জার্মানিতে ৪০ বছর: ইরান ফেরত বাংলাদেশি প্রতিবেশী

আমরা জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের পাশেই ছোট শহর ওফেনবাখের যে বাসায় থাকতাম, সেটার দুটো অংশ ছিলো।  সামনের অংশের তিন তলায় আমরা একটি ফ্ল্যাটে ছিলাম।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Feb 2018, 06:37 AM
Updated : 6 Feb 2018, 06:37 AM

সামনের ও পেছনের দুটো বিল্ডিংই ছিল পাঁচ তলা । একদিন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি দু’জন আমাদের দেশি লোকের মতো পেছনের বিল্ডিং থেকে বের হচ্ছেন। দু’দিন পরে যখন তাদের সাথে নিচে দেখা হলো, তখন তাদের জিজ্ঞেস করলাম।

তারা  সিলেটের মানুষ। তাদের উপরের আরেকটি ফ্ল্যাটে কয়েকজন তাদের এলাকার মানুষ, মানে সিলেটের মানুষ আছে। ভালো লাগলো যে আমরা ওই বাসায় শুধু সাতজনই না, আরও পাঁচজন দেশি মানুষ আছেন।

উনাদের পাঁচজনের দুই ফ্ল্যাটের থাকার পর আমার কাছে একটু একটু পরিষ্কার হতে থাকলো যে আমাদের বাড়িওয়ালা আমার বন্ধু ফরহাদের জন্য আমাদের ফ্ল্যাটটি তার কায়দায় বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে ছিলেন কেন।

আগেই বলেছি, আমাদের বাড়িওয়ালা লেরপের ফ্রাঙ্কফুর্টের স্লসেন স্ট্রিট ৪ ও টাউনুস স্ট্রিট ৩০-এ দুটি বাড়ি ছিলো। লেরপ অভিজ্ঞ লোক ও জার্মান মার্কের পেছনে ছোটা একজন। তিনি বুঝেছিলেন, যেভাবে বাংলাদেশ থেকে মানুষ আসা শুরু করেছে, তাতে তার এই বাড়ির জন্য ভাড়াটে খুঁজতে হবে না। বরং কোনো বাংলাদেশি ভাড়াটে যদি তার বাড়িতে ঢোকে, তাহলে তাদের মাধ্যমেই নতুন আসা বাংলাদেশিরা নিজ দেশের মানুষদের অনুসরণ করবে। যে রকমের ফ্ল্যাটই হোক না কেনো।

আমাদের সামনের বিল্ডিং-এ তো টয়লেট ও বাথরুম ছিলো, কিন্তু পেছনের বিল্ডিং-এ বাথরুম তো ছিলোই না, এমনকি ফ্ল্যাটের ভেতরে টয়লেটও ছিলো না। টয়লেট ছিলো উপর নিচের ফ্ল্যাটগুলোর মাঝামাঝি জায়গায়। কিন্তু তারপরও ওই বিল্ডিং-এর ভাড়াটিয়ারা খুশি থাকতে বাধ্য হতো এই মনে করে যে অন্তত এই পরবাসে তাদের মাথার উপর একটি ছাদ তো পেয়েছে!

কিছুদিন পরে দেখি, পেছনের বিল্ডিং-এ একটি ফ্ল্যাটে আরও চারজন বাংলাদেশি এসেছেন। তাদের একজন হলেন সিরাজগঞ্জের ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য় থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের পড়াশোনা শেষ করা রবি রায়হান। আর সাথে ছিলো একেবারেই তরুণ নারায়ণগঞ্জের মাহমুদ, আলাউদ্দিন ও জামান সাহেব নামে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। তাদের সাথে ওই বাড়িতে আসার পর পরই পরিচয় হলো। তারপর অল্পদিনের মধ্যে রবি ভাইয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হল, যা আজও অটুট আছে।

এই চারজনের জার্মানি আসার কাহিনী ছিল আরও রোমাঞ্চকর। তারা প্রথমে এসেছিলেন ইরানের রাজধানী তেহরানে। সময়টা ছিলো ইরানের সম্রাট রেজা শাহ পাহলভির আমল। শাহ’র সময় ইরান ছিলো পশ্চিমা ধরনের একটি দেশ এবং আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আর অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমা ধাঁচের উন্নত।

তখন ইরানে কাজের অনুমতি পাওয়া যেত। এই খবরটি বাংলাদেশের এই দামাল ছেলেদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। তাই তারা কয়েকজন কয়েকজন করে পাড়ি দিয়েছিল ইরানে। কিন্তু তাদের ভাগ্য মনে হয় ভালো ছিলো। কারণ তারা ওখানে কাজ পাওয়ার প্রায় এক  মাস পরেই সেই অনুমতি তুলে নেওয়া হয়। এই তুলে নেওয়ার কারণে তাদের নতুন দেশের সন্ধান করতে হয়। সেই দেশই হলো জার্মানি।

ভাগ্য ভালো এজন্য বলেছি, সেই ১৯৭৮ সাল থেকেই শাহ্‌’র বিরুদ্ধে ইরানের জনগণের অসন্তুষ্টির প্রকাশ দানা বাঁধতে শুরু করে। পরে জেনেছি, ইতোমধ্যেই রবি ভাইদের মতো আরও ২৬ জন দেশ থেকে ভাগ্য অন্বেষণে তেহরানে জড়ো হয়েছিলেন। রবি ভাইরা যে ছয়জন জার্মানিতে এসেছিলেন, এর আগেও এরকম এক ব্যাচ বাংলাদেশি জার্মানিতে পৌঁছেছিলেন।

তাদের পৌঁছানোর খবর পেয়ে রবি ভাইরা ছয়জন জার্মানির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। প্রথমে তারা বাসে করে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে আসেন, তারপর সেখান থেকে ট্রেনে বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লাভিয়া হয়ে তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে ঢোকেন। তারপর পূর্ব বার্লিন হয়ে পশ্চিম বার্লিনে আসেন।

তাদের এই যাত্রায় বিরতিসহ সময় লেগেছিল ছয়দিন ছয় রাতের মতো। যেহেতু তাদের আগের গ্রুপ, মানে ইরান থেকে পরিচিতরা ফ্রাঙ্কফুর্ট মাইনে থাকতেন, তাই তাদের মাধ্যমে লেরপের টাউনুস স্ট্রিট ৩০-এ ওঠেন তারা। প্রায় ২০ দিন থাকার পর আমাদের বাসার পেছনের বিল্ডিং-এ ফ্ল্যাট নেন।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!