রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু

৮২ বছর বয়সী ‘দাদা ভাই’ উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রামণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2023, 08:58 AM
Updated : 9 June 2023, 08:58 AM

বাংলাদেশের রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ সিরাজুল আলম খান মারা গেছেন।

নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার বেলা আড়াইটায় তার মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান।

৮২ বছর বয়সী ‘দাদা ভাই’ উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে সংক্রামণসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গত ৭ মে থেকে শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তার। পরে ২০ মে তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়।

শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ জুন তাকে কেবিন থেকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান, শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে হার্ট অ্যাটাক হয় সিরাজুল আলম খানের। তাতে তার অবস্থার অবনতি হয়। ডাক্তররা চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি।

দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে আসা চিরকুমার সিরাজুল আলম খান ঢাকার কলাবাগানে ভাইদের সঙ্গেই থাকতেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরে ছাত্র-তরুণদের আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তারা। বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলেন এই ছাত্রনেতারা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে বিরোধের জের ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ভেঙে দুই ভাগ হয়। এরপর ১৯৭২ সালে সিরাজুল আলম খানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়।

তিনি কখনও নেতৃত্বে না এলেও জাসদ নেতাদের পরামর্শক হিসেবে তাদের ‘তাত্ত্বিক গুরু’ হিসেবে পরিচিত। তাকে সবাই ‘দাদা ভাই’ নামেই ডাকতেন।

সিরাজুল আলম খান কখনও জনসম্মুখে আসতেন না এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিতেন না; আড়ালে থেকে তৎপরতা চালাতেন বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিতি পান।

মুক্তিযুদ্ধকালে ডাকসুর ভিপি, বর্তমান জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব এক শোকবার্তায় বলেন, “সিরাজুল আলম খান ছিলেন আমার রাজনৈতিক দার্শনিক শিক্ষক। তার মৃত্যুতে দেশ অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। সিরাজুল আলম খান বাঙালির অন্তরাত্মায় সদা সর্বদা সর্বাগ্রে জাগ্রত থাকবেন।”

শনিবার ঢাকায় জানাজা শেষে ‘দাদা ভাই’য়ের মরদেহ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের কবরে তাকে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) দপ্তর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন।

Also Read: সিরাজুল আলম খানকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর

Also Read: অসুস্থ সিরাজুল আলম খান হাসপাতালে ভর্তি

Also Read: সিরাজুল আলম খানের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’

Also Read: সিরাজুল আলম খান লাইফ সাপোর্টে

এক নজরে ‘দাদা ভাই’

১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্ম নেন সিরাজুল আলম খান। বাবা খোরশেদ আলম ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তাই বিভিন্ন স্থানে বদলি হতে হয়েছে। তাই সিরাজুলের পড়াশোনা হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকালেশনের পর ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন তিনি। ছাত্র জীবনেই জড়ান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।

১৯৬২ সালের নভেম্বরে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক ও পরে জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদকে নিয়ে ছাত্রলীগের ভেতরে গঠন করেন গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। এটি পরে নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

সে সময় ছাত্রলীগ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালায়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন।

ছয় দফা নিয়ে আওয়ামী লীগে বিভেদ দেখা দিলে ১৯৬৬ সালেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস ছয় দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়।

১৯৬৮ সালে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব গড়ে তোলে 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা বিএলএফ।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর ছাত্রলীগ তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নামে। ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনেও সিরাজুল রাখেন ভূমিকা। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের আগেও তিনি তার সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ দেন বলে ২০১৯ সালের মার্চে দাবি করেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব।

অবশ্য তার আগের বছর স্বাধীনতার আগে সিরাজুল আলম খানের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে-পরে তার সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের কথোপকথন তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ওই ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘চাপ দিয়েছিলেন’ সিরাজুল আলম খানসহ তার সহযোগীরা। ভাষণে সে ঘোষণা না আসায় ‘জনগণ নিরাশ হয়ে চলে গেছে’ বলে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন তারা, যার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি।

“কিছু লোক বক্তৃতার আগে পরামর্শ, বক্তৃতার পরে এই কথা বলার পেছনে কী রহস্যটা থাকতে পারে, সেটা ৭৫ এর পরে বা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখলে এখন মনে হয়। তারা যে সব সময় একটা ষড়যন্ত্রের সাথে ছিল; সেটা কিন্তু বোঝা যায়”, বলেন শেখ হাসিনা।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথাগত সামরিক কায়দায় মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি চারটি সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করে বিএলএফ। এর একটির নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। অক্টোবর থেকে বিএলএফ মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারা এগিয়ে নিতে সিরাজুল আলম খান প্রতিষ্ঠা করেন দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তার কাছে চার দফা দাবি নিয়ে যান মুজিব বাহিনীর চার নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুর হুক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ। এই ঐ্যমত্যের ভিত্তিতে ৩১ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করে মুজিব বাহিনী। জানুয়ারি মাসেই বঙ্গবন্ধুকে ১৫ দফা সুপারিশনামা দেন সিরাজুল আলম খান।

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগে বিভক্তি দেখা দেয়। দুই পক্ষই আলাদা সম্মেলন ডাকে। বঙ্গবন্ধু কোথাও যাবেন না জানালেও ২১ জুলাই সকালে রেসকোর্সে এক পক্ষে যোগ দেন। এরপর অপর পক্ষ গঠন করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। গঠন হয় গোপন সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পৌনে তিন মাসের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে বিপ্লবের চেষ্টা করে জাসদ। কিন্তু ক্ষমতা চলে যায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হাতে। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়, গ্রেপ্তার হন সিরাজুল আলম খানসহ দলের শীর্ষ নেতারা।

জিয়াকে হত্যার পরের বছর ১৯৮২ সালে আরেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন হলে সিরাজুল আলম খান তার সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেন।

সে সময় জাসদে ভাঙন ধরে। আ স ম আব্দুর রব একই নামে নতুন দল গঠন করলে তাকে এরশাদ ও সিরাজুল আলম খান সমর্থন করেন।

উপজেলা ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরশাদকে প্রভাবিত করেন সিরাজুল। তবে এরশাদ সরকারের পতনের পর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান।

পরিবারের ভাষ্য, সিরাজুল আলম খানের কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই। তিনি ছিলেন চিরকুমার।