সহনীয় করে আনতে হবে আগ্রাসী হয়ে ওঠা গ্রীষ্মের প্রভাব। প্রয়োজনমতো বৃষ্টি না হলে জমিতে সেচ সুনিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। আর তাপপ্রবাহে গ্রাম কেন ব্যতিক্রমহীনভাবে লোডশেডিংয়ের শিকার– জরুরি এ প্রশ্নও তুলতে হবে।
Published : 30 Apr 2024, 05:17 PM
বৃষ্টি হলে তার নিয়মেই হবে। তবে এ মুহূর্তে বৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন কিনা, সে বিষয়ে অনেকেই দিচ্ছেন নেতিবাচক মত। তারা বলছেন, কৃষকের ধান উত্তোলনের পর বৃষ্টি হোক। যেসব কৃষকের ধান এরই মধ্যে পেকে গেছে, তারাও চাইছেন এ মুহূর্তে বৃষ্টি– বিশেষত ঝড় বা শিলাবৃষ্টি না হোক।
দেশের সব অঞ্চলে তো তাপমাত্রা এক রকম নয়। একই সময়ে সিলেট বেল্টের অনেক স্থানে তাপমাত্রা কিন্তু সহনীয়। থেকে থেকে সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে বলেও তাপমাত্রা খুব বাড়ছে না। তবে আবহাওয়ার এ প্রবণতা পেকে আসা ধানক্ষেত মালিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এ অবস্থায় খবর মিলল বড়লেখার হাওর এলাকায় আধাপাকা ধানও কেটে ফেলার। এমন ঘটনা নিশ্চয় আরও রয়েছে। তাদের আশঙ্কা– প্রবল বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলে ফলানো ধানের একটা বড় অংশ হারাতে হতে পারে।
বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে এবার বোরোর আবাদ হয়েছে বেশি; ফলনও ভালো। সিংহভাগ ধান কাটা সম্পন্নও হয়েছে। বৃষ্টিবাদল এড়িয়ে বাকি ধান উত্তোলন হয়ে গেলে আমরা সবাই খুশি হই। তবে হাওরাঞ্চলই তো বাংলাদেশ নয়। ধান-চালের সিংহভাগ উৎপাদনও এর বাইরেই হয়ে থাকে। সেখানে যারা দেরিতে আবাদে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকের ধান এখনও পেকে ওঠেনি। ৮০ শতাংশ না পাকলে কৃষি কর্মকর্তারাও সাধারণত ধান কাটতে বলেন না। এ অবস্থায় যাদের ধান পাকতে আরও কিছুদিন লাগবে, তাদের ক্ষেতে (বৃষ্টি না হলে) সেচ দেওয়া প্রয়োজন। গ্রীষ্মের দাবদাহে তাদের অনেকের ক্ষেত গেছে শুকিয়ে; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেটে চৌচির হয়ে।
কৃষি কর্মকর্তারাই তাদের বলছেন সেচ দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি জমিতে ধরে রাখতে। নইলে ধান ‘চিটা’ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। কথা হলো, যশোরের মতো কোনো কোনো অঞ্চলে পানির স্তর এত নিচে চলে গেছে যে, সাধারণ নলকূপে তা উত্তোলন করা যাচ্ছে না। শক্তিশালী পাম্প ব্যবহার করতে হচ্ছে। দাবদাহ শুরুর পর আবার বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে আরও। বেশি বেশি লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আর অবধারিতভাবেই যেন গ্রামকে করতে হচ্ছে বঞ্চিত। সেচে অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ মিলছে না। এ অবস্থায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে, যার দাম অনেক বেশি। এতে তাদের উৎপাদন খরচ অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যাচ্ছে– যাদের ফসল এখনও পাকার অপেক্ষায়। তাদের নতুন করে কীটনাশকও দিতে হচ্ছে।
এ সময়টায় বৃষ্টি হলে তারা কিন্তু উপকৃত হতেন। প্রয়োজনের সময় এক-একটি বৃষ্টিপাতে কৃষকের সেচ খরচ কত বেঁচে যায়, তা কি আমরা জানি? আমন মৌসুমটা মোটামুটি বৃষ্টিনির্ভর বলে তার খরচ কম লাগে। আর বোরো মৌসুমকে বলাই হয় ‘উপকরণ-নির্ভর’। এ সময়ে কৃষি সহায়তা বাবদ সরকারের ভর্তুকি ব্যয়ও অনেক বাড়ে। কৃষক অবশ্য এর ভালো প্রতিদান দিয়ে চলেছে। জিডিপিতে কৃষির অবদান এ মুহূর্তে সেরা এবং ধারাবাহিকভাবে সন্তোষজনক। শুধু ধান-চাল নয়; যেসব ফসল খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জরুরি, সেগুলোর উৎপাদনে বড় সাফল্য দেখিয়ে চলেছে কৃষক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সময়ে সময়ে তাকে বড় প্রতিকূলতাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যেটা আসছে মূলত বিরূপ প্রকৃতির দিক থেকে। এর একটি হলো তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে বহাল থাকা। দেশের আরও বেশি অঞ্চলে এটা বিস্তৃতও হচ্ছে। এবার যেমন সিলেট বিভাগের বাইরে সারা দেশেই কমবেশি অসহনীয় তাপপ্রবাহ বইছে। মানুষ ও পশুপাখি এটা সহ্য করতে পারছে না; কৃষিতেও পড়ছে সুগভীর প্রভাব। শুধু ধান নয়; এ সময়ে আরও কত ফল-ফসল উৎপাদনে নিয়োজিত থাকে কৃষক! দেশে কিছু পরিমাণে ভুট্টা, এমনকি সয়াবিনও চাষ হচ্ছে। এটা আম, লিচু ও কাঁঠালের মতো গ্রীষ্মকালীন ফল উৎপাদনেরও সময়। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁসহ বেশ কিছু এলাকায় বহু মানুষ আমবাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকে এখন। টানা তাপপ্রবাহে তাদের অনেকে আমের ফলন নিয়ে আছেন তীব্র হতাশায়। এমনিতেও আমের ভালো দাম না পেয়ে অনেকে জমির ভিন্ন ব্যবহারে যাচ্ছেন। এর মধ্যে যারা এখনও লেগে আছেন, তাদেরও কিন্তু বলা হচ্ছে বৃষ্টি না হলে বাগানে সেচের ব্যবস্থা করতে। পাহাড়ে, বিশেষ করে খাগড়াছড়িতে আম চাষ হচ্ছে বেশ। সেখানেও দাবদাহে ঝরে যাচ্ছে আম; আতঙ্কে আছেন চাষিরা। পাহাড়ি আমবাগানে তো সেচের ব্যবস্থা করা আরও দুরূহ।
গ্রীষ্মকালীন সবজি উৎপাদকদেরও একই অবস্থা। তারাও আছেন সেচ সংকটে আর বৃষ্টির অপেক্ষায়। যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা অঞ্চলে হ্যাচারিগুলোর দুর্দশার বিবরণ এসেছে মিডিয়ায়। তাপপ্রবাহে রেনুপোনা উৎপাদনে নেমেছে ধস এবং যেটুকু রক্ষা করা যাচ্ছে, তাও কিনতে লোকজন তেমন আসছে না। সামনেই দেশব্যাপী মাছের সরবরাহে এর একটা প্রভাব কি পড়বে না? এদিকে কোরবানি ঈদের বেশি বাকি নেই। এ উপলক্ষে যারা গরু-ছাগল মোটাতাজা করছিলেন, তাদের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই করুণ। দুধের উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে। খামারিদের দুধ নিয়ে যারা বাজারজাত করে, সেসব কোম্পানির বিক্রিও যাবে কমে। তরল দুধের দাম বাড়তে পারে– পরিস্থিতি একই রকম থাকলে। সরকার কি পারছে এসব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহটা অন্তত স্বাভাবিক রাখতে?
পোল্ট্রির অবস্থাও একই। ঈদের পর ‘সোনলি’ মুরগির দাম বেড়েছে প্রধানত তাপপ্রবাহে। পোল্ট্রি আর গরুর খামারে বাড়ছে হিট স্ট্রোকের ঘটনা। গাভীর গর্ভপাত হওয়ারও খবর মিলছে। এ অবস্থায় থেকে থেকে বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা অন্তত ৩৫-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসাটা তো জরুরি। সিলেট, মৌলভীবাজার অঞ্চলে গড়ে ওঠা চা বাগানগুলো থেকেও কিন্তু খারাপ খবর আসছে। চা শ্রমিকরা ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না– কৃষি শ্রমিকদের মতোই। তাদের মজুরি কিছুটা বেড়েছিল। কিন্তু বাগানগুলো বছরের পর বছর খরায় আক্রান্ত হলে চা শ্রমিকরাও কি চিন্তিত হবে না ভবিষ্যৎ নিয়ে? নিলামে চা পাতার উপযুক্ত দাম না পাওয়ার সমস্যাও দানা বেঁধে উঠছে। করতে হচ্ছে ‘ফ্লোর প্রাইসের’ ব্যবস্থা! এ অবস্থায় উদ্যোক্তারা চা ব্যবসায় আগ্রহ হারালে কী হবে?
টানা তাপপ্রবাহে ওষুধের গুণমান রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে সিংহভাগ দোকানে, যেখানে এসির ব্যবস্থা নেই। সচ্ছল পরিবারগুলো এসির ব্যবহার বাড়াচ্ছে; অফিসগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে অনেক। ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণের সঙ্গে সঙ্গে তাপও বাড়ছে আশপাশে। কিন্তু (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) ওষুধের দোকানগুলো মানসম্মত হচ্ছে না। বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা কিছুটা কমলে দেশজুড়ে মজুদ ওষুধ নিয়ে দুর্ভাবনাও কমতো। তীব্র তাপপ্রবাহে বিপুল ব্যয়ে বানানো সড়ক থেকে উঠে যাচ্ছে বিটুমিন। রেললাইন বেঁকে যাওয়ার আশংকায় ট্রেন চালাতে হচ্ছে ধীরে। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা, না রাখা নিয়ে জটিলতা বাড়ছে। হাসপাতাল আর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাড়ছে বিশেষত শিশু ও বয়স্ক রোগীর চাপ। চিকিৎসা বাবদ ব্যয় বাড়ছে ব্যক্তির পকেট থেকে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি। ভোগ্যপণ্য সংরক্ষণে বাড়ছে সমস্যা। সরবরাহে অনিশ্চয়তা। এটা হয়ে উঠছে পণ্যবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন উপাদান। জিডিপিতে বরাবরই বড় অবদান রাখা নির্মাণ খাতও এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। এদিকে সরকার বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। টানা তাপপ্রবাহে, একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টি করা গরমে মে মাসে লোডশেডিংয়ের আরও অবনতি হতে পারে। কয়লা অবশ্য আমদানি করা যাচ্ছে কম দামে। পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সদ্ব্যবহার করে সরকার চাইছে বেড়ে ওঠা চাহিদা সামলাতে। তার জন্যও কাজটা একটুখানি সহজ হয়ে যেত বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা সহনীয় হয়ে এলে। তাতে বিদ্যুৎ চাহিদা কমে আসতো। অন্তত সিলেট বিভাগে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তেমন একটা অবস্থার দিকে যাত্রা করা গেলেও হতো। অবশ্য চাইলেই তো কাম্য পরিস্থিতি মেলে না। সেজন্যই লেখার শুরুতে বলেছি, ‘বৃষ্টি হলে তার নিয়মেই হবে’।
মানুষ অবশ্য মেঘ থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে বৃষ্টি ঝরাতে শিখে গেছে। কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে করা হচ্ছে এর প্রয়োগ। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সক্ষমতা অবশ্য অর্জন করতে হবে। আমরা সেখান থেকে অনেক দূরে আছি এখনও। যে যার মতো করে বৃষ্টি কামনা করছি; আবার করছি না। তবে সব মিলিয়ে গ্রীষ্মের একটা নতুনতর অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের। শুধু ‘আমাদের’ বলি কেন! এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠী। কৃষিসহ তাদের গোটা অর্থনীতিই এতে প্রভাবিত হচ্ছে গভীরভাবে। এটা নিশ্চয় তাদের মধ্যে বাড়িয়ে তুলবে একাত্মতাবোধ। এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বিনিময়ও হয়ে উঠবে জরুরি। বৃষ্টির জন্য সহিষ্ণু প্রতীক্ষার পাশাপাশি সে প্রক্রিয়াও জোরদার করতে হবে।
এ মুহূর্তে বৃষ্টি হলে আমাদের কৃষক যেটুকু চ্যালেঞ্জে পড়বে, তার মধ্যেও নিজের কাজটা করে যাওয়া এবং ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা কি অর্জন করেনি সে? দিনশেষে তার ওপর এটুকু আস্থা যেন রাখি। আর তার বিনিয়োজিত সমস্ত কিছুর মর্যাদা রক্ষায় যেন হই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শুধু ফসল রক্ষা পেলেই তো চলবে না; এর উপযুক্ত দামও তাকে পেতে হবে। নইলে উৎপাদনে আগ্রহ হারাবে কৃষক। ধানী জমিতে করবে অন্য কিছুর চাষ। তাতে এত এত মানুষের দেশে খাদ্য নিরাপত্তা কি বিপন্ন হবে না?
গম বা ভুট্টা নয়; দানাদার শস্যের মধ্যে ধানই বেশি করে ফলাতে হবে আমাদের। বোরো মৌসুমের ওপরও অনেকখানি নির্ভর করে থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে সহনীয় করে আনতে হবে আগ্রাসী হয়ে ওঠা গ্রীষ্মের প্রভাব। প্রয়োজনমতো বৃষ্টি না হলে জমিতে সেচ সুনিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই। আর তাপপ্রবাহে গ্রাম কেন ব্যতিক্রমহীনভাবে লোডশেডিংয়ের শিকার– জরুরি এ প্রশ্নও তুলতে হবে।