কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে চলে গেলেন এই কবি।
Published : 06 Aug 2023, 11:26 PM
যিনি নিজে লড়েছেন সব সময়, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যার কবিতা দিয়েছে সাহস, সেই মোহাম্মদ রফিক আর নেই।
৮০ বছর বয়সে রোববার তার জীবনাবসান ঘটেছে বলে জানিয়েছেন তার অনুজ কবি ও ছাত্ররা। একুশে পদক জয়ী এই কবি দীর্ঘদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে মোহাম্মদ রফিকের মরণের খবর দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কবি শুভাশিস সিনহা ফেইসবুকে লিখেছেন-
“তাঁর কাছে জগতের শ্রেষ্ঠতম কবি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিনেই মৃত্যু হলো তাঁর!
আপনাকেও একদিন বিদায় জানাতে হবে -
কখনো ভাবতে চাইনি, স্যার!
কখনোই না, কবি!”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাহিত্যিক প্রশান্ত মৃধা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনার ছেলের কাছ থেকে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমি মৃত্যুর খবরটি জেনেছি। সম্ভবত তার কিছু আগে উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”
নিজের বাড়ি বাগেরহাটে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ঢাকায় আনার পথে মোহাম্মদ রফিকের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা সিদ্দিকা রনি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রফিক স্যার উনার ছেলের সাথে তিন দিন আগে বাগেরহাটে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
“আজকে তিনি অসুস্থ বোধ করলে প্রথমে বাগেরহাটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বরিশাল মেডিকেলে নেওয়া হয়। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকায় আনার পথে উনার মৃত্যু হয়।”
লাশ বাগেরহাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানিয়ে ফারজানা বলেন, “স্যার আমাকে এবং আমার হাসবেন্ড প্রশান্ত মৃধাকে সন্তানতূল্য স্নেহ করতেন। কিছু বলার মতো মানসিকতায় নেই আমরা এখন।”
মাদারীপুরের রাজৈর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সঞ্জয় সাহা সাংবাদিকদের বলেন, মহাসড়কে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত পৌনে ১০টার দিকে মোহাম্মদ রফিককে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আকাশ বণিক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৯৪৩ সালে বাগেরহাট জেলার বৈটপুরে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ রফিকের বাবা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মা রেশাতুন নাহার। তাদের আট সন্তানের মধ্যে রফিক ছিলেন সবার বড়। তার ভাইদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ তারেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসের।
মোহাম্মদ রফিকের শৈশব কাটে বাগেরহাটে; ম্যাট্রিক পাস করে তিনি ঢাকায় আসেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। বিএ পাসের পর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই মোহাম্মদ রফিকের কবি প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এসময় তিনি পাকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। তখন সামরিক আদালতে তাকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশেও পরে তিনি সামরিক শাসকের রোষের শিকার হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রফিক, স্বাধীন বাংলা বেতারেও তিনি কাজ করেন।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন রফিক। ২০০৯ সালে তিনি অবসরে যান।
মননশীল আধুনিক কবি হিসাবে পরিচিত রফিক আলোচিত হয়ে আছেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের রিরাগভাজন হয়ে।
এরশাদকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘খোলা কবিতা’ নামে আলোড়ন তোলা কবিতা, যার কয়েকটি পঙক্তি ছিল এমন- ‘সব শালা কবি হবে, পিঁপড়ে গোঁ ধরেছে উড়বেই, দাঁতাল শুয়োর এসে রাজাসনে বসবেই’।
এই কবিতা তখন কেউ ছাপাতে সাহস পায়নি। গোপনে তা ছাপানো হয় এক ছাপাখানায়। নিউজপ্রিন্টে এক ফর্মায় ছাপানো সেই কবিতা গোপনে বিলি করেন মোহাম্মদ রফিকের ছাত্র-ছাত্রীরা। এভাবে হাতে হাতে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
মোহাম্মদ রফিকের যে কবিতা ক্ষিপ্ত করেছিল এরশাদকে
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ জুগিয়ে তোলা এই কবিতার জন্য মোহাম্মদ রফিককে সেনানিবাসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। তার নামে হুলিয়াও জারি হয়। তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল।
মোহাম্মদ রফিকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বৈশাখী পূর্ণিমা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ধুলোর সংসারে এই মাটি, কীর্তিনাশা, কপিলা, স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়,
মৎস্যগন্ধা, বিষখালী সন্ধ্যা, কালাপানি, নোনাঝাউ, ত্রয়ী, চিরহরিতের উপবাস।
এছাড়া বেশ কিছু গদ্য ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও লিখেছেন তিনি।
মোহাম্মদ রফিক ২০১০ সালে ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদকে ভূষিত হন। তার আগে ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত তিনি।