সমালোচকদের বিচারে অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাদেশের শীর্ষ কবিদের সারিতেই থাকবে তার নাম।
Published : 13 Dec 2024, 04:29 PM
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। এই পৃথিবীর প্রেম আর সব যুদ্ধ সাঙ্গ করে কবি হেলাল হাফিজ স্থায়ী হলেন কবিতার পৃথিবীতে।
সমালোচকদের বিচারে অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, জনপ্রিয়তার বিচারে বাংলাদেশের শীর্ষ কবিদের সারিতেই থাকবে তার নাম।
অকৃতদার কবির বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। জীবনের শেষ দিনগুলো তার কাটছিল ঢাকার শাহবাগের সুপার হোম নামের এক হোস্টেলে।
শুক্রবার দুপুরে বাথরুমে পড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। পাশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বিএসএমএমইউ পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে কবিকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তার আগেই তার মৃত্যু হয়।
"উনাকে কয়েকজন ব্যক্তি নিয়ে আসেন মৃত অবস্থায়। উনারা পরিবারের সদস্য নন, ওনার হোস্টেলের প্রতিবেশী হতে পারে। বিষয়টি আমি শাহবাগ থানার ওসিকে জানিয়েছি। সে অনুযায়ী, ওনারা দ্রুত এসে প্রয়োজনীয় ফরমালিটিজ সারবেন।”
হেলাল হাফিজের সঙ্গে একই হোস্টেলের অন্য একটি কক্ষে থাকতেন রূপম রোদ্দর। গত তিন বছর ধরে তিনিই হেলাল হাফিজের দেখভাল করতেন বলে জানালেন।
রূপম বলেন, "উনি তো বিগত কয়েক বছর ধরেই একাকীত্বে ভুগছিলেন। শারীরিকভাবেও কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। হাঁটাচলা ঠিকমত করতে পারতেন না। আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বলেছি। উনি হাসপাতালে থাকতে চাইতেন না।
"আজ দুপুরের দিকে বাথরুমে পড়ে যান। পরে হোস্টেলের লোকজন উনাকে হাসপাতালে আনেন। চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।"
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এক বার্তায় বলেছেন, “কবি হেলাল হাফিজ তারুণ্যের শক্তি ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ। তার কালজয়ী কবিতার মতই তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে। তার মৃত্যুতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।”
সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এক শোকবার্তায় বলেন, “মাত্র অল্প কিছু কবিতা দিয়েই হেলাল হাফিজ বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবিদের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তার অবদান জাতি সবসময় স্মরণ করবে।”
হেলাল হাফিজের ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা’ থেকে উদ্ধৃত করে ফারুকী বলেন, “সেই কথা রাখা হয়নি বলেই জুলাই চব্বিশে রচিত হয়েছে সাহসের কবিতা।”
কবির বড় ভাই দুলাল হাফিজ জানান, হেলাল হাফিজের শেষ শয্যা হবে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
শনিবার সমাহিত করার আগে বেলা ১১টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাদ জোহর জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে তার জানাজা হবে।
দ্রোহকালের পঙক্তি
দ্রোহ আর প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর, নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার বড়তলী গ্রামে। শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কেটেছে নিজের শহরেই।
১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। উত্তাল ষাটের দশক হয়ে ওঠে তার কবিতার উপকরণ।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় রচিত ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। তার কবিতা হয়ে ওঠে মিছিলের স্লোগান।
‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কালজয়ী কবিতার এ লাইন দুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পরবর্তীতে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ও কবিতাটি মানুষের মাঝে তুমুল সাড়া জাগায়।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কবিকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর বইটির ৩৩টির বেশি সংস্করণ বেরিয়েছে। দীর্ঘসময় নিজেকে অনেকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়েছিলেন হেলাল হাফিজ।
আড়াই দশক পর ২০১২ সালে তিনি পাঠকদের জন্য আনেন দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় ও সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।
খুব কম লিখেছেন হেলাল হাফিজ। তবে তার কবিতা যেমন হয়ে উঠেছিল মিছিলের স্লোগান, তেমনই আবার হয়ে উঠেছিল প্রেমের চিঠির অনুষঙ্গ। কবিতা যে বই ছাড়াও কার্ড হয়ে বের হতে পারে, তাও দেখা যায় হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রে।
২০২২ সালের ৮ অক্টোবর কবির ৭৪তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আনন্দ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছিল, হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
সেই অনুষ্ঠানে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, যে কবিতা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে, তেমন কবিতাই তিনি লিখতে চেয়েছেন বরাবর।
“সত্তুর-আশির দশকে যেদিন বইমেলা শেষ হত। তার পরদিন কোনো কবিতার কথা শোনা যেত না। কোনো পঙক্তির কথা শোনা যেত না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, খুব কম লিখব। বইয়ের সংখ্যা কম হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি এমন কাব্য প্রকাশ করে যেতে চাই, মেলা যেদিন শেষ হবে কবিতার আয়ু সেদিন শেষ হয়ে যাবে না।
“এমন একটি কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতে চাই, যেটি এক থেকে অনেক মেলা পর্যন্ত এর আয়ু দীর্ঘায়ু হবে। মানুষ স্মরণে রাখবে। মানুষ তার মনে এবং মগজে সেই বইয়ের স্মৃতি লালন করবে।”
৭৬ বছরের জীবনে কবি হেলাল হাফিজ রেখে গেছেন কেবল তিনটি বই। প্রথম বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ প্রকাশের সময় নিজের ভেতরে কী ঘটেছিল, সে কথাও ওই অনুষ্ঠানে বলেন তিনি।
“১৭ বছর লেখালেখি করে প্রায় ১ বছর ধরে ৫/৬শ কবিতা থেকে ৫৬টি কবিতা বাছাই করে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। এই বইটি প্রথমে অন্য এক নামে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেই নামটি আমার মনঃপূত ছিল না। আমারই দেওয়া নাম, কিন্তু খুব অতৃপ্তি ছিল। খুব খুঁতখুঁতে লাগছিল নিজের কাছে। সেজন্য বই ছাপা হয়ে যাওয়ার পরেও আমার রয়্যালিটির টাকা থেকে প্রকাশককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামে বইটি প্রকাশ করেছিলাম।”
কবির ভাষায়, “আমরা ওহি নাযিলের কথা বলি। বিশ্বাস করুন- আমার মনে হয়, এই নামটি আমার কাছে ওহি নাযিল হয়েছিল। যেদিন নামটি আমার মগজে আসল, সেদিনের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।”
বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য হেলাল হাফিজ রেখে গেছেন নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, দুঃসময়ে আমার যৌবন, অস্ত্র সমর্পণ, বেদনা বোনের মতো, ইচ্ছে ছিল, নিখুঁত স্ট্রাটেজি, দুঃখের আরেক নাম, প্রত্যাবর্তন, অশ্লীল সভ্যতা, কবিতার কসম খেলাম, উপসংহার, সম্প্রদান, একটি পতাকা পেলে, কবি ও কবিতা, ফেরিওয়ালা, অমীমাংসিতর মত অসামান্য সব কবিতা।
কবিতায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে হেলাল হাফিজকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়াও যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), নেত্রকোণা সাহিত্য পরিষদের কবি খালেকদাদ চৌধুরী পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
কবিতার জন্য জীবন কাটিয়ে দেওয়া হেলাল হাফিজ পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা।
১৯৭২ সালে দৈনিক পূর্বদেশে সাংবাদিকতা শুরু করেন হেলাল হাফিজ। পূর্বদেশ ও দৈনিক দেশ পত্রিকায় তিনি সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল দৈনিক যুগান্তর।
বোহেমিয়ান একজীবন
বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক তিনিও কবিতা লিখতেন, আর মা কোকিলা বেগম ছিলেন গৃহিণী।
মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান কবি। বাবাই তখন জীবনের অবলম্বন। স্ত্রী বিয়োগের পর আবার বিয়ে করেন খোরশেদ আলী তালুকদার। দুই ঘর মিলিয়ে চার ভাই তিন বোন হেলাল হাফিজরা।
২০২২ সালের সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হেলাল হাফিজ স্মরণ করেন তার শৈশবের কথা, মাতৃবিয়োগের পরের দিনগুলোর কথা।
“আমি যেদিন মাতৃহীন হই, আমি বুঝতেই পারিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বেদনাটুকু অনুভব করতে পারিনি। কোনো স্মৃতি নেই। যে যাতনা আমাকে পোহাতে হল, তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
“যত দিন গিয়েছে, একটু একটু করে বড় হয়েছি। বয়স বেড়েছে। মাতৃহীনতার বেদনা আমাকে আমূল গ্রাস করেছে। সেই সব শৈশব-কৈশোর ও প্রথম যৌবনে আমি ছিলাম খেলাধুলার মানুষ। যতই বয়স বাড়তে লাগলো, মাতৃহীনতার এই বেদনা আমাকে গ্রাস করে ফেলল।”
খেলাধুলা দিয়ে সেই বেদনাকে প্রশমিত করতে না পেরে লেখালেখিতে যুক্ত হয়েছেন জানিয়ে হেলাল হাফিজ বলেন, “সেই লেখালেখির জীবন নিতান্ত কম নয়। ৭৫ বছরের (তখনকার বয়স) একটি জীবন পেয়েছি। খুব কম মানুষ এতটা পায়। কিন্তু এই দীর্ঘ জীবন আমি পুরোটা কাজে লাগাতে পারিনি। কিছু জীবন অপচয় করে ফেলেছি। খুব কম লিখেছি জীবনে, কিন্তু জীবন খরচ করে লিখেছি।”
১৯৭৩ সালে বাবাও চিরবিদায় নিলে একা হয়ে যান হেলাল হাফিজ। এই জগৎসংসার তখন তার তুচ্ছ মনে হয়। বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর প্রেমিকা হেলেনের সঙ্গেও কবির বিচ্ছেদ হয়।
একদিন হেলেন তাকে ডেকে বলেন, “আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।”
সেদিনের কথা স্মরণ করে হেলাল হাফিজ এক লেখায় বলেছিলেন, “ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে …চলে এলাম।”
তবে পরপর দুটি ঘটনা ভেতরে-ভেতরে এলোমেলো করে দেয় হেলাল হাফিজকে। প্রস্থান কবিতায় তিনি লেখেন–
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!
হেলাল হাফিজের জীবনকে কী বলা যায়? বোহেমিয়ান? না কাবির জীবন?।
সবার কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা কবির জীবন এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে কার্যত প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক। সকালের নাস্তা থেকে রাতের খাবার– সব প্রেসক্লাব ক্যান্টিনেই হত।
এক দশকের বেশি সময় তিনি রাত্রিযাপন করেছেন হোটেলে। ২০২০ সালে যখন কোভিড মহামারী শুরু হল, তার আগে তিনি সেগুনবাগিচায় কর্ণফুলী হোটেলে থাকতেন।
মহামারীর শুরুতে লকডাউনের বিধিনিষেধ আরোপ হলে প্রেসক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কষ্টে পড়ে যান কবি।
বড় ভাই দুলাল আবদুল হাফিজ তখন কবিকে নিয়ে যান তার ইস্কাটনের বাসায়। কিন্তু পরিস্থিতি একটু ভালো হলে আবার হোটেলে ফিরে যান তিনি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে নানা জটিলতা। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ আর গ্লুকোমা কঠিন করে তোলে হেলাল হাফিজের জীবনকে। কয়েকবার হাসপাতালেও যেতে হয়।
হোটেল ছেড়ে এক সময় হেলাল হাফিজ ওঠেন শাহবাগের ‘সুপার হোম’ নামের এক হোস্টেলে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে তাকে ফের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। পরের মাসে হাসপাতাল ছেড়ে হোস্টেলে ফিরে দেখেন, সিট আর খালি নেই।
তাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন তরুণ কবি ইসমত শিল্পী। সেগুনবাগিচায় নিজের বাসায় নিয়ে রাখেন।
কিন্তু অসুস্থ কবিকে দেখে রাখা, নিয়ম করে ওষুধ দেওয়া একা শিল্পীর জন্য ছিল কঠিন। তিন সপ্তাহ পর হেলাল হাফিজ তার পুরনো ঠিকানা সুপার হোমের একাকী জীবনে ফিরে যান।
এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি বলেছিলেন, পরিবারের সবাই সব সময় তার খোঁজ রাখে, বোনরা একটু বেশি রাখে। তবে নিঃসঙ্গতা আর নির্জনতা তার ভালো লাগে। হোটেলবাসের একাকীত্বের বেদনা তিনি ‘উপভোগ’ করেন।
পৃথক পাহাড় কবিতায় হেলাল হাফিজ লিখেছেন–
কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।
ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।
আমি আর কতোটুকু পারি?
এর বেশি পারেনি মানুষ।
কবিতার সেই বিশ্বাস যে নিজের জীবনেও ব্রত করে নিয়েছিলেন, সে কথা ২০২২ সালের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন কবি।
হেলাল হাফিজ সেদিন বলেন, “আপনাদের ভালোবাসা-আদর-সম্মান আমাকে ঘাস থেকে, তৃণ থেকে উদ্ভিদে রূপান্তরিত করেছে। আমি নত হই, আমি নত চিত্তে কেবলই নত হতে শিখেছি। নত হতে চাই, নত হতে চাই।”
সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে কবি বলেছিলেন, “আমি যাপিত জীবনের সিংহকাল কবিতার জন্য ব্যয় করেছি। কবিতাপ্রেমী মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি- সেটা অভূতপূর্ব, অতুলনীয়।
“আমি চেয়েছিলাম আমার কবিতা দিয়ে অর্থ নয়, বিত্ত নয়, আমি মানুষ জমাতে চাই। সেই মানুষ জমাতে গিয়ে জীবনের যে দারুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি, তাও আমার জীবনের অপঠিত ইতিহাস হয়ে আছে। কবিতা আমাকে অনেক দিয়েছে। এই ঋণ জীবদ্দশায় পরিশোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।”