স্থপতি, শিল্পী, শিক্ষক, রাজনীতিক আর স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা থেকে শুরু করে ২০২৩ সালে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ; অসংখ্য পাওয়ার ভিড়ে সময়ের স্রোতে হারানো সেই মুখগুলো একঝলকে।
Published : 31 Dec 2023, 01:09 PM
এই তো কদিন আগে, জেগেছিল কিছু প্রাণ কোটি প্রাণের ভিড়ে সগৌরবে; এখন আর নেই। থেমে গেছে কোলাহল, চলে গেছে অনন্তলোকে, তবুও সেই কথা-সুর-গান আজও কানে ভাসে।
নিজ কর্ম দিয়ে যারা জগতে আলো ছড়ান, বুদ্ধিদীপ্ত মনন দিয়ে হন সমাজ বিনির্মাণের কারিগর, ভাস্বর হয়ে ওঠেন মানবমনে, তারা চিরস্মরণীয়।
চলতি বছর এমনই প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে অনেক; জাতি অপূরণীয় ক্ষতি আর শোকের সাগরে ভাসলেও তাদের ছড়ানো দ্যুতিই সঞ্চার করছে নতুন প্রাণের, নতুন ভবিষ্যতের।
স্থপতি, শিল্পী, শিক্ষক, রাজনীতিক আর স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধা থেকে শুরু করে ২০২৩ সালে অনেক গুণীজনকে হারিয়েছে দেশ। অসংখ্য পাওয়ার ভিড়ে সময়ের স্রোতে হারানো সেই মুখগুলো দেখে নেওয়া যাক একপলক।
মোবাশ্বের হোসেন
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর গত ২ জানুয়ারি প্রাণ হারান দেশের স্থাপত্য, ক্রীড়া, পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনের অগ্রপথিক মোবাশ্বের হোসেন।
তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এই স্থপতি দেশের বেশ কয়েকটি আলোচিত স্থাপনার কাজ করেছেন। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের কমনওয়েলথ অ্যাসোসিয়েশন অব আর্কিটেক্টস এবং আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল, এশিয়ার (আর্কেশিয়া) প্রেসিডেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক এই সভাপতি সম্মিলিত ক্রীড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরিবেশ ও নাগরিক আন্দোলনে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহ-সভাপতিও ছিলেন মোবাশ্বের।
সুফিয়া খাতুন
২০২১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে’ গ্রন্থের লেখক, শিক্ষক সুফিয়া খাতুন মারা যান গত ৭ জানুয়ারি।
সমাজসেবাধর্মী নানা কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি, গড়ে তুলেছিলেন প্রাতর্ভ্রমণকারী সঙ্গিনীদের নিয়ে ‘উষা মৈত্রী’ সংগঠন। যুক্ত ছিলেন ‘হেমন্তিকা’ নামের সংগঠনের জন্মপ্রক্রিয়া থেকে। সমমনা আগ্রহী নারীদের সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধাবাস প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে ‘হেমন্তিকা’। দুটি সংগঠনের নামই তার দেওয়া।
হাবিব উল্লাহ খান
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাবিব উল্লাহ খান মারা যান গত ৭ জানুয়ারি। সত্তরের দশকে তথ্যমন্ত্রী এবং আশির দশকে পাটমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন হাবিব। ১৯৭৯ সালে তিনি তৎকালীন কুমিল্লা-৫ (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫) আসন থেকে বিএনপির সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাজুর মুল্লুক
গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুর মুল্লুক মারা যান গত ১৪ জানুয়ারি। স্বৈরাচার বিরোধী ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের রাজপথের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন কৃষক রাজনীতিও করেছিলেন। সবশেষ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন।
আজিজার রহমান
ভাষাসৈনিক জয়পুরহাটের আজিজার রহমান বার্ধক্যজনিত কারণে গত ১৫ জানুয়ারি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৯৫। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন বলে এলাকায় তাকে সবাই চেনে আজিজার ডাক্তার নামে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জয়পুরহাটে যে কয়জন বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তাদের একজন ছিলেন আজিজার।
১৯২৮ সালের ৪ মার্চ নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ঝারঘড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরবতীতে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মহব্বতপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি দেশের অন্যান্য স্থানের মত আক্কেলপুরেও ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে সেখানে তিনি সম্পৃক্ত হন।
পরবর্তীকালে ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, অসহযোগ, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনে সক্রিয় থাকেন এবং ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। ১৯৭১ সালে তিনি যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যান। সেখানে আসাম রাজ্যের তেজপুর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন।
জহুরুল হক
বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত শেরপুরের শ্রীবরদীর বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সী গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা জহুরুল হক মুন্সীই একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি দুইবার ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পেয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর জামালপুর ক্যাম্পে দেড় হাজার পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণের আহ্বান সংবলিত চিঠি পৌঁছাতে গিয়ে তাদের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন জহুরুল হক মুন্সী। তার জন্ম জামালপুরের বকশিগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রাবাজ গ্রামে। পরে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীবরদীতে বসবাস করেন।
মোছলেম উদ্দিন
চট্টগ্রামের চান্দগাঁও-বোয়ালখালী আসনের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা মোছলেম উদ্দিন আহমদ গত ৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৫।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন ২০১৩ সাল থেকেই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক মোছলেম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারির উপ-নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও বোয়ালখালী) আসনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
রেজা আলী
সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী রেজা আলী সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গত ১৩ ফেব্রুয়ারি। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
বিটপী গ্রুপের কর্ণধার রেজা আলী ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ময়মনসিংহ-৭ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বিটপী অ্যাডভার্টাইজিং প্রতিষ্ঠান করেন। এ কোম্পানির মায়া বড়ি, রাজা কনডম ও ওরস্যালাইন এর ক্যাস্পেইন সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা ও জনস্বাস্থ্য খাতে সুদূর প্রসারী প্রভাব রাখে। এছাড়া বাটা, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, কোকাকোলা, রেকিট বেনকিজার, গ্রামীণ ফোনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে সাংস্কৃতিক লোকগাঁথা যুক্ত করার কাজে গভীরভাবে তিনি জড়িত ছিলেন।
বাংলাদেশের অ্যাডভার্টাইজিং শিল্পের অগ্রদূতদের একজন রেজা আলী পরে পোশাক শিল্পের সঙ্গেও যুক্ত হন। মিসামি গার্মেন্টস দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। জাহাজ ভাঙা শিল্পের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৬০ সালে আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক বছর কারাবাস করেন তিনি। প্রাদেশিক সম্মেলনে গঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
আ. রউফ চৌধুরী
আ. রউফ চৌধুরী র্যাংগস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন।
১৯৩৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করা রউফ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) স্লোয়ান স্কুল অব বিজনসের স্নাতক। ১৯৭৯ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। দুটি মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কয়েক বছর রেসিডেন্ট ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর দীর্ঘ ১৫ বছর কাজ করেন যমুনা অয়েল কম্পানিতে।
পরে র্যাংগস গ্রুপ, র্যানকন গ্রুপ ও সি রিসোর্সেস গ্রুপের অধীনে ৫২টি কোম্পানি গড়ে ওঠে রউফ চৌধুরীর নেতৃত্বে। অটোমোবাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, টেলিকম, ইলেকট্রনিক্স, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্যাংক ও বীমাসহ বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে আছে এসব কোম্পানির ব্যবসা।
নাজমুল হুদা
আলোচিত রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার জীবনাবসান হয় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও এক সময়ের তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদা শেষ দিকে দল থেকে ছিটকে পড়ে ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে দল গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছাকাছি আসেন। কয়েক বছরের আইনি লড়াই শেষে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তার দল নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পায়। রাজনীতির পাশাপাশি রাজধানীর ৩৩ তোপখানা রোডে ‘চেন্সারি চেম্বার’ নামে অফিস খুলে আইন সেবা দিতেন নাজমুল হুদা।
মাসুম বাবুল
নৃত্যপরিচালক মাসুম বাবুল মারা যান ৬ মার্চ। মৃত্যুর আগে প্রায় দেড় বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেন তিনি। দীর্ঘ সিনেমা জীবনে তিনি প্রায় দেড় হাজারের বেশি সিনেমার কোরিওগ্রাফার ছিলেন। তিনবার নৃত্য পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
শামীম সিকদার
স্বোপার্জিত স্বাধীনতাসহ অনেক ভাস্কর্যের শিল্পী শামীম সিকদার মারা যান ২১ মার্চ। সিরাজ সিকদারের বোন শামীম সিকদারের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শামীম সিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সাবেক অধ্যাপক।
শামীম সিকদারের জন্ম ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর। তিনি গত শতকের আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা শুরু করেন। অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর ৮ বছর আগে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটি তৈরি করেন শামীম সিকদার। জগন্নাথ হলের সামনে স্বাধীনতার সংগ্রাম ভাস্কর্যটিও তারই করা। ২০০০ সালে একুশে পদক পান তিনি।
খালেদা মনযূর-ই-খুদা
ভাষা সংগ্রামী, লেখক খালেদা মনযূর-ই-খুদা ৮৯ বছর বয়সে গত ২৫ মার্চ প্রয়াত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। খালেদা ফেন্সি খানম নামেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। ড. কুদরত ই খুদার ছেলে মনযুর-ই-খুদাকে বিয়ের পর তিনি খালেদা মনযূর-এ-খুদা নামে পরিচিতি পান।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে তিনি আহত ভাষা সংগ্রামীদের রক্ত দেন। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন মিছিলে তার সরাসরি অংশগ্রহণের ফটোগ্রাফও পাওয়া যায়। বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ‘বিজয়াঙ্গন’ মিউজিয়ামে রাখা একটি ছবিতে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে কালো বই হাতে সাদা শাড়ি পরা ফেন্সি খানমকে জাহানারা ইমামের সঙ্গে দেখা যায়।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বার্তা আসতেই তিনি স্কুলের ইউনিফরম ও জামা দিয়ে জাতীয় পতাকা তৈরি করে পল্টনের আওয়ামী লীগ অফিসে উত্তোলন করেন। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের বেতার ‘শিল্পী’ এবং টেলিভিশনে ‘মহিলা অঙ্গন’ নামে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন তিনি। ওই সময়ে নারীদের জন্য তিনি ‘গৃহিণী শিল্পকলা একাডেমী’ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। ‘চীনকে চিনে এলাম’, ‘সভ্য দেশের বুনো কাহিনী আমেরিকার কাল্ট’, ‘আপন ভুবনে’ তার লেখা বইয়ের মধ্যে কয়েকটি। চলতি বছর সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
নূরে আলম সিদ্দিকী
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সত্তরের দশকের ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী মারা ২৯ মার্চ। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ যে চার ছাত্র নেতাকে সে সময় ‘চার খলিফা’ হিসেবে অভিহিত করা হত তাদের অন্যতম ছিলেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী। মুজিববাহিনীর অন্যতম সংগঠকও ছিলেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-২ আসন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
রোকিয়া আফজাল রহমান
বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যাংক ম্যানেজার, নারী উদ্যোক্তা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রোকিয়া আফজাল রহমান মারা যান গত ৫ এপ্রিল।
দেশের অন্যতম নারী উদ্যোক্তা রোকিয়া আফজাল আরিস হোল্ডিংস, ইমান কোল্ড স্টোরেজেও বিনিয়োগ করেন। তিনি ডেইলি স্টারের মূল কোম্পানি মিডিয়াওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন এবং প্রথম আলোর মূল কোম্পানি মিডিয়া স্টারের পরিচালক ছিলেন।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও এশিয়ান উইম্যান ইউনির্ভাসিটির চেয়ারম্যান ছিলেন রোকিয়া আফজাল। বাংলাদেশ নারী উদ্যোক্তা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ছিলেন কয়েকবার। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সহসভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ব্র্যাক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল, বাংলাদেশ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা যান গত ১১ এপ্রিল। স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
একাত্তরে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিয়োগকারী জাফরুল্লাহর পরে বড় অবদান ছিল জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে কম খরচে দরিদ্রদের চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করায়ও তার অবদান স্মরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শ পাওয়া জাফরুল্লাহ রাজনৈতিক অঙ্গনেও নানা ভূমিকা রেখে চলছিলেন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোকে এক মঞ্চে এনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য
প্রবীণ রাজনীতিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য মারা যান গত ২৩ এপ্রিল। বামপন্থি আদর্শে বিশ্বাসী এ রাজনীতিকের জন্ম ১৯৩৯ সালের অগাস্টে চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।
১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি ও পরে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। পঙ্কজ ভট্টাচার্য মুক্তিযুদ্ধে বাম দলের (ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিটিউনিস্ট পার্টি) গেরিলা বাহিনীর সংগঠক ছিলেন।
ষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সব গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে ‘স্বাধীন বাংলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছাকাছি সেলেই রাখা হয়। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
বাংলাদেশের সব আন্দোলন-রাজনৈতিক পালাবদলের প্রত্যক্ষদর্শী এই রাজনীতিবিদ ১৯৯৩ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। পরে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে দেশের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষের একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। ২০১০ সালে পঙ্কজ ভট্টচার্য ঐক্য ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করেন। সারাজীবন তিনি বাম রাজনীতির আদর্শ নিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় পঙ্কজ ভট্টচার্য এর আত্মজীবনীমূলক বই ‘আমার সেই সব দিন’ প্রকাশিত হয়।
অমল মিত্র
একাত্তরে চট্টগ্রামে যার হাত দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল, সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা অমল মিত্র মারা যান গত ৭ মে। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর এর প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রামে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে যারা প্রতিরোধ সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন, অমল মিত্র তাদের অন্যতম।
নুরুল ইসলাম
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মারা যান গত ৮ মে। পাকিস্তানি আমলে বাঙালি বৈষম্যের চিত্র সামনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা নুরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চেয়ারম্যান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা নুরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটনে বসবাস করছিলেন।
নুরুল ইসলামের কর্মজীবনের শুরু পাকিস্তান ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমি। সংস্থার প্রথম বাঙালি পরিচালক ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিআইডিএস গঠিত হলে তার প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্বও তিনি পালন করেন।
পীযুষ কান্তি চৌধুরী
কক্সবাজারের বিশিষ্টজন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পীযুষ কান্তি চৌধুরী মারা যান গত ১১ মে। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজারের শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে পীযুষ কান্তি চৌধুরী। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরীকে একাত্তরের মে মাসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এরপর ওই সময়ের জেলা সার্কিট হাউজে গণহত্যার শিকার হন জ্ঞানেন্দ্র লাল। তবে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।
পীযুষ কান্তি চৌধুরী কক্সবাজার মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের খ্যাতিমান আইনজীবী, জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিকবার নির্বাচিত সভাপতি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর) কক্সবাজার জেলা শাখার আমৃত্যু সভাপতি, কক্সবাজার স্বরস্বতিবাড়ি মন্দির ট্রাস্টি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
নুরুন্নবী চৌধুরী
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ১২ মে মারা যান চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুন্নবী চৌধুরী। বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ১৯৬২ সালে স্কুলজীবনেই চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৬-৬৭ সালের চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আর যুদ্ধকালীন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জেলা প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মিরসরাইয়ের শুভপুর ব্রিজে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে যে ক’জন যুবক পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন নুরুন্নবী। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন নুরুন্নবী। বাকি জীবনে কোনো সভাসমাবেশেও আর যোগ দেননি।
আকবর হোসেন পাঠান ফারুক
কয়েক বছর অসুস্থতায় ভুগে গত ১৫ মে প্রয়াত হন ঢাকাই সিনেমার ‘মিয়া ভাই’ ফারুক। রক্তে সংক্রমণজনিত জটিলতা নিয়ে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবশেষে ৭৫ বছর বয়সে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাদা-কালো পর্দা থেকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয়, প্রযোজনা ও পরিচালনায় উজ্জ্বল একটি নাম ‘ফারুক’। অভিনয় করেছেন ৬০টির বেশি সিনেমায়।
১৯৪৮ সালের ১৮ অগাস্ট পুরান ঢাকায় তার জন্ম। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। পাঠান পরিবারের এই সন্তানের বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকায়। ছাত্রবয়সেই জড়িয়ে পড়া ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে ধরছিলেন অস্ত্রও। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগেই সিনেমায় নাম লিখিয়েছিলেন এই নায়ক, ‘জলছবি’ নামের সেই সিনেমা মুক্তি পায় একাত্তরে। প্রথম সিনেমাতেও তার নায়িকা ‘সারেং বউ’ কবরী। যে জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজনসখী’ নামে।
সারেং বউ, লাঠিয়াল, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, দিন যায় কথা থাকে, জনতা এক্সপ্রেস, সাহেব, মিয়াভাই, নাগরদোলা, সুজনসখী’, ঘরজামাই, ভাইভাই, বিরাজবৌ এর মত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অনন্য জায়গায় নিজেকে নিয়ে যান খ্যাতিমান এই অভিনেতা। ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান। এছাড়া চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য ২০১৬ সালে এই অভিনেতাকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা।
মোহন খান
পরিচালক, নাট্যকার মোহন খান মারা যান ৩০ মে। ১৯৮৮ সাল থেকে দেশের টেলিভিশন নাটক পরিচালনা ও রচনায় পরিচিতি মুখ মোহন খান। এটিএন বাংলায় অনুষ্ঠান বিভাগেও কাজ করেছেন তিনি।
তার পরিচালিত প্রথম নাটক ‘আমার দুধমা’ প্রচার হয় বিটিভিতে। এছাড়া ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, ‘সেই আমরা’, ‘নীড়ের খোঁজে গাঙচিল’, ‘জেগে উঠো সমুদ্র’, ‘মেঘবালিকা’, ‘দূরের মানুষ’, ‘আঙ্গুর লতা’, ‘হৃদয়পুরের গল্প’সহ আরও অনেক নাটক নির্মাণ করেছেন মোহন খান।
পিয়ারী বেগম
বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর অভিনেত্রী পিয়ারী বেগম মারা যান গত ৩০ মে। পিয়ারী বেগমের স্বামী আমিনুল হকও অভিনেতা ছিলেন। ‘মুখ ও মুখোশ’ সিনেমায় তার বিপরীতেই অভিনয় করেছিলেন পিয়ারী।
আমিনুল হক ২০১১ সালে মারা যান। ইডেন কলেজে পড়া অবস্থায় ওই সিনেমাটিতে অভিনয় করে অন্য কলাকুশলীদের সঙ্গে ইতিহাসে ঠাঁই নেন পিয়ারী। আবদুল জব্বার খান পরিচালিত মুখ ও মুখোশ সিনেমাটি ১৯৫৬ সালের ৩ অগাস্ট প্রথম প্রদর্শিত হয়। এতে প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেন ইনাম আহমেদ ও পূর্ণিমা সেনগুপ্ত। পরিচালক জব্বার খান ছাড়াও অভিনয় করেন জহরত আরা, রহিমা খাতুন, বিলকিস বারি।
আফছারুল আমীন
চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমীন মারা যান ২ জুন। ৭৬ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
পেশায় চিকিৎসক আফছারুল আমীন ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সেবা করে আলোচনায় আসেন। এরপর তিনি পান নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব।
চট্টগ্রাম-১০ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। কাজ করেছেন নৌ মন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও। সবশেষ তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন।
রাজনীতির ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও অবদান রেখেছেন আফছারুল আমীন। নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ‘প্রাণহরি আমীন একাডেমি’। এই একাডেমির অধীনে এবং এর বাইরেও একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
সিরাজুল আলম খান
বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খান মারা যান গত ৯ জুন। কখনও নেতৃত্বে না এলেও তিনি জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।
সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।
মিতা চৌধুরী
খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী মিতা চৌধুরী ২৯ জুন মারা যান। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। তার জন্ম ১৯৫৮ সালের ২২ জানুয়ারি পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে। তার বাবা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আমিনুল হক চৌধুরী।
মেধাবী এই অভিনেত্রী শিক্ষাজীবনেও সফল ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি এইচএসসিতে মেয়েদের মধ্যে মেধাতালিকায় প্রথম এবং সম্মিলিত মেধাতালিকায় অষ্টম হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন।
বিটিভিতে মিতা চৌধুরীর প্রথম নাটক ‘আরেকটি শহর চাই’। প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘শান্ত কুটির’। ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে ‘বরফ গলা নদী’ নাটকটির পর মিতা চৌধুরীর আলাদা অবস্থান তৈরি হয়। ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে মিতা চৌধুরীর চরিত্রের নাম ‘লিলি’।
‘নন্দিত নরকে’ তার অভিনীত আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক। শুধু টিভি নাটকই নয়, মঞ্চে ‘সূচনা’ ও ‘গুড নাইট মা’–এর মত প্রযোজনায় নিজেকে জড়িয়েছেন। ২০১৫ সালে ‘অমানুষ’ নাটকে মামুনুর রশীদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। মিতা চৌধুরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা ‘বিষ’, ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ ও ‘মেড ইন বাংলাদেশ’।
কামাল উদ্দিন আহাম্মদ
আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কামাল উদ্দিন আহাম্মদ মারা যান গত ৪ জুলাই রাতে। ওই মামলা পরিচালনায় কামাল উদ্দিন আহাম্মদের দক্ষতা আলোচিত ছিল। ২০১১ সালের নভেম্বরে অভিযোগ গঠন হওয়া সে মামলার রায় ঘোষণা হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। পরে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ পান কামাল উদ্দিন আহাম্মদ।
রেবেকা মমিন
নেত্রকোণা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন গত ১১ জুলাই মারা যান। বয়স হয়েছিল ৭৬।
টানা তিন মেয়াদে সংসদে মদন-মোহনগঞ্জ-খালিয়াজুরী আসনের ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করা রেবেকা মমিন প্রথমবার এমপি হন ২০০৮ সালের নির্বাচনে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
বুলবুল মহলানবীশ ও আশফাকুর রহমান খান
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ এবং সংগঠক আশফাকুর রহমান খান একই দিনে চিরবিদায় নেন। গত ১৪ জুলাই মারা যান এই দুই গুণি ব্যক্তি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের ঐতিহাসিক ক্ষণে কালজয়ী 'বিজয় নিশান উড়ছে ঐ' গানটিতে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পীদের অন্যতম বুলবুল মহলানবীশ। আশফাকুর রহমান খান ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক।
বুলবুল মহলানবীশের জন্ম ১৯৫৩ সালের ১০ মার্চ। তিনি একাধারে কবি ও লেখক; সংগীত, নাট্য ও আবৃত্তিশিল্পী। টিভি-বেতার-মঞ্চে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনাও করেছেন।
এম এ কুদ্দুস
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সিনিয়র সহসভাপতি ও কার্টুনিস্ট এম এ কুদ্দুস মারা যান গত ১৫ জুলাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদের কার্টুনিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত ছিলেন। পত্রিকায় কার্টুন এঁকে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তার বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়।
মোহাম্মদ আলী
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এ কে মোহাম্মদ আলী গত ২০ জুলাই মারা যান। তার বয়স হয়েছি ৮২।
সিইসি এমএ সাঈদ কমিশনের শেষ সময়ে নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মোহাম্মদ আলী। তিনি ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২০০৬ সালের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালের ২৫ মে আলোচিত সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজ কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরও ইসির নানা সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে আলোচনায় ছিলেন মোহাম্মদ আলী।
পান্না কায়সার
লেখক, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য, শহীদজায়া পান্না কায়সার মারা যান গত ৪ অগাস্ট। পান্না কায়সার ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী। তিনি অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ছিলেন তিনি।
শিশু কিশোরদের সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে আজীবন সক্রিয় ছিলেন পান্না কায়সার। ১৯৭৩ সাল থেকে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য। আর ১৯৯০ সালে এ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদানের জন্য ২০২১ সালে পান্না কায়সারকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
মোহাম্মদ রফিক
ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে খ্যাতি রয়েছে কবি মোহাম্মদ রফিকের। গত ৬ অগাস্ট প্রয়াত হন তিনি।
তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী-বৈটপুর গ্রামে। একুশে পদক ছাড়াও বাংলা একাডেমি পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কারসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি ও পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪২৩-এ সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার পায় মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বই ‘মানব পদাবলি’। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘কপিলা’, ‘খোলা কবিতা, ‘গাওদিয়া’, ‘মানব পদাবলি’, ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
সুলতান মাহমুদ
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান, মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন কিলো ফ্লাইটের অন্যতম সদস্য এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম গত ১৪ অগাস্ট প্রয়াত হন। তার বয়স হয়েছিল ৭৯।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৮১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সুলতান মাহমুদ উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তিনি সামলেছেন। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হাতেগোনা কিছু সরঞ্জাম আর রসদ নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অপারেশন ‘কিলো ফ্লাইটের’ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। তার জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার নিজকুনজরা গ্রামে ১৯৪৪ সালে।
তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমি থেকে কমিশন পান। ১৯৭১ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে করাচির মৌরীপুর বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মে মাসে পালিয়ে শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় পৌঁছান সুলতান মাহমুদ। যুদ্ধে তিনি দুই নম্বর সেক্টর এবং পরে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুলতান মাহমুদের চৌকস অধিনায়কত্বে ‘কিলো ফ্লাইট’ এর মিশনে মুক্তিযুদ্ধের গতি ও বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। দেশাত্মবোধ আর বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই স্কোয়াড্রন লিডারকে পরে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ২০১৮ সালে সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
মতিউর রহমান
ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান প্রয়াত হন গত ২৭ অগাস্ট। বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান দীর্ঘ সময় ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪-২০১৮ সালে টেকনোক্র্যাট কোটায় ধর্মমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ ও ২০০৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবন থেকেই মতিউর রহমান ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে রাজনীতির পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ সময় নগরীর আলমগীর মনসুর মেমোরিয়াল কলেজের (মিন্টু কলেজ) অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কাজী এম বদরুদ্দোজা
কৃষি বিজ্ঞানী কাজী এম বদরুদ্দোজা মারা যান গত ৩০ অগাস্ট। তারবয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
কাজী পেয়ারার জনক হিসেবে খ্যাতি পান বদরুদ্দোজা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে পাকিস্তান কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের পদ ছেড়ে ১৯৭৩ সালে তিনি দেশের কৃষি গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কৃষি গবেষণার সংস্কার, উন্নয়ন ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তার হাত ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি গবেষণার বুনিয়াদ রচিত হয়।
বদরুদ্দোজা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের শীর্ষ পদে দীর্ঘদিন ছিলেন। বাংলাদেশ একাডেমি অব এগ্রিকালচারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন।
এ কৃষি বিজ্ঞানী ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের অধীনে বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট (বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পড়াশোনা করেন। তিনি ধানের বাইরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি দানাদার ফসল চাষ শুরুর ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেন।
আফজাল চৌধুরী
কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী মারা যান ৩১ অগাস্ট। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
১৯৬০ সালে জহির রায়হানের চিঠি পেয়ে ঢাকায় আসেন তার ‘কাচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণের জন্য। এটিই ঢাকায় তার প্রথম চিত্রায়িত চলচ্চিত্র। এরপর ঢাকায় বহু ছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন।
তৎকালীন উভয় পাকিস্তানের প্রথম আংশিক রঙিন ‘গুলে বাঁকালি’ (১৯৬১), প্রথম এক শটের গানের ‘ওয়াফা কি ইয়াদা’, বাংলাদেশের প্রথম ‘লো-কি’ সিনেমাটোগ্রাফি ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ (১৯৬৫), প্রথম ‘ট্রিপল রোল’ এর চলচ্চিত্র ‘জ্বলতে সুরুজ কে নিচে, ১৯৭০/উজ্জ্বল সূর্যের নিচে, ১৯৭৭), প্রথম রাজনৈতিক ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), পাকিস্তানের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘আয়না’ ইত্যাদি ছাড়াও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বহু ছবি চিত্রায়িত হয়েছে তার হাতে।
রাজীব আশরাফ
মাত্র ৩৮ বছর বয়সে গত ১ সেপ্টেম্বর মারা যান 'হোক কলরব' গানের গীতিকার রাজীব আশরাফ।
সংগীত শিল্পী অর্ণবের গাওয়া ‘হোক কলরব’ ছাড়াও ‘ধূসর মেঘ’, ‘ঘুম’, ‘রোদ বলেছে হবে’, ‘একটা মেয়ে’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘মন খারাপের একটা সকাল’, ‘কে আমি’, ‘ইট কাঠ পাথরের’, ‘যখন জোনাক জ্বলে’, ‘নাম ছিল না’, ‘বিভ্রম’ প্রভৃতি রাজীবের লেখা জনপ্রিয় গান।
এ ছাড়া ‘ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই’, ‘এই আমার শহর’, ‘যাযাবর পাখনা’, ‘এই যাত্রার শেষ কোথায় অজানা’, ‘নিঝুম রাতের তারা’, ‘প্রহর’ তাঁর লেখা জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। ‘ধরেছি রহস্যাবৃত মহাকাল’ তার প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ।
চলচ্চিত্রের গানও লিখেছেন রাজীব আশরাফ। রেদওয়ান রনির ‘আইসক্রিম’ ছবিতে অর্ণব গেয়েছেন রাজীবের লেখা ‘বোকা চাঁদ’ গানটি। তার লেখা গান রয়েছে ‘আয়নাবাজি’ চলচ্চিত্রেও। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনচিত্রও বানিয়েছেন।
সোহানুর রহমান সোহান
বহু সফল চলচ্চিত্রের নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান মারা যান ১৩ সেপ্টেম্বর। তিনি চলচ্চিত্র কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিবলি সাদিকের সহকারী হিসেবে। পরে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
সোহানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’। এই নির্মাতার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আসেন সালমান শাহ, মৌসুমী, পপি ও ইরিন জামান। শাকিব খানের মুক্তি পাওয়া প্রথম সিনেমার পরিচালকও ছিলেন তিনি।
সোহানের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হল- ‘বিশ্বাস অবিশ্বাস’, ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’, ‘আমার দেশ আমার প্রেম’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিতে টানা দু’বার মহাসচিব এবং দু’বার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী
খ্যাতিমান নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী মারা যান ১৯ সেপ্টেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
১৯৪৬ সালের ২৬ আগস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নির্মাতা পরিচয়ের বাইরে একজন কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার ও লেখক হিসেবেও তিনি পরিচিত। ১৯৮০ সালে মুক্তি প্রাপ্ত নিজের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঘুড্ডি’ দিয়ে দর্শকদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মনেও জায়গা করে নেন তিনি।
এই ছবির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ ও সুবর্ণা মুস্তাফা। এই ছবিটির শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এরপর ‘লাল বেনারসী’, ‘আয়না বিবির পালা’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন তিনি। ২০২১ সালে একুশে পদক লাভ করেন তিনি।
জিনাত বরকতউল্লাহ
একুশে পদকপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতউল্লাহ মারা যান ২০ সেপ্টেম্বর। বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
জিনাত বরকতউল্লাহর জন্ম ১৯৫২ সালের ৩ অক্টোবর কুমিল্লায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় নৃত্যচর্চার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরি—উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের তিন ধারায় তালিম নিলেও লোকনৃত্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে জিনাত বরকতউল্লাহ যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পারফর্মিং আর্টস একাডেমিতে। পরে তিনি শিল্পকলা একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত প্রোডাকশন বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে জিনাত বরকতউল্লাহ বিটিভির নাটক ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন। এরপর ‘ঘরে বাইরে’, ‘অস্থায়ী নিবাস’, ‘বড় বাড়ি’, ‘কথা বলা ময়না’সহ বেশ কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় করেন তিনি। জিনাত বরকতউল্লাহ নৃত্যশিল্পে অবদানের জন্য ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন।
আব্দুস সাত্তার ভূঞা
সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী উকিল আব্দুস সাত্তার ভূঞা মারা যান ৩০ সেপ্টেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। বিএনপির এমপি হিসেবে পদত্যাগের পর দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন তিনি।
আব্দুস সাত্তার ভূঞা দীর্ঘদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি পদে ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি তৎকালীন কুমিল্লা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ও জুনের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় টেকনোক্রেট মন্ত্রী হিসেবে আবদুস সাত্তার আইন, মৎস্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
এর মধ্যে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির মনোনীত সংসদ সদস্য হিসেবে জয়লাভ করেন। পরে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপির অন্য সংসদ সদস্যদের সঙ্গে তিনিও সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু পরে উপ-নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে সেই নির্বাচনে জয় পেয়ে পুনরায় তিনি সংসদ সদস্য হন।
শাহজাহান কামাল
লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কামাল মারা ৩০ সেপ্টেম্বর। বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনে ও ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন শাহজাহান কামাল।
১৯৭১ সালে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে গণআন্দোলনে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলায় নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৮৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া, ২০১১ সালে তিনি লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শাহজাহান কামাল ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন নোয়াখালী-১১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের এমপি হন।
দশম সংসদে তিনি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ সংসদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আসাদ চৌধুরী
কানাডার একটি হাসপাতালে গত ৫ অক্টোবর মারা যান কবি আসাদ চৌধুরী। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। পরদিন সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।
গত শতকের সত্তরের দশক থেকে কবিতার পাশাপাশি আসাদ চৌধুরী লিখে গেছেন প্রবন্ধ, শিশুতোষ গল্প ও কবিতা, অনুবাদ, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থ। এ পর্যন্ত প্রায় চার ডজন বই প্রকাশিত হয়েছে তার। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক পান তিনি।
তবক দেওয়া পান, জলের মধ্যে লেখাজোখা, মেঘের জুলুম পাখির জুলুম, আমার কবিতা, ভালোবাসার কবিতা, প্রেমের কবিতা, নদীও বিবস্ত্র হয়, বাতাস যেমন পরিচিত, বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই, কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি, ঘরে ফেরা সোজা নয় তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া প্রবন্ধ সংকলন ‘কোন অলকার ফুল’, জীবনীগ্রন্থ ‘সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু’, ‘রজনীকান্ত সেন’, ‘স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী’ এবং ইতিহাস গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বদিউর রহমান
জামালপুরের ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউর রহমান তালুকদার গত ৬ অক্টোবর মারা যান।
১৯৫২ সালে দেওয়ানগঞ্জ সমবায় উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) নবম শ্রেণির ছাত্র বদিউর রহমান তালুকদার ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন। সেজন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ তাকেসহ পাঁচজনকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
তবে অন্য চারজন ক্ষমা চেয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পেলেও তিনি ক্ষমা চাননি। এ কারণে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত দেশের আর কোনো স্কুলে তিনি ভর্তি হতে পারেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বদিউর রহমান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে তিনি দেওয়ানগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউর দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ সভাপতিও ছিলেন।
মাহমুদুর রহমান বেলায়েত
মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর নোয়াখালীর মুজিব বাহিনীর প্রধান, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদুর রহমান বেলায়েত প্রয়াত হন গত ৯ অক্টোবর। তিনি বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের একাধিকবার সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৩ ও ১৯৮৬ সালে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
শফি বিক্রমপুরী
দেনমোহর ছবির পরিচালক শফি বিক্রমপুরী ব্যাংককের একটি হাসপাতালে মারা যান গত ১৮ অক্টোবর। তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা 'রাজদুলারি'। এরপর 'আলাদিন আলিবাবা সিন্দাবাদ', 'দেনমোহর'সহ কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেন। তার প্রযোজিত ও পরিবেশিত সিনেমার মধ্যে রয়েছে 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী', 'ডাকু মনসুর', 'বাহাদুর', 'বন্দুক', 'সবুজ সাথী'।
শাহজাহান মিয়া
পটুয়াখালী-১ (সদর-মির্জাগঞ্জ-দুমকি) আসনের এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান মিয়া মারা যান গত ২১ অক্টোবর। তার বয়স হয়েছিল ৮৩।
শাহজাহান মিয়ার জন্ম ১৯৪০ সালের ১৭ জানুয়ারি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯১ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত টানা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পটুয়াখালী-১ আসন থেকে ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০৮ সালের নবম এবং ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর হন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। পেশায় আইনজীবী শাহজাহান মিয়া একাধিক মেয়াদে পটুয়াখালী আইনজীবী সমিতির সভাপতিও ছিলেন।
তারেক মাহমুদ
কবি, অভিনেতা ও নাট্যনির্মাতা তারেক মাহমুদ ২৭ অক্টোবর মারা যান। অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি থাকলেও নির্মাণের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ‘চটপটি’ নামের সিনেমা পরিচালনা করেন তারেক। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি ‘পথিক’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করে আসছিলেন।
সালিমুল হক
প্রখ্যাত বাংলাদেশি জলবায়ু বিজ্ঞানী ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক সালিমুল হক। গত ২৮ অক্টোরব তিনি প্রয়াত হন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন সালিমুল হক। তিনি জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি) এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি) এর অধ্যাপক সালিমুল হক গত অগাস্টে জাতিসংঘের নবগঠিত বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা বোর্ডে বাহ্যিক সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান।
জিনাতুন নেসা তালুকদার
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জিনাতুন নেসা তালুকদার মারা যান গত ২৯ অক্টোবর।
রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়ায় ১৯৪৭ সালের ৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। কলেজ জীবন থেকেই সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন জিনাতুন নেসা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ছাত্রলীগের একজন নেত্রী হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। একাত্তরে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভারতে গিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিখ্যাত গোবরা ক্যাম্পে অস্ত্র পরিচালনা ও চিকিৎসা সেবাদানের প্রশিক্ষণ নেন জিনাতুন নেসা। প্রশিক্ষণ শেষে তাকে ৭ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর ৪-এর অধীনে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭৭ সালে তিনি নওহাটা ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। একইসঙ্গে চালিয়ে যান রাজনীতি ও সমাজ গড়ার কাজ। ১৯৯৬ সালের ৫ জুলাই সংরক্ষিত মহিলা আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন তিনি। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের প্রথমে উপমন্ত্রী ও পরে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হোমায়রা হিমু
টেলিভিশন নাটকের অভিনেত্রী হোমায়রা হিমু মারা যান ২ নভেম্বর। মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে ২০০৬ সালে অভিনয়ে আসেন তিনি। টেলিভিশনে 'ছায়াবীথি' নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। একই বছর 'প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর' নামের একটি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন।
এছাড়া 'বাড়ি বাড়ি সারি সারি', 'হাউসফুল', 'গুলশান এভিনিউ'সহ অনেক নাটকে অভিনয় করে আলোচিত হন। 'চাপাবাজ', 'বাকেরখনি', 'বউ বিরোধ', 'গোলমাল', 'নানান রঙের মানুষ' ও 'গিনিস বুকে নাম' নাটকেও অভিনয় করেন তিনি। লক্ষ্মীপুরে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় হোমায়রা হিমুকে।
নাদিরা বেগম
ভাওয়াইয়া গানের খ্যাতিমান শিল্পীদের একজন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাদিরা বেগম মারা যান ৬ নভেম্বর। তিনি সরকারি সঙ্গীত কলেজের শিক্ষক ছিলেন।
শিক্ষকতা করেছেন ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনেও। বিখ্যাত 'কল কল ছল ছল নদী করে টলমল' গানের গীতিকার ও সুরকার এ কে এম আবদুল আজিজের মেয়ে নাদিরা বেগম ১৯৬০ সালে রেডিওতে সংগীত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ভাওয়াইয়া একাডেমির সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
ইমদাদুল হক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইমদাদুল হক মারা যান ১১ নভেম্বর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন।
বাংলাদেশ উদ্ভিদবিজ্ঞান সমিতির কোষাধ্যক্ষ ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর প্ল্যান্ট টিস্যু কালচার অ্যান্ড বায়োটেকনোলজির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পালন করেন।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তার ৮০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০২১ সালের ১ জুন চার বছরের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি।
আবদুল মালিক
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জাতীয় অধ্যাপক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার আবদুল মালিক মারা যান গত ৫ ডিসেম্বর। স্বাধীনতা পদক পাওয়া এই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
১৯২৯ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল মালিক। সিলেট থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন ১৯৪৯ সালে। সেখান থেকে ১৯৫৪ সালে এমবিবিএস শেষ করেন।
হৃদরোগের চিকিৎসায় ১৯৭৮ সালে রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল মালিক। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০৪ সালে আবদুল মালিককে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। এর দুই বছর বাদে ২০০৬ সালে জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা পান।
মইনুল হোসেন
ইত্তেফাকের এক সময়ের সম্পাদক ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মারা যান গত ৯ ডিসেম্বর।
আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে নামা ব্যারিস্টার মইনুল ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ নেশনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে। আইন পেশা বা রাজনীতির চেয়ে বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবেই পরিচিতি গড়েছিলেন; তার প্রভাবের পেছনেও এ সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল বেশি। আর বছরের পর বছর আলোচনায় ছিলেন ছোট ভাই ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ইত্তেফাকের মালিকানা নিয়ে বিরোধরে কারণে।
নূরুল আনোয়ার
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নূরুল আনোয়ার মারা যান গত ১০ ডিসেম্বর।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডতে ১৯৫০ সালে জন্মগ্রহণকারী নূরুল আনোয়ার ১৯৭৩ সালে প্রথম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। চাকরি জীবনে তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহাকুমার সর্বশেষ মহাকুমা পুলিশ প্রশাসক ছিলেন। পরে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর বিভাগের প্রথম উপপুলিশ কমিশনার ছিলেন। ২০০৯ সালের পর তাকে ভূতাপেক্ষ আইজিপি করা হয়।
আরফানুল হক রিফাত
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত মারা যান গত ১৩ ডিসেম্বর। বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
১৯৭৬ সাল থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রলীগ করার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন আরফানুল হক। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের জনসভা পণ্ড করার অপরাধে সামরিক আইনে তার তিন বছরের সাজা হয়েছিল। এরপর বিদেশে পালিয়ে গিয়ে তিনি সেই সাজা থেকে রক্ষা পান।
আরফানুল হক ১৯৮০ সালে কুমিল্লা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের প্যানেলে তিনি বহিঃক্রীড়া ও ব্যায়ামাগার সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছরে জামায়াত-শিবিরের হামলার শিকার হন তিনি। সেসময় তার দুই হাত ও দুই পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।
১৯৯৬ সালে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি কুমিল্লা জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের টানা দুইবারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৩ বছর তিনি কুমিল্লা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন।
গোলাম মোহাম্মদ ইদু
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, শিল্পী-সংগ্রামী গোলাম মোহাম্মদ ইদুর মারা যান গত ২২ ডিসেম্বর।
১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে উদীচী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় এক দশক আগে সত্যেন সেন একটি গানের দল গঠন করেন। সেই গানের দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু। উদীচী প্রতিষ্ঠিত হলে ইদু প্রথম আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তথা বাংলাদেশের প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু। তার জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি।
ফজলুর রহমান
দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ৭৭ বছর বয়সে গত ২৫ ডিসেম্বর মারা যান। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সদ্য স্বাধীন দেশে ফজলুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন সরিষার তেল উৎপাদনের কারখানা সিটি অয়েল মিল, যা পরে সিটি গ্রুপের রূপ নেয়। বর্তমানে এ শিল্পগোষ্ঠীটির অধীনে ৪০টির বেশি কোম্পনি রয়েছে।
আবুবকর সিদ্দিক
কবি অধ্যাপক আবুবকর সিদ্দিক মারা যান ২৮ ডিসেম্বর; তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ঢাকার নটরডেম কলেজ ও কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি কবি, ঔপন্যাসিক, লেখক, ছোট গল্পকার হিসেবে সাহিত্য অঙ্গনে বিচরণ ছিল তার।
১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান কবি আবুবকর সিদ্দিক। তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২০টির বেশি। এছাড়া চারটি উপন্যাস, ১৫টি গল্পগ্রস্থ ও একটি ছড়ার বই তিনি লিখেছেন।