১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রামে প্রতিরোধ সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন অমল মিত্র।
Published : 07 May 2023, 07:14 PM
একাত্তরের চট্টগ্রামে যার হাত দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উঠেছিল, সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা অমল মিত্র আর নেই।
রোববার বিকাল ৪টা ৩ মিনিটে বন্দর নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে জানান তার ছেলে শান্তনু মিত্র।
৭২ বছর বয়সী অমল মিত্র চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে তার ভূমিকার কথা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর এর প্রতিশোধ নিতে চট্টগ্রামে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে যারা প্রতিরোধ সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন, অমল মিত্র তাদের অন্যতম।
তার মৃত্যুর খবরে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই হাসপাতালে ছুটে যান তাকে শেষবার দেখতে।
শান্তনু মিত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তার বাবার মরদেহ সন্ধ্যায় মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের অস্থায়ী শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা হবে। রাত ৮টার দিকে বলুয়ার দিঘী মহাশ্মশানে তার শেষকৃত্য হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্রর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী।
এক শোক বার্তায় তিনি বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মৃত্যুর পরোয়া না করে অমল মিত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে লড়তে তখন আমরা গেরিলা হামলার কৌশল প্রয়োগ করে চট্টগ্রামকে শত্রুমুক্ত করতে একত্রে কাজ করি।
“দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট পরবর্তী কঠিন সময়ে তিনি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে সুসংগঠিত করেন। চট্টগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে তিনি সবসময় পাশে ছিলেন।”
স্মৃতিচারণ করে মেয়র রেজাউল করিম বলেন, “দলের চরম দুর্দিনে কর্মীদের তিনি আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়। দেশ ও জনগণের কল্যাণে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শুণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পুরণ হবার নয়।
“এ বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হল। তবে প্রজন্ম থেকে থেকে প্রজন্মে একজন আদর্শিক নেতা হিসেবে কর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন। তার কর্ম এবং সাংগঠনিক কৌশল আমাদের জন্য অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।”
নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল পৃথক বার্তায় শোক জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলেও চট্টগ্রামে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা খবর পান পরদিন ৩ মার্চ। ঢাকায় পতাকা উত্তোলনের পর সেদিনই জগন্নাথ কলেজের ভিপি সৈয়দ রেজাউর রহমান চট্টগ্রামে আসেন।
“ভিপি রেজাউর রহমান চট্টগ্রামে এসে স্টেশন রোডের রেস্ট হাউজে ওঠেন। তিনি জানান, ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সেই পতাকা মানচিত্র খচিত। এ কথা শুনে, মহিউদ্দিন ভাই (মহিউদ্দিন চৌধুরী) সাদা কাপড়ে লাল মানচিত্র এঁকে দুটি পতাকা তৈরি করেন। এর একটি নিয়ে আমি মিছিল বের করি। আর অন্যটি রেস্ট হাউজের বাংলোর ছাদে উড়িয়ে দেয় অমল মিত্র।”
১৯৭১ সালে আগরতলা ও হাফলং ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া গেরিলা অমল মিত্র সিটি কলেজ অপারেশন, আগ্রাবাদে পাকিস্তানি সেনা হত্যা, আমেরিকান এক্সপ্রেস অভিযান এবং আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশন গেরিলা অপারেশনসহ অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর এর প্রতিশোধ নিতে মৌলভি সৈয়দের নেতৃত্বে দেশ ছাড়েন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, এস এম ইউসুফ, কাজী ইনামুল হক দানু, সুলতান উল কবির চৌধুরী ও অমল মিত্রসহ আরও বেশ কয়েকজন। তারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের পরিকল্পনাও করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে ১৯৭৭ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণও ঘটানো হয়েছিল। ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে পরে ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’ হয়।
অমল মিত্র সারাজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাথে অমল মিত্রর বন্ধুত্ব চট্টগ্রামের রাজনীতিতে ছিল প্রবাদ প্রতিম।
এই যোদ্ধাকে নিয়ে বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক রচনা করেছেন ‘একাত্তরের দুর্ধর্ষ গেরিলা অমল মিত্র’ নামের একটি গ্রন্থ।