জার্মানিতে ৪০ বছর: তুষারপাতের রোমাঞ্চকর স্মৃতি

ডিসেম্বর মাস চলে এলো। সালটা ছিলো ১৯৭৭। দিনগুলোও একটু একটু করে সংক্ষিপ্ত হয়ে এলো। ইউরোপের শীতের বিকেলগুলো যেন আরও অস্তিত্ব সংকটে পড়লো।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2017, 05:33 AM
Updated : 12 August 2017, 05:33 AM

বিকেল না হতেই সন্ধ্যার অন্ধকার গ্রাস করতে থাকলো, এর সাথে বেড়ে চললো শীতের প্রকোপও। তাই মন থাকে বিষণ্ণ। এদিকে রিটার্ন টিকেটও পাঠিয়ে দিয়েছি, তার মানে দেশে ফেরার পথও বন্ধ।

এখানে এসে যে ফেরার কথা চিন্তা করিনি তা নয়, আর করব না-ই বা কেন, দেশে তো আরামেই ছিলাম। কথায় বলে- মার হোটেলে খেয়েছি আর বাবার হোটেলে ঘুমিয়েছি। সকালে ঘুম থেকে উঠবার পর মশারিটাও উঠাই নাই, এই মশারি যে আমি না উঠালে বা বিছানা না ঠিক করলে যে অন্য কাউকে করতে হবে, হোক সে মা বা বোন এবং এটা যে আমার কাজ কাউকে দিয়ে করিয়ে নিয়ে তার সময় ও শ্রম আত্মসাৎ করছি, সে বোধ তখন আমার মনে জন্মায়নি।

এখন ভাবি, এগুলো ঠিক করিনি। স্বেচ্ছায় এসেছি এই জার্মানিতে। তখন কী ভেবেছিলাম, কীসের হিসেব তখন কষেছিলাম, সে হিসেব আজ পর্যন্ত মেলাতে পারি নাই। হতে পারে সেটা তারুণ্যের মোহ বা ফ্যান্টাসি।

রিটার্ন টিকেট পাঠিয়ে নেপোলিয়ানের একটি গল্প মনে পড়তো। গল্পটি সত্য কি মিথ্যে, সেটা আমার জানা নেই। কাহিনীটি হলো, নেপোলিয়ান যখন কোনো দেশ আক্রমণ করে দখল করতে যেত, তখন নাকি সে ওই সময়ের নৌযানগুলো সব পুড়িয়ে দিতেন। যাতে তার সেনাদের ফেরার কোনও সম্ভাবনা না থাকে। সেই কাহিনীর অনুকরণে ওই সময় আমার মনে হতো, আমি তো আমার রিটার্ন টিকেট ফেরত পাঠিয়েছি সুতরাং আমার ফেরার পথও রুদ্ধ।  বেঁচে থাকার লড়াইটা আমাকে এই জার্মানিতেই করতে হবে।

ডিসেম্বরের শুরু হলেই জার্মানি বা ইউরোপে বড়দিনের আমেজ শুরু হয়ে যায়, দোকানগুলো নানা রঙের বাতি দিয়ে সাজানো হয়। ছোট-বড় সব শহরেই এই উপলক্ষে বড়দিনের বাড়তি বাজার বসে। জার্মানিতে এই বড়দিনকে বলা হয় ‘ভাইনাখটেন’।

আগেই বলেছিলাম যে জার্মানিতে ‘W’- এর উচ্চারণ হয় ‘ভ’-এর মতো। তাই ক্রিস্টমাসকে ‘অয়াইনাখটেন’ না বলে ‘ভাইনাখটেন’ বলা হয়। ডিসেম্বরের দিন যতই এগিয়ে চলে, ততই এইসব ‘ভাইনাখটেন’ বাজার জমে উঠে। আর তার সাথে বাড়তে থাকে কেনাবেচা।

আমরাও মাঝে মাঝে ওফেনবাখ মার্কটপ্লাজে এই বাজার দেখতে যেতাম, তবে কিছু কেনাকাটা করতাম না। কারণ তখন আমরা টাকা-পয়সার বিষয়ে খুবই হিসেবি। তার মানে কোনোরকম বাড়তি খরচ করা চলবে না।

এই ডিসেম্বরের ৬ তারিখে জীবনের একটি নতুন জিনিস দেখলাম। ওইদিন প্রায় বিকেল হয়েছে এমন সময়, আচমকা আমাদের মধ্যে একজন জানালার কাছে যাওয়া মাত্র বলে উঠলো- “ওই দেখ, বরফ পড়ছে!”

ওর বলার সাথে সাথে আমরা বাসায় থাকা বাকিরা সারি বেঁধে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গেলাম। আসলে আকাশ থেকে যেগুলো নেমে আসে, সেগুলো বরফ না বা শিলার মতোও নয়, এগুলো তুষার পেঁজা তুলোর মত ঝরে পড়ে।

দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল, জীবনে সিনেমা ও টেলিভিশনে তুষার পড়ার দৃশ্য অনেক দেখেছি, কিন্তু ওইদিনই জীবনে প্রথমবার বাস্তবে এই দৃশ্য দেখার সুযোগ হলো। তাই ৬ ডিসেম্বর তারিখটি মনে গেঁথে রাখলাম। সেই দিনটি আমি আর কোনোদিনই ভুলবো না। পরে জীবনে শত সহস্র বার এই তুষার পরার দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু এই তুষারপাত প্রথম দিন দেখে যত রোমাঞ্চিত হয়েছি, সেটা আর কখনোই হয়নি বা হবে না।

এই তুষারপাত যদি বেশি হয় এবং তারপর যদি তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে চলে যায়, তাহলে সেটা জমে বরফ হয়ে যায়। তবে সেদিন বেশি তুষারপাত হয়নি আর তাপমাত্রাও ছিল হিমাঙ্কের উপরে, তাই তুষার আর জমাট বেঁধে বরফ হওয়ার সুযোগ পায়নি।

চলবে...

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!