সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করা হবে না বলে জানিয়েছেন এনবিআরের সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান।
Published : 19 Apr 2025, 01:39 AM
নিজেদের বাজার বাড়াতে দেশীয় মিলগুলোর চাপে স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ হওয়ায় রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
বাজার সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বিশেষ করে নিট খাতের অপেক্ষাকৃত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারাই মূলত স্বল্প ক্রয়াদেশের বিপরীতে কম দামে ভারত থেকে সুতা আনেন স্থলপথে।
তাছাড়া স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধ হওয়ায় দেশীয় মিলগুলোর ‘সিন্ডিকেট’ শক্তিশালী হওয়ার শঙ্কার কথা বলছেন কেউ কেউ।
স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানিতে এনবিআরের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার আশ্বাস পাওয়ার দাবি করেছেন ব্যবসায়ীদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা।
তবে কর আদায়কারী সংস্থাটির সদস্য (নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “কোনো রিভিউ হচ্ছে না।”
ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ বন্ধ করে গত মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৯ অগাস্ট একটি প্রজ্ঞাপনের আওতায় কাস্টমস বন্ড লাইসেন্স আছে এমন শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি করতে পারত; বাকিদের ক্ষেত্রে তখনও সুতা আমদানি বন্ধ ছিল।
নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবার জন্য একই বিধান হল; অর্থাৎ এখন থেকে কেউ এসব স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি করতে পারবে না।
অন্যসব বন্দর দিয়ে আগে থেকেই সুতা আমদানি নিষিদ্ধ ছিল; ভারত থেকে মূলত বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা, বুড়িমারী দিয়ে সুতা আমদানি হত।
উচ্চ কাউন্টের সুতা আসার অভিযোগ
বাংলাদেশে সুতার সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত। আমদানির পাশাপাশি দেশীয় মিলের মাধ্যমে সুতার প্রয়োজন মেটায় তারা।
তৈরি পোশাক খাতে ব্যবহৃত সুতার সর্বোচ্চ কাউন্ট হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২। কোন ধরনের কাপড় তৈরি বা কোন কাজে ব্যবহৃত হবে তার উপর নির্ভর করে সুতার মান নির্ণয়ের মাধ্যম হয় সুতার কাউন্ট সংখ্যা গণনা।
সুতার সংখ্যা ধরা হয় সর্বোচ্চ ১০০। সংখ্যার উপর সুতার ওজন ও মান নির্ভর করে। সংখ্যা যত বেশি হবে ওজন তত বেশি ও সুতা মোটা হবে।
দেশীয় বস্ত্রকলগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর চাওয়ায় ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য সুতার বড় একটি অংশ আসে ভারত থেকে। বেনাপল বন্দর দিয়ে মূলত সবচেয়ে বেশি সুতা আমদানি করত বাংলাদেশ।
ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করতেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। এরপর সেখান থেকে সুতা স্থলপথে বাংলাদেশ পাঠানো হত।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে আসা এসব সুতার দাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আসা সুতার দামের চেয়ে কম হত। আর কম দামে সুতা আসায় দেশীয় বস্ত্রকলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিটিএমএ অভিযোগ করে আসছিল।
স্থল পথে সুতা আমদানি বন্ধ করতে দুটি কারণ দেখিয়েছে বিটিএমএ।
প্রথমটি হচ্ছে দেশীয় মিলগুলোর সুরক্ষা; দ্বিতীয়টি হচ্ছে কম কাউন্টের সুতার নামে ৬০ কাউন্ট এমনকি ৮০ কাউন্টের সুতা আমদানি হচ্ছে, যদিও উচ্চ কাউন্টের সুতা তৈরি পোশাক খাতে ব্যবহৃত হয় না। সেসব সুতা আসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহারের জন্য।
তৈরি পোশাক খাত সুতা আমদানিতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা পায়। অর্থাৎ রপ্তানির কাজে আমদানি হওয়া এসব সুতা আমদানি শুল্ক মুক্ত (ডিউটি ফ্রি)। শুধু কাস্টমস চার্জ পরিশোধ করতে হয়।
বিটিএমএ বিরোধিতার আরেকটি কারণ দেখিয়েছে। তারা বলছে, ‘এলসি ঘোষণার চেয়ে বেশি পরিমাণে’ সুতা দেশের বাজারে প্রবেশ করায় সরকার ও দেশীয় মিলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সরকারি ও বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরে সুতা আমদানির পরিমাণও বেড়েছে বাংলাদেশে।
বিটিএমএ এর তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে গত বছর ১২ লাখ ১৫ হাজার টন সুতা আমদানি করে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে আমদানি ছিল ৯ লাখ ২৪ হাজার টন।
অন্যদিকে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশটি বাংলাদেশে মোট ১৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের সুতা রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে তা ৩৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে সুতা এসেছিল ৯৭ কোটি ১৬ লাখ ডলারের। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ২৯৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলারের সুতা আমদানি করে।
ভারত থেকে গত বছর সুতা আমদানি বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের বস্ত্রখাতে প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরেন বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি ফারুক হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার বস্ত্রখাতে প্রণোদনা চার শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করায় সুতার দরের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যায় দেশীয় মিলগুলোর। আবার গ্যাসের দামও বেড়েছে কয়েক দফায়। সে কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।”
এছাড়া বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। ফলে চাহিদার কারণে ভারত থেকে সুতা আমদানি বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভিন্ন যুক্তি উদ্যোক্তাদের
তৈরি পোশাক খাতের জন্য তুলা আমদানি করে সুতা বানায় বস্ত্র ও নিটিং মিলগুলো। দেশের চাহিদার বেশিরভাগ তুলা আসে ভারত থেকে। নিজেদের উৎপাদিত তুলার পাশাপাশি তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান থেকে সংগ্রহ করা তুলাও বাংলাদেশে রপ্তানি করে ভারত।
স্থল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে সুতা রপ্তানি ভারত ২০১১ সালে বন্ধ করেছিল। পরে ভারতের ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় স্থলবন্দর দিয়ে সুতা রপ্তানি পুনরায় চালু করা হয় বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাদেশের মিলগুলোর চেয়ে কেজিতে ৩০ সেন্ট (স্থানী মুদ্রায় ৩৬ টাকা ৬০ পয়সা) কম দামে সুতা দিতে পারেন ভারতে ব্যবসায়ীরা।
এ কারণে উদ্যোক্তরা ভারত থেকে সুতা আমদানিতে আগ্রহী হন বলে বিকেএমইএ সভাপতি ও এমবি নিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেমের ভাষ্য।
“আমার একটি লটে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কম পাই। তাহলে কেন আমদানি করব না। আমার তো প্রতিযোগিতা করেই ব্যবসা করতে হবে,” বলেন এই ব্যবসায়ী।
দেশীয় মিলগুলো সেই দামে সুতা দিতে পারলে ‘কিনতে আপত্তি নেই’ বলে মন্তব্য করেন হাতেম।
তিনি বলেন, “সুতার বেশিরভাগ আসে সমুদ্র পথে। সেখানে কোনো অভিযোগ নেই। দেশীয় মিলগুলোর চেয়ে কম দামে সুতা পাই। অথচ দেশীয় মিলগুলো কম দামে সুতা দেওয়ার কথা, তারা সক্ষমতা বাড়াক।”
বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশেনের উপদেষ্টা মোহাম্মদ আয়ুব হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে তুলা হয় না। পুরোটাই আমদানি করতে হয়। ভারতের নিজস্ব তুলা আছে, তাদের গ্যাসের দামও কম। তাদের উৎপাদন খরচ বেশি হয় না বলেই কম দামে দিতে পারে। বাংলাদেশে তো পরিবহন খরচের সঙ্গে উৎপাদন খরচও বেশি।”
সুতার দাম যে সব সময় বেশি হয়, তেমনও নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “নিত্যপণ্যের মত সুতার দামও ওঠানামা করে। চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে, কমলে সুতার দাম কমে যায়। সারা বছরের গড় করলে দেখা যায়, দামে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। ১০ থেকে ২০ সেন্ট পার্থক্য হয়।”
দেশে পোশাক রপ্তানি খাতে ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের কোম্পানি রয়েছে। সংখ্যার দিক দিয়ে ছোট ও মাঝারি কোম্পানির সংখ্যাই বেশি।
ক্রেতারা খুব কম সময়ে পণ্য চেয়ে যেসব ক্রয়াদেশ দেয়, তা সাধারণত সংখ্যায়ও কম হয়। এসব ক্রয়াদেশ নেয় মূলত ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো।
কোন কারখানা কত দ্রুত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে, অর্থাৎ ব্যবসায়িক ভাষায় লিড টাইম কত কম হবে, প্রতিযোগিতাটা সেখানেই।
এসব ক্রয়াদেশ পেয়ে দ্রুত ভারত থেকে সড়কপথে চাহিদামত স্বল্প পরিমাণে সুতা আমদানি করে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো।
ট্রাকে ৭-৮ টন সুতাও আমদানির সুযোগ রয়েছে স্থলবন্দর দিয়ে। এতে ব্যাংক থেকে এলসি পাওয়া যায় দ্রুত এবং উদ্যোক্তাদের অর্থায়নও কম লাগে।
স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তে এসব কোম্পানিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করনে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছোটরাই তো মাঝারি হয়, তারপরে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আজকের বড় বড় কোম্পানি তো এক সময় ছোট ছিল। এখন ছোট ও মাঝারিদের সমস্যা বাড়ল, তাদের তো প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমল, লিড টাইম কমল।”
সরকারের সিদ্ধান্তে এখন সুতার পুরোটাই সমুদ্র ও আকাশ পথে আনতে হবে। সমুদ্র পথে আনার খরচ কিছুটা কম হলেও পরিমাণে বেশি আনতে হয়। তাতে অর্থায়ন বেশি লাগে, তেমনি সময়ও বেশি প্রয়োজন হয়।
মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “লিড টাইম কমে যাওয়া মানেই ক্রেতারা হিসাব করে দেখবে যে, বাংলাদেশ কত সময়ে দিতে পারবে। তারচেয়ে কম সময়ে কেউ দিতে পারলে অর্ডার তার কাছেই যাবে। এভাবে রপ্তানি আদেশের একটি অংশ তো হাতছাড়া হতে পারে।”
স্থলবন্দর দিয়ে কী সমস্যা
স্থলপথে আমদানির সময় সুতার মান পরিমাপ করার কোনো যন্ত্র নেই কোনো বন্দরে। বিকেএমইএ এর উদ্যোগে বছর কয়েক আগে সুতার কাউন্ট মাপার যন্ত্র দেওয়া হয়েছিল। সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। এই সুযোগে এলসির ঘোষণার চেয়ে উচ্চ কাউন্টের সুতা আসছে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “সুতা পরিমাপ করা নিয়ে সমস্যা হলে বিকেএমইএ কাউন্টিং মেশিন কিনে দেবে। স্থলবন্দর সেই মেশিন দিয়ে তো সুতা মেপে দেখতে পারবে কত কাউন্টের সুতা এল। তাহলে তো সমস্যা থাকে না। কিন্তু আমদানি বন্ধ করা তো সমস্যার সমাধান নয়।”
সমুদ্রপথে যদি সুতা আনা যায়, তাহলে স্থলপথেও সুযোগ খোলা রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের বিকল্প অপশন খোলা রাখতে হবে। একাধিক অপশন থাকা দরকার আমদানিতে।”
বিটিএমএ এর ভাষ্য, বেনাপোল বন্দর দিয়ে আসা সুতার দাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে আসা সুতার দামের চেয়ে কম হয়। এই যুক্তি দেখিয়ে চিঠি দেওয়া হয় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকেও।
এর প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সকল স্থল বন্দরকে চিঠি দিয়ে বলে, চীন, তুরস্ক, উজবেকিস্তান এবং দেশে উৎপাদিত সুতার দাম প্রায় একই রকম হলেও স্থলবন্দর দিয়ে আসা ভারতীয় সুতার দাম অনেক কম থাকে।
অর্থাৎ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা সুতা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ঘোষিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে আসে। এতে দেশের সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ‘প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না’।
বক্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করেও বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেলকে পাওয়া যায়নি। এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেওয়া হলেও তার সাড়া মেলেনি।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন হামিমুর রহমান ওয়ালীউল্লাহ]
পুরনো খবর