জার্মানিতে ৪০ বছর: বারে গিয়ে পত্রিকা বিক্রি

জার্মানিতে টিকে থাকার জন্য পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করার পর অনেকরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। এর মধ্যে বারে গিয়ে পত্রিকা বিক্রির অভিজ্ঞতাটা একেবারেই অন্যরকম।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2018, 08:08 AM
Updated : 9 April 2018, 08:08 AM

ইতোমধ্যে আমি ওফেনবাখের অফিস থেকে ভিসা পাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করছি। ফর্ম পূরণ করে বাড়িওয়ালায় কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে ফরেন পুলিশ অফিসে জমা দিয়েছি।

আমাদের ফ্লাটের সেলিম বাদে তখন সবাই ভাষা শিখছে। বাকিরা সবাই কাজ জুটিয়ে ধুমসে কাজ করছে। আমার সহযাত্রী বন্ধু রশিদ তো তখন দুটো কাজ করছে। একটা পাঁচ তারকা হোটেল হলিডে ইনে, অন্যটি বিকালে পার্ট টাইম কাজ।

এর মধ্যে আমার আরেক ফ্ল্যাটমেট মানিক ভাই, যিনি বর্তমানে নিউ ইয়র্কে আছেন, তিনি ফ্রাঙ্কফুর্টে পোস্ট অফিসে কাজ পেলেন। মানিক ভাই ঢাকায় পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন, সেই অভিজ্ঞতার কথা বলে তিনি পোস্ট অফিসে কাজ পেয়েছিলেন।

যদিও তিনি জার্মান ভাষা ওই পর্যন্ত তেমন কিছুই শেখেননি। অবশ্য ভাষার তার তেমন কোনো কাজ ছিল না। শধু শহরের নাম আর পোস্টাল কোড পড়তে পারলেই তিনি চিঠি বা প্যাকেট বাছাই করতে পারতেন। মানিকদার এই পোস্ট অফিসে কাজ পাওয়া পরবর্তীতে আমারও কাজে লেগেছিল, সে কথায় পরে আসবে।

পত্রিকা বিতরণকারী অফিসের ইয়ান তখনও আমাকে কোনো স্থায়ী বিক্রির জায়গা দেননি। আর তিনি দেবেনই বা কীভাবে? পুরনো কেউ তো তাদের জায়গা ছাড়ছেন না। তাই তিনি আমাদের অনেককেই এদিক-সেদিক পাঠাতেন।

আমার কাছে এই নতুন জায়গাগুলোর মধ্যে অনেক জায়গাই ছিল বেশ বিরক্তিকর। তার মধ্যে থেটারপ্লাটজ, বর্তমানে এই স্থানটির নামকরণ হয়েছে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডের নাম অনুসারে ( যিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন ) উইলি-ব্রান্ড-প্লাটজ।

এই জায়গায় আছে সুউচ্চ দালান, এই দালানের কারণে ওই জায়গায় প্রচণ্ড বাতাস লাগতো। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হতো যে ওখানে দাঁড়ানোই মুশকিল হয়ে যেতো। অনেকটা এরকম জায়গা ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট র‌্যাত্থাউসের কোণায়। অথবা ওঙ্কেল মাস্ক নামে একটি বারের সামনে খালি জায়গায় যখন দাঁড়াতে হতো।

আসলে পত্রিকা যখন বিক্রি হতো না, তখন ঠাণ্ডা বাতাস বেশি অনুভূত হতো আর বিরক্তি বাড়িয়ে দিত। অনেকে আবার বিকালের পত্রিকা বিক্রির পর্ব শেষ করে সন্ধ্যায় বিভিন্ন লোকালে (লোকাল মানে বার) গিয়ে পত্রিকা বিক্রি করতো। তবে আমি কখনও ওই সময় পত্রিকা বিক্রি করিনি। আমার মনে হয়েছে, ইয়ান শুধু আমাদেরকে দিয়ে উপার্জনই করতো না, এর সাথে সে মজা আর তার ফ্যান্টাসিকে কাজে লাগাতো।

একদিন ইয়ান আমাকে দিনেরবেলায় পত্রিকা দিয়ে বারে বারে গিয়ে পত্রিকা বিক্রি করতে বললো। আর বারগুলোর এলাকা ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টের রেড লাইট এলাকার কাইজার, টাউনুস স্ট্রাস ও তার আশপাশের এলাকায়। কী আর করা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওখানে গিয়ে দুই-একটা বারে গেলাম।

বারে গিয়ে হলো অন্যরকম অভিজ্ঞতা। দেখি সেই দুপুরের পর থেকে অনেকে বসে পান করছে। আমি পত্রিকা নিয়ে ঢুকে ভীষণ অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়লাম। কেউ কেউ তখন ইতোমধ্যেই মাতাল হয়ে পড়েছে। আর বাকিরা ওই পথেই। কারও কারও সাথে বারের মেয়ে বা অন্য মেয়েরা আছে। এই অবস্থায় কে আর পত্রিকা কিনবে?

সেদিন একেবারে পত্রিকা বিক্রি শূন্য হাতে ফিরতে হতো যদি না দুই মেয়ে ওদের খদ্দেরকে দিয়ে পত্রিকা না কেনাতো। শুধু তারা খদ্দেরদের দিয়ে পত্রিকা কেনায়নি, তাদেরকে জোর করে বেশি অর্থ দিতে বাধ্য করেছে। যেখানে পত্রিকার দাম ৪০ পেনি, সেখানে এক মার্ক দিতে বাধ্য করেছে।

এই অভিজ্ঞতায় মনে হলো যে এই মেয়েগুলো ও আমি, দু’জনই আমাদের পণ্য যেমন- আমি পত্রিকা আর ওরা তাদের দেহ বিক্রি করছে। বড় দাগে ধরা যায় যে আমরা দুই পক্ষই শ্রম বিক্রি করছি। মেয়ে দুটো তাদের খদ্দেরদের দিয়ে পত্রিকা কিনে আর টিপস দিয়ে শ্রমিকের সাথে শ্রমিকের একাত্মতা প্রকাশ করলো যেন। তবে ওটাই আমার বারে বারে গিয়ে পত্রিকা বিক্রির প্রথম আর শেষ দিন ছিল।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!