সময় যেন এদিক-সেদিক ছুটছিল কেবল। অধরচন্দ্র স্কুল থেকে এনাম হসপিটাল। সেখান থেকে রানা প্লাজা, তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল। সাভার সিএমএইচ। কোথাও নেই সঞ্জিত।
Published : 24 Apr 2024, 02:52 PM
সঞ্জিত বেঁচে থাকলে ওর বয়স হতো বত্রিশের কাছাকাছি। মানে আমার থেকে একটু বাড়িয়ে বললাম। ছোটবেলা থেকে আমাদের সংসারে জন্ম নিবন্ধনের কোনো রেওয়াজ ছিল না। তাই আমরা কেউই আমাদের সঠিক জন্মদিন জানি না। আমাদের মা-বাবা, বড় ভাই কারোরই না। এই যে লিখছি, এই লেখাটিও আমাদের আগের প্রজন্ম পড়তে পারত না। এখন অবশ্য কয়েকজন আছে যারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে।
আমাদের জন্ম তারিখ এসেছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তির কাছ থেকে। কারটা কোথা থেকে এসেছে আমি জানি না। তবে আমার প্রাতিষ্ঠানিক জন্মদিনটা এসেছে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনু দিদিমণির কাছ থেকে।
অনু দিদিমণি আমার জীবনের এক মহাগল্প, সেই গল্প আরেকদিন করা যাবে। আজ করব আমার ভাইয়ের গল্প। আমার বন্ধুর গল্প। আমার দরদ মাখানো সেই ভাই, তার গল্প।
আমি আর সঞ্জিত মোটামুটি দুই বছরের বড় ছোট। রীতি অনুযায়ী বড়দের দাদা, ছোড়দা (ছোট দা) মেজদা (মেজো দা) বলার কথা থাকলেও সঞ্জিতকে আমি আজীবন নাম ধরে ডেকেছি। আমাকে কতবার চেষ্টা করানো হয়েছে তাকে দাদা ডাকতে, অথচ কেন জানি কখনো ডাকাই হলো না।
অবশ্য কখনো ইচ্ছেও করেনি। বড় হয়েছি একসাথে। একসাথে আমরা সব করেছি। হাওরে গরু চরানো থেকে শুরু করে একসাথে ঘুমানো, খাওয়া-দাওয়া সবকিছু করেছি একসাথে।
কোনো একসময় সঞ্জিত পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তারপর দুই বছর বিরতি দিয়ে আমরা কিছুদিন একসাথে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশুনা করেছিলাম। আমি ওকে কিছুটা অংক করাতাম, মাঝে মাঝে এ বি সি ডি পড়াতাম। যদিও আমিও পারতাম না। মানে আমার থেকে ও কিছুটা কম পারত।
বড় হয়ে সিটকম সিরিজ ইয়াং শেল্ডন দেখে আমার খুব সঞ্জিতের কথা মনে পড়ত। ও বেঁচে থাকলে হয়ত আমরা কোনোদিন একসাথে এই সিরিজটি দেখতাম।
আমি নিজেও ইংরেজি বর্ণমালা ভালো করে শিখেছি ক্লাস থ্রি-ফোরে। কিন্তু মনে আছে একবার আমরা একসাথে প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। কিছুটা অনৈতিকতাও করেছিলাম বোধহয়। মানে আমি তাকে হেল্প করেছিলাম। এখন সব খুব স্পষ্ট মনে পড়ে না। তারপর কীভাবে যেন সে আর পড়াশোনাটা করল না।
ঠিক কোন বছর আমার মনে নেই, তবে সঞ্জিত যখন পড়াশোনা ছেড়ে দিল, ওই সময়ের কাছাকাছিই হবে। বাবা ওকে দিরাই উপজেলা সদরে (সুনামগঞ্জ জেলা) একটা মুদি দোকানে দিয়ে এলেন। এসব মুদি দোকানে কিছুদিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলে নাকি ‘অনেক কিছু’ শেখা যায়। এখন যেমন আমরা আনপেইড ইন্টার্নশিপ করি, তেমন। মানে বিনা পারিশ্রমিকে খাটানো। তারপর একদিন বড় হয়ে এমন একটা দোকানের মালিক হওয়া যাবে— এমনই একটা অতি সাধারণ গল্প। সেই ভরসায় সঞ্জিতকে রেখে আসেন বাবা।
কয়দিন হল! দুই/তিন দিনের বেশি না। তখন বর্ষাকাল। আমাদের বাড়ি থেকে এক ঘণ্টার নদীপথ বয়ে উপজেলা সদরে আসতে হতো। আমি সকালে কোনো এক কাজে (সম্ভবত বই/খাতা কিনতে) বাজারে যাই। সারাদিন কী করেছি কিছুই মনে নেই। কেবল মনে আছে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে, কোনো এক সময় ওই দোকানের মালিককে দেখেছি সঞ্জিতকে হালকা একটু ধমকের সুরে কথা বলতে। সেটা দেখে আমার কি কান্না! সেই কান্না শেষপর্যন্ত গড়াল সঞ্জিতকে নিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত। এরপর আর সে ওই দোকানে যায়নি।
আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি, সঞ্জিত সুনামগঞ্জে একটা সেলুনের দোকানে দীর্ঘদিন কাজ করে নিজেই একটা দোকান দিয়েছে আমাদের উপজেলায়। ভালোই কি চলছিল? জানতাম না আমি। তখন আমি সিলেটে, কলেজে পড়ি।
আমাদের সংসার তখন খুব একটা ভালো চলছিল না। এটা সেটা দশটা কাজ করেও বাবার গোছানো সংসারে টানাপোড়েন যাচ্ছিল। এর আগের কয়েক বছর একবার বন্যা, পরেরবার খরা— এভাবে কাটছিল। এদিকে কলেজে পড়ার জন্য আমাকে সিলেটে থাকতে হয়। পরিচিত এক লোকের কাছ থেকে তখন আমি দেড়া সুদে (ধারের টাকার দেড়গুণ দিতে হতো) খরচের টাকা নিতে থাকি। আর মাঝেমধ্যে সঞ্জিতের কাছ থেকে নিতাম হাত খরচের টাকা।
তখন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কম খরচে টাকা-পয়সা আনানো যেত। একবার খুব প্রয়োজনে সঞ্জিত আমাকে এক হাজার টাকা পাঠায়। ওই টাকার রশিদ কীভাবে যেন আমার কাছে রয়ে গেল। বহু বছর সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে কতদিন থাকবে জানি না। এই রশিদ আমাকে সঞ্জিতের সঙ্গে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ১৩ ডিজিটের এই কোড নম্বরটিই (সম্ভবত) এখন সঞ্জিত হয়ে আমার সঙ্গে রয়ে গেছে।
একসময় দেড়া সুদের ধারের টাকা বাড়তে বাড়তে লাখ দেড়েক টাকা হলো। এদিকে টানা দুইবছর ফসল ভালো না হওয়ায় সেই টাকা শোধ করাও দায় হয়ে দাঁড়াল। তারপর কতকিছু পেরিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে বাবা পাড়ি জমালেন ঢাকা। নিজেদের মাড়াই মেশিন, গরু, নৌকা সব বিক্রি করে অর্ধেক টাকা শোধ করা গেছিল বটে, বাকি অর্ধেক টাকা দিতে হয়েছিল সঞ্জিতের মৃত্যুর পর।
প্রথমে কিছুদিন নারায়ণগঞ্জে থেকে, পরে সাভারে চলে যান বাবা। আমি তখনও অতশত বুঝি না। কেবল পড়াশোনা করছি, সংসারের জোয়াল আমাকে বইতে হয় না। বাবা আর অন্যরা মিলে নিজেরা নিজেদের মতো করে গোছালেন, মানে গোছানোর চেষ্টা করলেন। বাবা, সঞ্জিত আর আমাদের বড় ভাই কাজ নিলেন গার্মেন্টস কারখানায়।
এক ছন্নছাড়া মানুষ আমার বড় ভাই। তার ছিল পৃথিবী ঘুরে দেখার সাধ। কিছুটা দেখেছেনও। একবার কাউকে না বলে সে চলে যান ভারতে। দেড়-দুই বছর সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসেন। ভাইয়ের কাছে ওই দেশের পাহাড়ি জীবনের গল্প অনেক শুনেছি।
আমাদের সংসারে নারী-পুরুষের তেমন ভেদাভেদ ছিল না। জন্মের পর কৃষিকাজ থেকে রেহাই পেতে কিংবা ভেজা বর্ষায় মাছ ধরতে যাওয়া থেকে মুক্তি পেতে আমি কিছুটা পড়াশোনার ভান করতাম। তারপরও মৌসুমে কাজে যেতে হতো। দেখতাম মা কীভাবে ঘরের সব কাজ করে আমাদের নিয়ে যেতেন জালাখেতে (ধানক্ষেতের প্রথম ধাপ), সেখানে থেকে জালা উপরে রোপন করতে হত। সেখানে গিয়ে দিন-রাত কাজ করত আমার মা।
ঢাকায় যখন এলেন, মায়ের বয়স হয়ে গেছে। পরিবারের কাউকে না বলে তিনি ছাত্রদের একটা মেসে রান্না করতে যেতেন। আমাকে কেউ কিছু বলত না। একদিন বৌদি (বড় ভাইয়ের বউ) আমাকে মায়ের কাজ নেওয়ার খবরটা দিলেন।
সেদিন মেনে নিতে আমার বড্ড কষ্ট হয়েছিল। এই ভেবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম যে অন্যকে খাওয়ানোর মতো মহান কাজটি আমার মা করছে। তবে এর পেছনের গল্পটা জানি কেবল আমি। আমিও একটা সময়ের পর বড় হয়েছি অন্যের মায়ের হাতের রান্না খেয়ে।
ভাইয়ের গল্পে ফিরি। ২০১৩ সাল, আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলে। মানোন্নয়ন পরীক্ষা। আগের বছর ভালো পরীক্ষা দিতে পারিনি, তাই ভাবলাম মানোন্নয়ন দিয়ে যদি কিছু হয়।
২৩ এপ্রিল খুব সকালে সঞ্জিতের সাথে কথা হয় মোবাইলে। আমি তখন বন্ধুর থেকে ধার করা একটা সনি এরিকসন মোবাইল চালাই। ভাইয়ের সাথে আমার কথার সারমর্ম হলো, সেদিন তার কারখানায় ছুটি দিয়ে দিয়েছে, কারণ ভবনে নাকি ফাটল ধরেছে।
আজ তো ছুটি, কাল আবার কারখানা খুলবে? সঞ্জিত কী বলেছিল এখন আর আমার মনে নেই। তবে গার্মেন্টস ছুটি দেওয়ায় ওর যে উচ্ছ্বাস ছিল, সেটা আমার আজও মনে পড়ে। তবে আমি জানতাম না, ভাইয়ের সাথে আর কখনো কথা হবে না আমার।
২৪ এপ্রিল। সকালবেলা এলো বাবার ফোন। আমার শুধু মনে পড়ে, বাবা বলছিলেন, সঞ্জিতের গার্মেন্টস ভবন ভেঙে পড়ে গেছে। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমার চারপাশে সব যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো থ হয়ে রইলাম। বুকের মধ্যে হাহাকার করে কান্না এলো।
কী করার আছে আমার? কী করতে হয়? কিছুই তো জানা নেই।
এক প্রতিবেশী বড় ভাইয়ের সাথে রওনা দিলাম ঢাকায়। আমার জীবনে দ্বিতীয়বার ঢাকা ভ্রমণ। প্রথমবার এসেছিলাম একটা পুরস্কার নিতে। এবার যাচ্ছি ভাইয়ের খোঁজে।
সময় যেন এদিক-সেদিক ছুটছিল কেবল। অধরচন্দ্র স্কুল থেকে এনাম হসপিটাল। সেখান থেকে রানা প্লাজা, তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল। সাভার সিএমএইচ। কোথাও নেই সঞ্জিত। আবার উড়ো খবর আসে, সঞ্জিতের মতো কাউকে নাকি দেখা গেছে! বেঁচে আছে? মায়ের মনে হচ্ছিল, হাত-পা ভাঙা হলেও ছেলেটা তার বেঁচে আছে। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই ঠিক হলো না।
১৩ দিন পর পাওয়া গেল সঞ্জিতের গলে যাওয়া বিমূর্ত লাশ।
সেদিন ভোরে যখন ট্রাকে করে লাশ নিয়ে এসে অধরচন্দ্রের মাঠে ফেলে যাচ্ছিল, ওই সময়ে কেন জানি বড় ভাইয়ের মনে হল, সঞ্জিতকেও নিয়ে আসা হবে। খুব সকালে ঘর ছেড়ে মাঠে গিয়ে একটা ট্রাক দেখিয়ে পরিচিতদের বলতে লাগল, এই খ্যাপে আমার ভাইয়ের লাশ নিয়ে আসা হয়েছে। আর তাই সত্যি হলো!
গলে ফুলে ওঠা লাশটা চেনা গেল গায়ের কাপড় দেখে। তারপর আইডি কার্ড— পরিচিত অনেক কিছু।
তারপর ২০ হাজার টাকা।
“লাশ আপনাদের নিশ্চিত কিনা।”
“কীভাবে বুঝলেন।”
“প্রমাণ কী?”
নানা ধরনের প্রশ্ন শুনে মনে হলো লাশটা না নিলে যদি প্রশাসনের ২০ হাজার টাকা কম খরচ হয়, তাহলে বরং আমরা লাশ না নিই! কিন্তু মায়ের হৃদয়, বাবার মন সইল না। সব কথা শুনে, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে, যুক্তি তর্ক দিয়ে আমরা পেলাম আমাদের ভাইয়ের লাশ। কারও ছেলের লাশ।
সংসারের সবাই তখন একসাথে। ঘরে খাওয়া নেই। কারও ঘুম নেই।
আমাদের পরিবারের ঢাকা আসার পেছনে সবচেয়ে অনাগ্রহ ছিল সঞ্জিতের। ওর মৃত্যুর পর বাবাকে কতবার বলতে শুনেছি, ছেলের মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী!
একদিন মা বলছিলেন সঞ্জিতের মৃত্যুর জন্য নাকি তিনি দায়ী। কারণ ওইদিন সকালে যখন সঞ্জিত বারবার খেতে দেওয়ার জন্য বলছিল, তখন তার নাকি উচিত ছিল রান্নায় দেরি হবে বলে ছেলেকে আটকে রাখা!
মায়ের আফসোস, কেন তিনি ছেলেকে সেদিন কাজে যেতে নিষেধ করলেন না। তার নাকি মনে কু ডাকছিল, কিন্তু জোর দিয়ে কিছু বলতে পারেননি। সঞ্জিত যুক্তি দিয়েছিল, যদি কারখানা খোলে, আর সে যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে ৩১ দিন টানা কাজ করলে যে বোনাসটা (পরিমাণটা জানি না) দেয়, সেটা আর পাবে না। সাথে ওইদিনের বেতন কাটা যাবে, চাকরিও চলে যেতে পারে।
মায়ের অনুশোচনা, এই টাকার কথা ওঠাতেই নাকি তিনি সেদিন ছেলেকে বেশি জোর করতে পারেননি। তবে শুনেছি, সেদিন না গেলে ছাঁটাই করার কথা বলা হয়েছিল। কেউ কেউ কি সেদিন কারখানায় না ঢুকে চলে এসেছিল? এসেছিল বোধহয়! আমি জানি না।
অনুশোচনা আমারও তো কম নয়। আমার ধারের টাকা শোধ দিতে গিয়ে পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে সাভারে আসতে হল। সঞ্জিতকে কাজ নিতে হল গার্মেন্ট কারখানায়।
আমার ভাই, আমার বন্ধুর মৃত্যুর জন্য কি আমিই দায়ী নই?