জার্মানিতে ৪০ বছর: ম্যাজিস্ট্রেট ও দোভাষীর খপ্পরে

সেদিন ‘ফ্রাঙ্কফিউটার রুন্ডশাও’ পত্রিকার হকারদের বিক্রি কেন্দ্রে যাওয়ার পর ভাবছিলাম, ওটাই হবে আমার ভবিষ্যৎ কর্মস্থল। তারপর অবশ্য অনেকদিন সেখানে যাওয়া হয়নি।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2017, 01:05 PM
Updated : 28 March 2017, 01:05 PM

এদিকে আমি অপেক্ষা করছি আমার ঢাকা থেকে স্পন্সরের কাগজের জন্য। দিন দুই পর আসলো আমার বহু প্রতীক্ষিত পত্র। বাবা পাঠিয়েছেন স্পন্সরের কাগজ আর আমার চতুর্থ বোন দোলন আপা পাঠিয়েছেন বেশ বড় করে একটি পত্র। পত্র পড়ার শুরু থেকে বুঝতে পারলাম, আমি জার্মানি চলে আসার ও আমার প্রথম চিঠি পাওয়ার পর পরিবারে বেশ আলোচনা হয়েছে। আর হবেই বা না কেন, আমি হচ্ছি পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে, ভাই বোনদের মধ্যে ১০তম। তাই ছোটবেলা থেকে স্নেহ, ভালবাসা মনে হয় একটু বেশিই পেয়েছি।

বোন লিখেছিলেন, তার যতটুকু ৪০ বছর পর মনে আছে তার সারাংশ বলি। চিঠিতে লেখা ছিল- তুমি কারো কথা না শুনে জার্মানি গিয়েছ, এখন বুঝতে পারছ যে তুমি একটি বৈরি পরিবেশ এবং পরিস্থিতিতে পড়েছ। মা-বাবা ছাড়া ভাই-বোনদের আর কারো মত না যে তুমি এভাবে ফিরে আস। তুমি ছাত্র হওয়ার কথা বলেছ, তার জন্য টাকার দরকার। তবে আমরা তোমাকে জানাতে চাই যে আগামী ৯ মাস পর্যন্ত তোমাকে তোমার এই প্রাথমিক অবস্থায় চলার মত খরচ পাঠাতে পারবো। যদি তুমি মনে কর এই অর্থ দিয়ে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, তাহলে চেষ্টা কর। কিন্তু যদি মনে কর এটা যথেষ্ট নয়, তবে ভাল করে ভেবে দেখতে পার।

এদিকে তো আমি পত্র লেখার কয়েকদিন পর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি লড়াইয়ের ময়দানে এসে পেছনে দৌড় দেব না। যতটুকু পরিশ্রম করতে হয় করবো, তারপরও স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবো। আর এই কথাও আমি আমার প্রথম পত্র পাঠানোর পর কয়েকদিনের মধ্যে দ্বিতীয় পত্রে বাসায় জানিয়েছিলাম।

পত্রিকা অফিস ঘুরে এসে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আগত এতগুলো শিক্ষিত ছেলে যদি পত্রিকা বিক্রি করে পড়াশোনার খরচ চালাতে পারে, তবে আমি পারবো না কেন? কিন্ত তখন আমার ভয় ছিল পরিশ্রমের জন্য নয়, ঠাণ্ডার জন্য।

তখন মাত্র অক্টোবরের শেষ পর্যায়। এই সময় যে শীত দেখছি, তাহলে সামনে পড়ে আছে যে দীর্ঘ শীতকাল, তখন কী অবস্থা হবে? সেগুলো জরুরি ভাবনা হলেও তার থেকে বেশি চিন্তার বিষয় ছিল, আমার ভিসা। আর এই ভিসা ছাড়া তো কোন কিছুই করা সম্ভব নয়।

স্পন্সরের কাগজ আসার পর ছাত্র ভিসা আবেদনের কাগজের দিক থেকে সম্পূর্ণ হলো। অনেক অসুবিধার মাঝে তখন সুবিধা ছিল যে দেশের থেকে স্পন্সর তারা গ্রহণ করতেন এবং দেশে যিনি স্পন্সর করছেন তার কোন ব্যাংক-ব্যাল্যান্স দেখতে চাইতেন না। এবার যখন সব কাগজ গুছানো হয়েছে, সুতরাং এখন আবার পুলিশ অফিসে যাওয়া যায়।

পরের দিন সকালের দিকে আবার সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ১১ নম্বর ট্রামে করে ৩২১ নম্বর মাইঞ্জার ল্যান্ড স্ট্রিটের দিকে যাত্রা করলাম। সেখানে পৌঁছে আমার নামের শেষ অংশের প্রথম অক্ষর অনুযায়ী কক্ষের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম।

যতদূর মনে পড়ে, রুমটির নম্বর ছিল ৩১৩। সেখানে তেমন কোন ভীড় ছিল না, তাই কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পড়লো। ভেতরে ঢুকে দেখি সেখানে দু’জন বসে আছেন। তাদের একজন মহিলা আর অপরজন পুরুষ। আমি তাদের মধ্যে মহিলাকে আমার কাগজ দেখালাম। মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট দেখে যেন কিছু বললেন, কিন্তু তার এই জার্মান ভাষা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

তারপর তিনি পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেটকে কাগজগুলো এগিয়ে দিলেন। উনি মনে হয় কিছুটা ইংরেজি জানতেন। আর এই কাগজগুলোর মধ্যে একমাত্র স্পন্সরের কাগজটি ছাড়া বাকিগুলো ছিল জার্মান ভাষায়, যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, ভাষা স্কুলে ভর্তি ও স্বাস্থ্য বীমার সার্টিফিকেট।

ভদ্রলোক দেখলেন এবং কাগজ দেখে মনে হল তিনি বিরক্ত হলেন। আমাকে বললেন, আপনি এখানে এসেছেন পর্যটক হিসেবে, সুতরাং আপনি স্টুডেন্ট ভিসা পাবেন না। যদি আপনি স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে চান, তাহলে আপনাকে দেশে থেকে করতে হবে।

তার কথা শুনে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। এত দূরে একটি দেশে আসা, গত দুই সপ্তাহ ধরে পরিশ্রম করে, ৪৩০ মার্ক খরচ করে ভাষা স্কুলে ভর্তি হওয়া, স্বাস্থ্য বীমা করা, আর এখন যদি ফিরে যাই- তাহলে তো সব বৃথা! সেই ম্যাজিস্ট্রেট কথাটি বলেই আমাকে বললেন, তার সাথে যেতে। আমি কাগজগুলো নিয়ে তাকে অনুসরণ করলাম। অনুসরণ করার সময় বুঝিনি যে তিনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

তিনি কয়েকটা কক্ষ পার হয়ে একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে গিয়ে দেখলাম, একজন ভারতীয় নাগরিক বসে আছেন। এবার বুঝলাম, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে একজন দোভাষীর কাছে নিয়ে এসেছেন। কারণ আমাকে যে কথাগুলো তিনি তার রুমে বলেছেন, সেই কথাগুলো দোভাষীর মাধ্যমে ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।

এরপর ম্যাজিস্ট্রেট এক দোভাষীর সাথে কথা বললেন। তখন দোভাষী হিন্দিতে বললেন, তোমাকে স্টুডেন্ট ভিসা দেবে না।

তারপর দোভাষী নিজের কথা দিয়ে আমাকে বোঝানোর জন্য হিন্দিতে বললেন,  “আরে ইয়ার, তুম তো ইধার আয়া পয়সা কামানে কে লিয়ে। কই ওয়াকিল কে পাছ চালা যাও, আজুল লে লাও।” এখানে তখন রাজনৈতিক আশ্রয়ের সংক্ষিপ্ত শব্দকে বিদেশিরা ‘আজুল’ বলতেন। তার মানে- “তুমি তো এখানে এসেছ টাকা কামানোর জন্য। তাই কোন উকিলের কাছে গিয়ে কাগজ নিয়ে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করো।”

এমনিতেই আমি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘর থেকেই হতাশা আর রাগে ফুসে আছি, তাই মনে হয় আমি আমার স্বভাব সুলভ আচরণের বাইরে গিয়ে অনেকটা চেচিয়ে ইংরেজিতে বলে উঠলাম, “না, আমি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য এখানে আসিনি। আমি এসেছি পড়াশোনা করতে।”

এবার ম্যাজিস্ট্রেট দোভাষী দিয়ে জিজ্ঞেস করালেন, এখানে পড়াশোনা করতে হলে তো অনেক টাকার দরকার, আপনার কাছে কত টাকা আছে?”

আমার কাছে তখন ছিল সাড়ে তিনশ’ ডলার মানে সাতশ’ মার্কের মত। আমি বাড়িয়ে বললাম, আমার কাছে ১ হাজার ৮০০ মার্ক আছে। দোভাষী আর ম্যাজিস্ট্রেট দু’জনেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, এই টাকা তো তিন মাসের খরচের টাকা।

আমি বললাম, তারপর তো আমার স্পন্সর টাকা পাঠাবেন। আমি তখন ভিসা পাওয়ার জন্য সত্যি-মিথ্যে, যেটাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করছিলাম, সেটাই বলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে হলো ম্যাজিস্ট্রেট আমার কথায় কর্ণপাত করছেন না।

আমার সব কাগজগুলো ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ছিল, সেই কাগজগুলো আমার কাছে ফেরত দিল। অনেকটা ছুঁড়ে দেওয়ার মত। তাই আমি সবগুলো ঠিকমত হাতে না নিতে পারায় কাগজগুলো মেঝেতে পড়ে গেল। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

আমি কাগজগুলো মেঝে থেকে উঠানোর সময় ভাবছিলাম, এবার আমার ছাত্র ভিসার আবেদন চূড়ান্তভাবেই নাকচ হয়ে গেল। তার মানে আমার জার্মানিতে ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো।

চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-