দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের পরিচয়ই তার অবস্থান গড়ে দিয়েছিল; প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনেও ছিল কাগজটি। ২০১০ সালে সেই ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়েই পারিবারিক মালিকানাধীন ভবনটির মালিকানা বেছে নেন তিনি।
Published : 09 Dec 2023, 06:53 PM
ইত্তেফাকের এক সময়ের সম্পাদক ও সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মারা গেছেন।
শনিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে নামা ব্যারিস্টার মইনুল ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ নেশনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে। আইন পেশা বা রাজনীতির চেয়ে বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবেই পরিচিতি গড়েছিলেন; তার প্রভাবের পেছনেও এ সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল বেশি। আর বছরের পর বছর আলোচনায় ছিলেন ছোট ভাই ও সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ইত্তেফাকের মালিকানা নিয়ে বিরোধরে কারণে।
প্রয়াত মইনুল হোসেনের একান্ত সচিব ওয়াহিদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যার এভারকেয়ার হাসপাতালে ছিলেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।”
৮৩ বছর বয়সী এই সাংবাদিক, রাজনীতিক ও আইনজীবী স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
পরিবারের সদস্যদের উদ্ধৃত করে ওয়াহিদুজ্জামান জানান, আজিমপুর কবর স্থানে মইনুল হোসেনকে তার বাবা-মায়ের পাশে সমাহিত করা হবে। মরহুমের প্রথম জানাজা রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় বারিধারা জামে মসজিদে এবং দ্বিতীয় জানাজা বাদ জোহর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে।
এভার কেয়ার হাসপাতালের মেডিক্যাল সার্ভিসেসের ডিরেক্টর ডা. আরিফ মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বেশ কিছু দিন এভার কেয়ার হাসপাতালের প্রফেসর সালেহ আহমেদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন।"
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিউ নেশন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মইনুল হোসেন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকও ছিলেন।
১৯৬৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে ইত্তেফাকের সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারম্যানও ছিলেন।
ইত্তেফাকের মালিকানা ও পরিচালনা নিয়ে তাদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে। এ নিয়ে ছোট ভাই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর সঙ্গে তার বিরোধ ছিল দীর্ঘদিনের। তাদের এ বিরোধ বিভিন্ন সময় প্রকাশ্যেও এসেছে।
পরে ২০১০ সালে তাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ মেটে ভাগাভাগির মাধ্যমে। পারিবারিক সমঝোতার ভিত্তিতে চুক্তি করে পুরনো বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের পুরো মালিকানা পান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তাদের বোন ও ভাগ্নেরা।
মইনুল হোসেন পান ভবনটির মালিকানা, ১০ কোটি টাকা ও কিছু অস্থাবর সম্পত্তি।
এ নিয়ে ওই বছর ২ মে ঢাকার একটি হোটেলে মইনুল হোসেন, তার ভাই, বোন ও ভাগ্নেদের মধ্যে চুক্তি সই হয়।
এর আগে দীর্ঘ সময় পত্রিকা পরিচালনা ও মালিকানা নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধের জের ধরে নানান টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে যায় ইত্তেফাক।
ইত্তেফাক ভবনে একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ ২০০৫ সালে নিহত হন এক প্রেস কর্মচারী। অভিযোগ রয়েছে, মালিকানা দ্বন্দ্বের জের ধরেই এসব অঘটন ঘটেছিল।
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে বড় ভাই মইনুল আইন উপদেষ্টা হন। এসময় সাবেক মন্ত্রী মঞ্জুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার প্রেক্ষাপটে তিনি দেশত্যাগ করেন। একাধিক মামলায় তার সাজাও হয়।
মঞ্জু বিদেশে থাকার সময় ২০০৭ সালের ১৭ অক্টোবর মইনুলের স্ত্রী সাজু হোসেনকে সাময়িকভাবে ইত্তেফাকের প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসক।
এ সময় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খান সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ইত্তেফাকের অনেক সাংবাদিক-সংবাদকর্মীকে সে সময় অব্যাহতি দেওয়া হয়। নতুন করে বেশ কিছু নিয়োগও দেওয়া হয়। মঞ্জু দেশে ফিরে চাকরিচ্যুতদের বড় একটা অংশকে আবার চাকুরি ফিরিয়ে দেন।
সাংবাদিকতা ও আইন পেশার পাশাপাশি মইনুল হোসেন রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রথম জাতীয় সংসদে বরিশালের ভান্ডারিয়া-কাউখালী আসন থেকে সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের প্রতিবাদে সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
পরের দিকে তার রাজনৈতিক বলয় বদলে যায়। বিএনপি ও ডানপন্থি আদর্শের দলগুলোর প্রতি তার সমর্থন ছিল অনেকটা প্রকাশ্যেই। বিভিন্ন সময় নানান বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির আলোচনায় থেকেছেন।
পরে ১/১১ এর সময়ে ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন মইনুল হোসেন। তিনি তথ্য, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
এ দায়িত্বে থাকাকালেও বিভিন্ন মন্তব্যের জন্য বিতর্কিতও হন তিনি। বছর পূর্তির কয়েকদিন আগে ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি আরও চার উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি পদত্যাগ করেন।
২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কামাল হোসেনের উদ্যোগে বিএনপিকে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সক্রিয় ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। রবসহ ফ্রন্টের বিভিন্ন নেতার বাড়িতে বৈঠকে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
ওই সময় এক টেলিভিশন আলোচনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলার পর সমালোচনার মুখে পড়েন এবং পরে গ্রেপ্তার হন।
১৯৭৬ সালেও তিনি একবার কারাভোগ করেন।
প্রবীণ আইনজীবী মইনুল ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে পিরোজপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ঢাকার নবাবপুর সরকারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
একই বছরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ‘মিডল টেম্পল ইন’ এ আইন বিষয়ক পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে বার থেকে ব্যারিস্টার-ইন-ল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ঢাকা বারে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৬৫ সালে তিনি আইনপেশা শুরু করেন। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের সময় তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন ২০০০-২০০১ সালে।
এছাড়া ব্যারিস্টার মইনুল কয়েক দফায় সংবাদপত্র পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও প্রেস কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।