জার্মানিতে ৪০ বছর: জার্মান দেশের মসলা

আমাদের তিন বন্ধুর নতুন সংসারে একটা সমস্যা দেখা দিল। সমস্যার নাম- রান্না করার মসলা।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2017, 04:55 AM
Updated : 21 May 2017, 05:23 AM

আমার ধারণা, ১৯৭৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে ৩৫ থেকে ৪০ জন বাংলাদেশি ছিলেন। আর ছোট শহর ওফেনবাখে ৫-৭ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তবে ওফেনবাখে আমাদের পরিচিত কেউ ছিলেন না এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল বেশ পরে।

ফ্রাঙ্কফুর্টে যে ১৪ দিন আমরা ছিলাম, তখন ওরা যে কী মসলা ব্যবহার করতো, সেটাও খেয়াল করে রাখিনি। আর রাখবোই বা কী করে, তখন তো মাথায় অন্যান্য জরুরী বিষয়, যেমন- থাকা, ভিসা,  রাস্তা চেনা- এসব নিয়ে চিন্তা ছিল। খাবার বিষয়ে আমাদের তিনজনের মিল ছিল যে, একটা কিছু দিয়ে ক্ষুধা মিটলেই হতো। কিন্তু তাই বলে বঙ্গ সন্তান হয়ে তো মসলা ছাড়া দীর্ঘদিন এভাবে চলতে পারে না!

সে সময় বাংলাদেশিদের সংখ্যা কম থাকাতে, এখন যেমন বাংলাদেশিদের দোকান আছে, তখন থাকার প্রশ্নই ছিল না। একেবারে আমাদের প্রথম দিকে, ফ্রাঙ্কফুর্ট ‘ছায়েলে’ একটি জার্মান মসলার দোকান ছিল। সেখান থেকে পুরোপুরি আমাদের দেশের মত মসলা না হলেও সেগুলোর মতোই মসলা কিনে এনেছিলাম। অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত। সেই ধরনের মসলাও আমরা সংগ্রহ করেছিলাম কিছুদিন পরে।

ওফেনবাখে ভাল ও বড় বাসা তো পেলাম, কিন্তু তখন তো আমাদের সব কাজই ফ্রাঙ্কফুর্টে। তাই ফ্রাঙ্কফুর্টে আমাদের তো যেতেই হবে। এখানে আরেকটা অসুবিধা ছিল, ওফেনবাখ, ফ্রাঙ্কফুর্ট মূল শহর থেকে বেশি দূরে না হলেও প্রশাসনগত দিক থেকে আলাদা হওয়ার কারণে ট্রাম ও বাসের জন্য আলাদা টিকেট কাটতে হতো।

এই অসুবিধার মধ্যেও সুবিধা ছিল যে, আমাদের লুডভিগ স্ট্রিটের বাসাটা, ফ্রাঙ্কফুর্টের সীমানার বেশ কাছকাছি ছিল। তার মানে আমরা যদি বাসা থেকে মিনিট দশেক বেশি হেঁটে পরের স্টপেজ থেকে উঠতাম, তাহলে ফ্রাঙ্কফুর্টের টিকেট দিয়েই চলাচল করতে পারতাম। তাই প্রথম দিন বাসার কাছে যে বাস স্টপেজ ও ১০ মিনিট হাঁটার পর যে ট্রাম স্টপেজ দেখে খুশি হয়েছিলাম, সেখান থেকে ওঠার সৌভাগ্য আমাদের কমই হয়েছিল। কার্যত আমরা ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম যে, আমাদের বাসার কাছে এই স্টপেজগুল আছে।

আমরা তিনজন হিসেব করে দেখলাম, আমাদের প্রতিদিন ফ্রাঙ্কফুর্টে যেতে হবে না। তাই আমরা ঠিক করলাম, আমরা যৌথভাবে একটা মাসিক টিকেট কিনবো এবং সেই টিকেট যে যত বার ব্যবহার করবে, সে হিসেব মত তার অংশের মার্ক দিয়ে দিবে। তখন মাসিক কার্ডের দাম ছিল ৩৯ মার্ক এবং সেই টিকেট ওফেনবাখ শহর থেকেও কেনা যেত।

তাই আমরা ‘মার্কট প্লাজের’ কাছাকাছি ওদের অফিসে গিয়ে একটি মাসিক ট্রাম ও বাসের টিকেট কিনে নিলাম (এক টিকেটে ট্রাম ও বাস দুটোতেই ব্যবহার করা যেত)। এই মাসিক টিকেটের সুবিধা হলো- একই জোনের মধ্যে ২৪ ঘণ্টা যাতায়াত করা যায় এবং একজনের টিকেট অন্যজন ব্যবহার করতে পারে ও সন্ধ্যে ৮টার পর এবং সপ্তাহ শেষে, মানে শনি ও রোববার একসাথে দু’জন চলাফেরা করতে পারে। অন্যদিকে একক টিকেট কাটলে তার একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে এবং শুধু একদিকে যাওয়া যায়। আর সময় থাকলেও ওই টিকেট দিয়ে আর ফেরা যায় না।

আমাদের ওই সময় থাকা, খাওয়া, চলাচলের জন্য অলিখিতভাবে এক ধরনের কমিউনের ক্ষুদ্র গ্রুপের মতো সেল তৈরি হয়ে গেল। মানুষের জীবনে হয়তো এটাই হয়, সংকটের সময় মানুষ পরস্পরকে যতটুকু বোঝে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, সেটা মানুষ যখন স্বাবলম্বী হয়, তখন সেই মানসিকতা মনে হয় আগের মত কার্যকর হয় না। 

চলবে ...

লেখক:  প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!