জার্মানিতে ৪০ বছর: অচেনা শহরে প্রথম দিন

সালটা ছিল ১৯৭৭, একেবারে পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়। মস্কো বিমান বন্দরে আমাদের বেশ কয়েক ঘণ্টা বিরতি ছিল।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানির বার্লিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2017, 11:46 AM
Updated : 3 Jan 2017, 12:34 PM

কী করবো, চার বন্ধু মিলে আড্ডা দেওয়া ছাড়া তেমন কিছুই  করার ছিল না। এর মধ্যে টেবিলে রাখা পত্র-পত্রিকার মধ্যে চোখে পড়লো 'প্রাভদা' পত্রিকার ইংরেজি ভার্সনটি।

আমি সেটা নিয়ে পড়তে শুরু করলা। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, বিরতি রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ একজন গগলস পরিহিত রাশিয়ান। মনে হলো তিনি রাশিয়ান নিরাপত্তা বাহিনীর লোক। যদিও তিনি সব যাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তারপরও মনে হল তার দৃষ্টি আমার পত্রিকা পড়ার দিকেই।

জানি না তিনি কী ভাবছিলেন? আর আমি ভাবছিলাম, সে হয়ত আমার 'প্রাভদা' পত্রিকা পড়া দেখে খুশি হয়েছেন। কিন্তু মনে হয় আমার ধারণা ঠিক ছিল না। কারণ আবার প্লেনে ওঠার আগে আমাদের চারজনের মধ্যে আমাকেই ভাল করে চেক করা হলো।

তখন আমার লম্বা লম্বা চুল ছিল, আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার বললেল, চুল কান থেকে সরাও, ঘার কাত কর, সামনে হাঁটো, পেছনে আস...ইত্যাদি।

আমি তখন বললাম, "আমি তো তোমাদের দেশে ঢুকছি না, আমি তো ট্রানজিট যাত্রী।"

কে শোনে কার কথা! সে তার মত আমাকে দেখে রেহাই দিল। আনুষ্ঠানিকতা সব শেষ। আবার বিমানে আসন নিলাম। এবার আমাদের গন্তব্য স্থল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর- অজানা, অচেনা, নিশ্চিত এক লোকালয়ে।

মস্কো থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিমান থেকে ঘোষণা করা হল, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছি। পরিকল্পনা ছাড়া নতুন একটি দেশ, ভিন্ন জাতি ও ভাষা এবং বৈরী আবহাওয়ার পরিবেশে যাচ্ছি, আলাদা রকম অনুভূতি হচ্ছিল।

বিমান থেকে নেমে আমরা চারজন একটি ইমিগ্রেশন কাউন্টারের সামনে না দাঁড়িয়ে পাশাপাশি কাউন্টারগুলোর সামনে ভাগ করে দাঁড়ালাম। তখন বিরাট সুবিধা ছিল যে বাংলাদেশ জার্মানির মধ্যে কোন ভিসা পদ্ধতি চালু ছিল না। তবে কাউকে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হত।

মস্কোতে আমাকে যেভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল, এখানে আমাকে কিছুই প্রশ্ন করল না। আমরা চারজন বেশ তাড়াতাড়িই বেড়িয়ে আসলাম।

ইমিগ্রেশন ক্রস করার পর শুরু হল আসল ঝামেলা। কোথায় যাব, কার কাছে যাব? এগুলো তো কিছুই ঠিক করা ছিল না। কারও সাথে যোগাযোগও করার সুযোগও ছিল না, তাই করাও হয়নি।

আমার সহযাত্রী রশিদ আর নিলু স্কুলের তৃতীয় শ্রেণি থেকে বন্ধু আর সেলিম হল আমার বুয়েটের বন্ধু। আমরা ১৯৭৭ সালে একসাথে পাশ করে বেরিয়েছিলাম। নিলু ছিল নারিন্দার ভূতের গলির ছেলে এবং '৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় 'ক্রাক প্লাটুন'-এর একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।

জীবনে চলার পথে দেখেছি, ভাল গ্রুপ হলে কাজ বা দায়িত্ব পরিকল্পনা না করেও ভাগাভাগি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের তাই হল। নিলু আর রশিদ খোঁজ নিতে গেল কীভাবে শহরের দিকে যাওয়া যায়। আর আমি আর সেলিম আমাদের হ্যান্ড-লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

কতক্ষণ পর ওরা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, "কীরে, শহরে যাওয়ার পথের কী খোঁজ পাইলি?"

ওরা এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বড় বড় চোখ করে বলল, "দোস্ত, এখানকার গাড়িগুলো না খুব জোরে চলে।"

হটাৎ বিমান বন্দরের ভেতরেই মনে হল আমাদের প্লেনের একজন সহযাত্রী তার জার্মান বান্ধবী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে যাব?

ভদ্রলোক ছিলেন কোলকাতার, সুতরাং ভাষাগত আর কোন সমস্যাই রইল না। অমায়িক এই ভদ্রলোক বললেন, আসুন আমার সাথে, আমিও সেখানেই যাচ্ছি।

ট্রেন স্টেশন ছিল পাতালে আর টিকেট কাটতে হয় মেশিন থেকে। এগুলো আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন, তাই জানার প্রশ্নই ছিল না। সেই ভদ্রলোকই আমাদের টিকেট কাটা দেখিয়ে দিলেন। সেদিন তার উপকার ভোলার নয়, কিন্তু জীবনে তার সাথে আর কোনদিন দেখা হয়নি।

ট্রেনে ১৫ মিনিটের মত জার্নির পর এবার আমরা ফ্রাঙ্কফুর্ট মেইন স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। প্লেন থেকে নামার পর থেকে যতই সময় পার হচ্ছিল, ততই আমাদের আসল সমস্যা সুনির্দিষ্ট হয়ে এগিয়ে আসছিল।

রশিদের কাছে তখন দেশ থেকে টুকে নিয়ে আসা বেশ কিছু অপরিচত মানুষের ঠিকানা ছিল, যারা কয়েক মাস আগে জার্মানি এসছিল। কিন্তু ঠিকানাগুলো সম্পর্কে ভাল মত খোঁজ নিয়ে আসা হয়নি। তাই স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সি-স্ট্যান্ডে গিয়ে আমরা ঠিকানার নোট বইটি দেখিয়ে বললাম, এর মধ্যে যেটা সবচেয়ে কাছে, আমরা সেখানেই যাব।

ভদ্রলোক আমাদের ঠিকানাগুলোর প্রথমটি দেখেই আৎকে উঠলেন। কারণ ঠিকানাটি ছিল মিউনিখের। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে মিউনিখের দূরত্ব ৩৬০ কিলোমিটার।

তারপর তার নজরে পড়লো বেশ কাছের একটি ঠিকানা। আমারা বললাম, ওখানেই নামিয়ে দেন। এটাই ছিল জার্মানিতে আমাদের প্রথম কোন শহরের ওপর দিয়ে চলা। ট্যাক্সিচালক ছিলেন ভদ্রমানুষ, তাই তিনি কাছের ঠিকানায় আমদের দশ মিনিটের মধ্যে নিয়ে এলেন। ভাড়া নিলেন মাত্র আট মার্ক।

আমরা যখন বাড়ির সামনে এসে সেই অপরিচিত লোকের নাম খুঁজছি, তখনই কাকতলীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল নিলুদের নারিন্দা এলাকার এবং সে সময়ের জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগের মাস্তান ছেলে নুরুর সাথে।

ভাবলাম, এই সেরেছে! আমি আর রশিদ করতাম ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ), জগন্নথ কলেজের সংসদে আমি প্রার্থীও হয়েছিলাম। তৎকালীন কলেজের ছাত্রলীগ নেতা জিন্নার সাগরেদ ছিল এই নুরু আর তার সাথে সব সময় থাকত পুরনো ঢাকার মাস্তান ছেলেরা। রাজনৈতিক দলগত কারণে ও না আবার খারাপ আচরণ করে বসে?

কিন্তু ও মা,দেখলাম তার সম্পূর্ণ উল্টো! নিলুকে দেখেই সে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। আমার সাথে ছিল তার মুখ চেনা পরিচয়, তারপরও হাত মিলিয়ে আমাদেরকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানালো।

বলল, "ভাই আপনারা আর কোন চিন্তা কইরেন না, আমার বাসায় আজকে রুমমেট নাই। চলেন আজকে ওখানেই যাই।"

নুরুর বাসায় আমরা চলে গেলাম। যাক, প্রাথমিক বিপদ তো গেল। নুরু বাসায় নিয়ে গিয়েই বলল,"ভাই, আপনারা তো ক্লান্ত, বিশ্রাম নেন। আমি এই ফাঁকে খাবারের ব্যবস্থা করি।"

নুরু ছিল ভাল রাঁধুনি। সে দ্রুতই কিমা ভাজি আর ডাল-ভাত রান্না করে ফেলল। খাবার শেষে সে সেলিমকে আর আমাকে একটি ঘর দেখিয়ে বলল, "ভাই, আজকে আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমান। কাল দেখা যাবে কি ব্যবস্থা হয়।"

আমরা দু'জন এত লম্বা জার্নির পর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় এলিয়ে পড়লাম। কিভাবে যে সেই রাত পার হল, সেটা টেরই পেলাম না। ওই রাতই ছিল আমার জীবনে জার্মানিতে প্রথম রাত। এরপর কত হাজার রাত পার হয়েছে এখানে, তার কোন হিসেবই নাই।

নিলুর কথা, নুরুর কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। নিলু এক মাস পরে দেশে চলে গিয়েছিল। আর নুরু পাঁচ বছরের মত জার্মানিতে ছিল।

এই দু'জন অল্প বয়সেই না ফেরার দেশে চলে গেছে। আর রশিদ আছে ঢাকায়। সেলিম এখন টরেন্টোতে আর আমি এখানে সব স্মৃতি বয়ে রয়ে গেছি।


চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক ও ইন্টারনেট

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!