জার্মানিতে ৪০ বছর: হকার জীবনের শুরু

জার্মানিতে আসার পর প্রায় এক বছর পেরিয়ে যাচ্ছিলো। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছিলাম তখন।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2018, 07:06 AM
Updated : 9 Jan 2018, 07:06 AM

এই সময়ে কী কী কাজ করতে পেরেছি?- হিসেব করতে গিয়ে দেখি যে জার্মানির মাটিতে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। যেমন- শুধু একটা মাত্র ঘর না, একটা আস্ত ফ্ল্যাট পেয়েছি। সেইসঙ্গে পেয়েছি ভালো কিছু ফ্ল্যাটমেটদের। ছয় মাসের ছাত্র ভিসা পেয়েছি, ভাষা শেখার স্কুলে গাবির মতো শিক্ষক পেয়েছি, প্রতিদিন কিছু কিছু করে ভাষা শিখছি, আর প্রয়োজনীয় রাস্তা-দোকানপাটও চিনে নিয়েছি।

তবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি তখনও বাকি ছিলো- উপার্জনের একটি পথ। ওই সময় পর্যন্ত দু’দিন পত্রিকা বিক্রি করে আয় হয়েছিল ২৫ মার্কের মতো। আর অন্যদিকে লন্ডন ও বৈরুত থেকে পাঠানো অর্থ প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো। তার মানে, আমার ব্যক্তিগত অর্থনীতির লাল সিগনাল তখন জ্বলতে শুরু হয়ে গেছে।

কিন্তু দেশ থেকে নিয়ে আসা সাড়ে ছয়শ’ ডলারের মধ্যে তিনশ’ ডলার আমি সযত্নে রেখেছিলাম। ভাবতাম যে মারাত্মক কোনো অর্থনৈতিক সঙ্কটে না পড়লে এই ডলার ধরবো না।

আগেই বলেছি, ওই পরিস্থিতিতে আমরা যারা বাংলাদেশের ছাত্র ছিলাম, তাদের একমাত্র উপার্জনের উপায় ছিলো পত্রিকা বিক্রি করা। তাই এবার ঘন ঘন পত্রিকা বিক্রির জন্য বিতরণ কেন্দ্রে যাওয়া আসা শুরু করলাম। ওখানকার পত্রিকা বিতরণকারী ইয়ান অনন্যাদের সাথে আমাকে দেখছিলেন। কিন্তু তখন পর্যন্ত আমার ডাক পড়েনি।

এই যাওয়া আমার কাছে তেমন একটা খারাপ লাগেনি। কারণ, ভাষা স্কুল থেকে সরাসরি সেখানে গিয়ে ওদেরই ক্যান্টিনে দুই মার্ক দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিতাম। আর ওখানে নতুন বা পূর্ব পরিচিতদের সাথে আলাপ করে বিভিন্ন তথ্য জানা হতো।

দিন দশেক পর সেদিনকার প্রায় সব পত্রিকা বিতরণের পর ইয়ান আমাকে ইশারায় ডাকলেন। তারপর একটি চিরকুটে পত্রিকার সংখ্যা ও কোন জায়গায় আমাকে দাঁড়াতে হবে, সেই জায়গার নাম লিখে তার সহকারী পাকিস্তানি রহিমের কাছে পাঠালেন।

রহিম আমার চিরকুট দেখে পত্রিকা দেওয়ার আগে একটি সবুজ রঙের পত্রিকার নাম সম্বলিত একটু মোটা ধরনের জ্যাকেট ও পত্রিকা বহন করার জন্য একটি ট্রলি দিলেন। এরপর ২০টি পত্রিকা দিয়ে কোথায় আমাকে দাঁড়াতে হবে, কাগজে একে তার বর্ণনা করলেন। আমি জ্যাকেট পরে পত্রিকাগুলো ট্রলিতে নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।

বিতরণ কেন্দ্রের নিয়ম ছিলো যে সপ্তাহের সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রথম ২০টি পত্রিকা বিক্রির টাকা অফিসকে দিতে হবে না। এরপরের বিক্রিত পত্রিকাগুলোর জন্য একটা অংশ দিতে হবে। আর শুক্র, শনিবারের জন্য পত্রিকার কলেবর আর দাম বেশি হওয়ার কারণে নিয়ম ছিল ভিন্ন।

তবে সপ্তাহের চারদিন ২০টা পত্রিকা খুব কম জায়গায়ই বিক্রি হতো। অধিকাংশদের ২০টি পত্রিকা বিক্রি হতো না , তাদেরও অফিসকে জানাতে হতো যে তাদের ২০টি পত্রিকা বিক্রি হয়েছে। কারণ এই ন্যূনতম সংখ্যা না জানালে পরবর্তীতে পত্রিকা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যেত।

সেদিন আমি মিনিট ১৫ হেঁটে বিক্রির জন্য আমার নির্দিষ্ট স্থানটি খুঁজে পেলাম। আগে অন্যদের পত্রিকা ক্লিপ দিয়ে ট্রলিতে আটকিয়ে যেভাবে দাঁড়াতে দেখেছি, সেভাবেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেদিন ঠাণ্ডা ছিল খুব, তবে পত্রিকা অফিসের থেকে পাওয়া জ্যাকেটটি আমার জ্যাকেটের উপর পরায় শীত থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছিলাম।

দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। কিন্তু পত্রিকার গ্রাহকদের তেমন সাড়া নাই। শুধু মাঝে মধ্যে কেউ কেউ কিনছিলেন। ঠাণ্ডার কারণে যে কোনো দোকানের ভেতরে ঘোরাঘুরি করবো, তখন সে সাহসটা ছিল না। কারণ, ইয়ান আর রহিম বিক্রেতারা তাদের জায়গায় ঠিকমতো আছে কিনা , সেটা দেখার জন্য আচমকা চলে আসতেন।

সেদিন আমার ১৪টা পত্রিকা বিক্রি হয়েছিলো। তারপরও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। কারণ, আমি ইয়ানের কাছ থেকে সরাসরি বিক্রির জন্য পত্রিকা পেয়েছি। আমাদের দাঁড়ানোর সময়টা ছিল বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। তাই ৬টা পর্যন্ত বিক্রির চেষ্টা করে অফিসে এসে ২০ পত্রিকা বিক্রির কথা বলে ট্রলি ও জ্যাকেট জমা দিয়ে বাড়ির পথে যাত্রা করলাম।

ওইদিন আমার উপার্জন হয়েছিল ৭ মার্কের মতো। সেদিনই ধরতে গেলে ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার পড়াশোনার পাশাপাশি হকার জীবনের শুরু।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!