ের পরিচালন পর্ষদের সদস্য এবং এই প্রকাশনার আরেক প্রণেতা ডা. ইন্দিরা গুরুভগভাতুলা।
তিনি বলেন, “মস্তিষ্কের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা নানান পরীক্ষা করেছি। যেমন- মনে করার ক্ষমতা, প্রতিক্রিয়ার সময়, সমন্বয় সাধন ইত্যাদি। দেখা গেছে তারা প্রচুর ভুল করছে। আর ঘুমের অভাবের কারণে এমন হওয়াটা তারা মেনেও নিয়েছে।”
সব সময় ঘুমের অভাবে থাকলে মস্তিষ্ক নিজে থেকেই ‘মিনি ন্যাপ’ বা অল্প ঘুম দিয়ে নেয়। সেটা হতে পারে দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড কিংবা ১০ সেকেন্ডর ‘মাইক্রোস্লিপস’ বা ক্ষুদ্র ঘুম।
ডা. গুরুভগভাতুলা বলেন, “এই ক্ষুদ্র ঘুমের পরই মস্তিষ্ক হঠাৎ জেগে ওঠে, আর সেটা হয়ত আপনি টেরই পান না। আর এটা হতে পারে খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে এমন হলে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি থাকেই।”
তাই নিরাপত্তার জন্য নিজের ঘুমের ধরন সম্পর্কে নজর রাখার পরামর্শ দেন এই গবেষক। কারণ এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় এক লাখ গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে চালকের তন্দ্রাচ্ছন্নতার জন্য।
ঘুমের পরীক্ষা
“দিনের ঘুম ঘুম-ভাব বিপৎসীমা অতিক্রম করছে কি-না সেটা বোঝার জন্য রয়েছে ‘এপওর্থ স্লিপনেস স্কেল’- বলেন ডা. গুরুভগভাতুলা।
এই পদ্ধতিতে প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে- দুপুরের খাবার পর চুপচাপ বসে থাকার সময় অ্যালকোহল সেবন না করেও ঘুম পায় কিনা, দুপুরে শোয়া হয় কিনা, জনবহুল জায়গায় চুপচাপ বসে থাকা, বসে বই পড়া, বসে কারও সঙ্গে গল্প করা, গাড়িতে যাত্রী হয়ে ঘণ্টা খানেক ভ্রমণ করা, গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক সিগনালে আটকে থাকা এবং টেলিভিশন দেখা।
এসব কাজের মধ্যে কোনগুলোতে ঘুম পেয়েছে- সেই হিসেবে শূন্য থেকে তিন পর্যন্ত নম্বর দিতে বলা হয় রোগীদের।
ডা. গুরুভগভাতুলা বলেন, “দেখা গেছে বেশিরভাগের নম্বর এসেছে ২৪, যা কিনা অনেক অনেক ঘুম পাওয়ার মাত্রা নির্দেশ করে। আমরা সাধারণত ১০ হলেই চিকিৎসার জন্য যোগ্য হিসেবে ধরে নেই।”
ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসা, দেহ ভেঙে ঘুম আসা, জেগে থাকতে সমস্যা এবং অনেকে ভার্টিগো, মাথা ঘোরা, হাত কাঁপাসহ মারাত্মক-সব লক্ষণ অনুভব করেন। এমনকি অনেকে বেপরোয়া ও আবেগপ্রবণ আচরণও করেন।
তন্দ্রাভাবের অন্যান্য কারণ
স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের মধ্যে বারবার শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ ও খোলা), ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা, ‘রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম’ বা পা কামড়ানোর জন্য ঘুম না হওয়া এবং ‘সার্কাডিয়ান রিদম স্লিপ ডিজঅর্ডার’ বা দেহঘড়ির ছন্দের পতন, দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে দেওয়া ওষুধের প্রতিক্রিয়া থেকেও দিনের বেলা ঘুম ঘুমভাব কাজ করতে পারে।
তাই ডা. গুরুভগভাতুলা এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন।
এছাড়া জীবনযাত্রার নানান অভ্যাসের কারণেও দীর্ঘমেয়াদে তন্দ্রচ্ছন্নতা কাজ করতে পারে।
যেমন- অতিরিক্ত ক্যাফিন গ্রহণ, ঘুমের আগে মদ বা অন্য কোনো নেশা করা, ব্যায়ামের মাত্রা এবং বাজে ঘুমের অভ্যাস চালিয়ে যাওয়া।
এই অভ্যাসের মধ্যে থাকতে পারে- উজ্জ্বল আলোতে ঘুমানো, অতিরিক্ত গরম বা ঠাণ্ডা কিংবা কোলহলমুখর ঘরে থাকা- এসব অবশ্য ঘুমের ওপর বাজে প্রভাব ফেলে।
অনেকে মনে করেন অ্যালকোহল-সহ নানান নেশা দ্রব্য গ্রহণে ভালো ঘুম হয়। তবে ব্যাপারটা ঘটে উল্টো।
ডা. গুরুভগভাতুলা বলেন, “নেশার ফলে অযাচিত ঘুম বেশি হয়। ফলে ঘুমিয়ে পড়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। আর পরদিন ক্লান্তির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যা সার্বিকভাবে ঘুমের মান কমায়।”
আরও পড়ুন
স্লিপ অ্যাপনিয়া’তে ভোগার অদ্ভুত ৫ লক্ষণ