জার্মানিতে ৪০ বছর: বিয়ারের স্বাদ তেতো

ফ্রাঙ্কফুর্টে এসেছিলাম ১৯৭৭ সালের ১৪ অক্টোবর। তখন থেকে সেখানকার আবহাওয়া বলা চলে ভালই ছিল বলা চলে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2017, 05:54 AM
Updated : 8 March 2017, 01:23 PM

এর মধ্যে ১৯ অক্টোবর তাপমাত্রা ১৯ ডিগ্রিতে উন্নীত হয়েছিল, তাই দেশ থেকে নিয়ে আসা ১০ টাকার ওভার কোট, ব্লেজার ও সোয়েটার দিয়েই চলেছি। কিন্তু ২০ অক্টোবরের পর আবার তাপমাত্রা নামতে শুরু করল। তাই ভাবছিলাম, আগামীতে চলার জন্য তো কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। তা না হলে এই শীত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।

সঙ্গত কারণেই চিন্তা ছিল যে আমরা যে ধরনের স্থান-কালের সাথে বেমানান পোশাক পরছি, তাতে আবার পুলিশের চেকে পড়তে পারি। তাই জ্যাকেট এবং মোটা কাপড়ের প্যান্ট কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম।

দেশ থেকে আসার সময় সবাই কিছু কিছু ডলার নিয়ে আসতো, তার একটা সাধারণ অংক ছিল তিনশ’ ডলার। কারণ, যদি ইমিগ্রেশন জানতে চায়, যাত্রীর কাছে কত ডলার আছে, তাহলে যেন সে বলতে পারে তিনশ’ ডলার বা ছয়শ’ মার্ক আছে। এর মানে, জার্মানিতে তখন তিনশ ডলার দিয়ে ২০ দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত থাকা যেত।

আমি অবশ্য প্রতিকূল অবস্থার কিছুটা আঁচ করতে পেরে সাথে এনেছিলাম ৬৫০ ডলার। ওটা আমার সে সময় সাহস জুগিয়েছে এবং কাজেও লেগেছে। এই ডলারের কিছু অংশ ভাঙ্গিয়ে আমি কিনলাম জলপাই রঙের মিলিটারি জ্যাকেট। মিলিটারি এই জন্য বলছি যে ওই জ্যাকেটে অনেকগুলো পকেট ছিল এবং মাথায় উঠানো যায় সে রকম ক্যাপও ছিল।

এই জ্যাকেট তখন ইয়াং ছেলেরা বেশ পরত, এর দাম পড়েছিল তখন ৪৫ মার্ক। আর প্যান্ট কিনেছিলাম মোটা কর্ডের কাপড়ের। এই পোশাক পরবর্তীতে শুধু শীত থেকেই রক্ষা করেনি বরং তার সাথে এই জ্যাকেটই হল পত্রিকা বিক্রির জন্য আমার পুঁজি বিনিয়োগ। কারণ আগেই বলেছি, জ্যাকেটে অনেকগুলো পকেট ছিল যা আমার পত্রিকা বিক্রি করার সময় মার্ক-পেনি রাখার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হত।

প্রতি সন্ধ্যায় ফরহাদের ঘরে আড্ডা হত, সে কথা তো আগেই বলেছি। এই আড্ডায় পুরাতনদের সাথে নতুন কোন মুখও দেখা যেত। ফরহাদ মাঝে মাঝে বিয়ার নিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে আমরাও ফরহাদ ও নিজামের সাথে দোকানে গিয়েছি, শিখতে চেষ্টা করেছি কীভাবে কেনাকাটা করা যায়। কেনাকাটা তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেছিলাম, কারণ দোকানে তো ভাষার ব্যবহার না করেও জিনিসপত্র কেনা যেত। তবে খাবার চিনতাম না, তাই ওদের সাথে প্রথম প্রথম গিয়ে জানার চেষ্টা করতাম- কোন প্যাকেট বা টিনের কৌটায় কী আছে।

জার্মানি হচ্ছে বিয়ার পান করার জাতির মধ্যে পৃথিবীতে অন্যতম। মাঝে মাঝে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জার্মানরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিয়ার পান করেন। জার্মান ভাষায় বিয়ারকে ‘বিয়ের’ বলে, শুধু উচ্চরণে একটু পার্থক্য।

আমাকে আর রশিদকে ফরহাদ সব সময় বিয়ার অফার করত, কিন্তু আমরা পান করতে চাইতাম না। আর সেলিম তো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী, ও তো এগুলো কিছু ধরবেই না। তবে এটা ঠিক যে জার্মান যাত্রার শুরু থেকে সেলিমের আর নিয়মিত নামাজ পড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরবর্তীতে সে আবার এটাকে নিয়মের ভেতর নিয়ে এসেছিল।

জার্মানি যাওয়ার আগে আমি ঢাকায় একদিন বিয়ার আর দু’দিন ভদকা পান করেছিলাম। ফরহাদের অনুরোধে মাঝে মাঝে ছোট গ্লাসে করে আমি একটু বিয়ার নিতাম, কিন্তু মুখে নিলে কেমন যেন তেতো তেতো মনে হত। তখন ভাবতাম, এই জিনিস এদের বা যারা পান করে তাদের কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠে কীভাবে? যদিও পরে ড্রিংকসের মধ্যে বিয়ারই আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আমাদের চারজনের গ্রুপে যেমন ছিল নিলুর মত দুর্ধর্ষ ছেলে, আবার ছিল সেলিমের মত অনেকটা গোবেচারী ছেলে। আর রশিদ ছিল ডানপিটে ছেলে। তাই ওর সাথে নিলুর সম্পর্ক বেশি ছিল আর আমি ছিলাম এই দুই বিপরীতমুখী চরিত্রের মাঝামাঝি থেকে যোগাযোগ রক্ষা করার একজন। আমার এই ভূমিকা হিসেব করলে দেখা যাবে, চেতন বা অবচেতন মনে সারাজীবনই আমি এই ভূমিকাই পালন করে চলেছি।

সেলিমের সাথে আমার পরিচয় হয় ইন্টারমেডিয়েটের পর থেকে। ও থাকতো গেণ্ডারিয়া এলাকায়, রশিদদের বাড়ির কাছেই। সেই সুবাদেই মনে হয় ওর সাথে আমার যোগাযোগ হয়। পরিচয়ের প্রথম পর্ব থেকেই মনে হয় ও আমার উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছিল। আর বুয়েটের জীবনে আমাদের নৈকট্য তো আরও বেড়ে গেল। কারণ আমরা পড়তাম একই ডিপার্টমেন্টে।

যেহেতু আমরা তখন থাকতাম লক্ষ্মীবাজারে একেবারে রাস্তার উপর একটি বাসায়, আর সেলিম গেণ্ডারিয়ায়, তাই ও বাসা থেকে বেরিয়ে কাঠের পুল পার হয়ে রিক্সা নিয়ে আমাদের বাসার নিচে থেমে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেত। ফেরত পথে একইভাবে আমাদের বাসার সামনে এসে আমি নেমে যেতাম। এই ভাড়া অবশ্য আমরা ভাগাভাগি করেই দিতাম। ওর অনেক গুণের মধ্যে এটাও ছিল যে সে বিয়ার বা মদের আড্ডায় বসে থাকতে পারত। তবে হতে পারে, তখন হয়ত ওর এর বিকল্প অন্য কিছু ছিল না।

মাঝে মাঝে আমি যখন আমার প্রায় ৪০ বছরের আগের দিনে চলে যাই, তখন ভাবি- আমি নাহয় এই অনিশ্চিত জার্মানির পথে যাত্রা করেছিলাম, কিন্তু সেলিম কীভাবে এই পথে যাত্রা করেছিল? সেই স্কুল জীবন থেকেই আমরা কয়েকজন গেণ্ডারিয়া ধুপখোলা মাঠে প্রায় প্রতিদিনই আড্ডায় বসতাম। আমার সাথে সেলিমের পরিচয় হওয়ায় সেও আমাদের সাথে বসা শুরু করে। ওখান থেকে যখন সে জানতে পারে রশিদ আর আমি জার্মানি যাচ্ছি, তখন সে বলে উঠল- সেও যাবে।

ওদের মত রক্ষণশীল পরিবার থেকে এভাবে বের হওয়া ছিল অকল্পনীয়! তবে ওর বাবা তাকে এমনিতেই ছাড়ে নাই। একদিন তিনি সেলিমকে দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পর বললেন, দেখ আমি সেলিমকে এভাবে কখনই যেতে দিতাম না, কিন্তু যখন ও বলল যে তুমি যাচ্ছ তখন আমি মত দিয়েছি। এভাবেই সেলিম আমাদের সহযাত্রী হয়েছিল।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash.bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!