গত পর্বে বলছিলাম, ছাত্র ভিসা নিতে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে আমার দুর্ভোগের কথা। উনি আমার ছাত্র ভিসার আবেদন দিতে চাননি। আমার সব কাগজপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তবে এই ভদ্রলোকটি এসে দোভাষী সাক্সেনাকে কী যেন জিজ্ঞেস করলেন। সাক্সেনা তাকে উত্তর দিলেন। তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মিস্টার?
আমি তাকে বললাম, আমি ছাত্র ভিসার জন্য এসেছি কিন্তু ৩১৩ নম্বর রুমের লোক সেই আবেদন চুড়ান্তভাবে নাকচের কথা বলার জন্য দোভাষীর ঘরে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আমার কাগজগুলো হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে আমাকে বললেন, আসুন।
আমি তাকে অনুসরণ করলাম, কিন্তু বেশিদূর যেতে হলো না। যে ঘরে আমি এতোক্ষণ ছিলাম, সেই রুমের প্রায় বিপরীত দিকে একটি কক্ষে নক করে ভেতরে প্রবেশ করলেন।
ওই ঘরে বসা একজনকে কি যেন বললেন। ভাষা না বুঝলেও তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হলো, প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বললেন আমার বিষয়টা দেখতে। দ্বিতীয়জন আমাকে বসতে বললেন, আমি বসলাম। তারপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বিষয়টি কী?
আমি কাগজগুলো দেখিয়ে বললাম, এই হচ্ছে আমার কাগজ আর আমি জার্মানিতে পড়াশোনা করতে চাই। তিনি শুনলেন এবং কাগজগুলো নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। দেখার সময়ই জিজ্ঞেস করলেন, আমি দেশে কী পড়াশোনা করেছি?
আমি তাকে সব জানালাম। তিনি দেখলেন, আমার ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার যোগ্যতার সার্টিফিকেটটি। ভদ্রলোক কথা কম বলছিলেন, তাই এই সুযোগে আমি বললাম- দেখেন, আমি তৃতীয় বিশ্বের একজন ছাত্র। এসেছি এখানে পড়াশোনা করতে। আর আপনারা যদি আমাকে ভিসা না দেন, তাহলে তো আমার মত তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষার্থীদের উন্নত বিশ্ব থেকে শিক্ষা নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
সাথে আরও বললাম, তাহলে আমাদের অন্ধকারের মধ্যে আবারও ঠেলে দেওয়া হবে। ভদ্রলোক তখনও আমার কাগজগুলো দেখছিলেন, আর মনে হয় সিদ্ধান্তের জন্য সময় নিচ্ছিলেন। আমাদের কথাবার্তা প্রায় ২০ মিনিট চলেছে এবং সম্পূর্ণ আলোচনাই হচ্ছিল ইংরেজিতে।
২০ মিনিট পর তিনি টেলিফোন ওঠালেন। ডায়াল করে কাকে যেন কী বললেন জার্মান ভাষায়। আমি কিছুই বুঝিনি যদিও। মিনিট দুইয়ের মধ্যে দেখি সেই ৩১৩ নম্বর রুমের মহিলা অফিসার ঘরে ঢুকলেন।
আমি বুঝতে পারলাম যে এবার কিছু একটা ইতিবাচক হতে যাচ্ছে। তাই আমি শুধু ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ না, সাথে জার্মান ভাষায় ‘ডানকে শোন’ বলে মহিলাকে অনুসরণ করলাম। আর ভাবছিলাম, আবার সেই আতঙ্কের ৩১৩ নম্বর কক্ষ!
কিন্তু না, সেই ঘরে ঢোকার পর তার পুরুষ সঙ্গীর সাথে মহিলার যেন কী কথা হলো। তারপর দেখি দৃশ্যপটের বিরাট পরিবর্তন। এবার তারা শুরু করলেন আমার সাথে অমায়িক ব্যবহার। মনে হলো, তারা এখন ভদ্রলোকের থেকে দ্বিগুণ ভদ্রলোক হয়ে গেছেন।
মহিলা নিজেই ফর্ম বের করলেন, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করে পূরণও করলেন। আর আমাকে বললেন, আমি যেন ওই ফরমের নির্দিষ্ট জায়গায় একটা সাইন করি। আমি সই করলাম, তারপর আমার পাসপোর্ট চাইলেন। আমি পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম, তিনি একটা বড় সিল বের করে পাসপোর্টের একটি খালি পাতায় বসিয়ে দিলেন এবং মেয়াদ লিখে দিলেন।
তার মানে, এটাই হলো আমার জার্মানির প্রথম ভিসা, যার মেয়াদ ছিল ৬ মাসের। তারপর পাসপোর্টটি আমার হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে আমি যেন আবার ওখানে গিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি করিয়ে নিয়ে আসি।
আমি খুশি হয়ে মনে মনে বললাম, আমার যেন আর কোনদিন তোমাদের চেহারা দেখতে না হয়। না, সত্যি আমার আর তাদের চেহারা দেখতে হয়নি। কেন হয়নি, সে কথা পরে বলব।
আসলে ৩১৩-এর অফিসার আমার ভিসা আবেদন নাকচ করার জন্য যখন আমাকে নিয়ে দোভাষী সাক্সেনার কক্ষে নিয়ে যান আর আমি যখন তার কথা শুনে স্বতঃস্ফুর্তভাবেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করছিলাম, তখন আমার সেই আওয়াজ খুব সম্ভবত ওই সময় করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় সেই ডিপার্টমেন্টের প্রধান শুনেছিলেন।
তাই তিনি ঘরে ঢুকে জানতে চাইছিলেন, কী হয়েছে? যখন আমি তাকে আমার কাগজগুলো দেখিয়েছিলাম, তখন তিনি আমার বিষয়টি দেখা দায়িত্ব মনে করেছিলেন। তাই তিনি আমাকে আরেকটি কামরায় নিয়ে যান। যার কাছে তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, মনে হয় তিনি ছিলেন ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বস।
ভিসা পেয়ে নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। ফেরার পথে ভাবছিলাম, মাঝে মাঝে চিৎকারেরও দরকার আছে। তবে তখন থেকেই জার্মানিতে কিন্তু আইন ছিল যে, কোন ব্যক্তি টুরিস্ট হিসেবে এখানে আসলে, সে অন্য কোন ভিসার জন্য জার্মানি থেকে আবেদন করতে পারবে না। আর করলেও সেটা নাকচ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমাদের ওই সময় কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যদি বসরা সহানুভূতিশীল হতেন, তাহলে তারা বিবেচনা করতেন। সেই বিবেচনার ফাঁকেই আমি আমার ভিসা পেলাম। ভিসা তো পেলাম, এবার শুরু হবে অন্য ধরনের জীবন সংগ্রাম।
চলবে ...
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |