ভারত ও পাকিস্তান কি যৌথভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? দিন শেষে মরে তো মানুষ। মানুষের ধর্ম থাকে। সন্ত্রাসের ধর্ম নেই।
Published : 24 Apr 2025, 07:01 PM
ভূস্বর্গ কাশ্মীর যেন একইসঙ্গে অনিঃশেষ উত্তেজনার নাম। নানান কিসিমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বহুবাহিনীর মোতায়েনের পরও কাশ্মীরে যে সব ঠিক নেই, পেহেলগামের হামলা আরও একবার তা মনে করিয়ে দিল। ২৬ টি প্রাণ ঝরে গেল মুহূর্তেই।
তবে এবারের হামলার গভীরতা ভাবিয়ে তুলেছে। কারণ কাশ্মীরে বহু বছর ধরে সংঘাত চললেও সরাসরি পর্যটকদের ওপর হামলা খুব কমই হয়েছে। ১৯৯৫ সালে পেহেলগামে আল-ফারান নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ছয়জন বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করেছিল। তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়, একজন পালিয়ে যান এবং বাকি চারজনের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০০০ সালে পেহেলগামের নুনওয়ান এলাকায় এক হামলায় ৩২ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ২১ জন ছিলেন হিন্দু তীর্থযাত্রী। এর এক বছর পর, একই এলাকায় শেশনাগ হ্রদের কাছে আরেক হামলায় ১৩ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ১১ জন ছিলেন তীর্থযাত্রী, বাকি দুজন স্থানীয় বাসিন্দা। ২০১৭ সালে অনন্তনাগ জেলায় এক গুলির ঘটনায় ৮ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হন। গত বছরের জুন মাসে জম্মুর দক্ষিণাংশের কাঠুয়ায় এক তীর্থযাত্রীবাহী বাসে হামলা হলে সেটি খাদে পড়ে যায় এবং ৮ জন তীর্থযাত্রী নিহত হন।
এবার গেল মঙ্গলবার পেহেলগাম শহরের বৈসরণের তৃণভূমিতে হামলা, সম্ভবত ২০০০ সালের পর পর্যটকদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা। হামলার পর থেকেই ভারতীয় গণমাধ্যম মারফত প্রচার পায়, বেছে বেছে হিন্দু নিধন করা হয়েছে এই হামলায়। অনেক সংবাদে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানানো হয়, কালেমা পড়তে পারায় অনেকে বেঁচে গেছেন। হিন্দু হওয়ায় মরতে হয়েছে অনেককে। আবার খোদ ভারতেই এই ন্যারেটিভকে খারিজ করে একে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন থিউরিতে ফেলছেন অনেকে। কেউ আবার দুষছেন স্যেকুলারিজমকে। ধর্ম টেনে এনে, রাজনীতি মিশিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে যেটি আড়ালে পড়ছে তা হলো, প্রাণ গেছে ২৬ জন মানুষের। সুস্পষ্টভাবেই এটি সন্ত্রাসী হামলা। সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই।
নৃশংস এই হামলার পর ভারতের অভিযোগের আঙুল সুস্পষ্টভাবেই পাকিস্তানের দিকে। যদিও ইসমলামাবাদও এই হামলায় নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের স্বল্প পরিচিত একটি গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে। ভারত মনে করছে, এই গোষ্ঠী আসলে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বা বা এমনই অন্য কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের ছদ্মনাম। টিআরএফ এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, কাশ্মীরে ভারত সরকার বাইরের রাজ্যের হাজার হাজার বাসিন্দাকে যে পারমিট দিচ্ছে, তার প্রতিবাদে এই হামলা চালানো হয়েছে। এসব পারমিট ভারতীয় নাগরিকদের কাশ্মীরে বসবাস ও কাজ করার অনুমতি দেয়। ভারত সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মীরের আধা স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করে এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে দেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে কাশ্মীরে রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে অ-কাশ্মীরিদের বসবাসের অনুমতি দেওয়ার পথ খুলে যায়, যা কিনা আগে নিষিদ্ধ ছিল।
তাই স্বল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছে ভারত। ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি প্রথমবারের মতো স্থগিত হয়েছে। ভারত বলছে, যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং পাকাপাকিভাবে সন্ত্রাসের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে ততেদিন স্থগিত থাকবে। আটারি চেকপোস্ট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সার্ক স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকরা ভারতে ভ্রমণ করতে পারবেন না। দিল্লিতে পাকিস্তানি দূতাবাসে সেদেশের প্রতিরক্ষা, সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর যে 'পরামর্শদাতারা' রয়েছেন, তাদের 'পার্সোনা নন গ্রাটা', (অর্থাৎ অবাঞ্ছিত) বলে ঘোষণা করছে ভারত। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। ভারতও ইসলামাবাদে তাদের দূতাবাস থেকে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর পরামর্শদাতাদের ফিরিয়ে আনবে। বোঝাই যাচ্ছে ভারতের প্রতিক্রিয়া বেশ কড়া। আল জাজিরাকে নয়াদিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ‘সেন্টার ফর ল্যান্ড ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ’-এর (ক্লস) পরিচালক তারা কার্থা বলেন, “এটি একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা। আমরা একে সেভাবেই দেখছি। এটা এমন এক সময় ঘটল, যখন কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান একটি বিতর্কিত ভাষণ দিয়েছিলেন।”
মাত্র এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এক বক্তব্যে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জাগুলার’ বলেছেন। জাগুলার মানে গলার শিরা বা জাগুলার ভেইন। এটি শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালিগুলোর একটি। তিনি বলেন, “আমরা আমাদের কাশ্মীরি ভাইদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে একা ফেলে দেব না।” আবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক লেখক ও দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, “এটি অঞ্চলটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। আমরা দেখছি, দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী এখন একে অপরের দিকে আক্রমণাত্মক চোখে তাকিয়ে আছে। এখন কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়।”
অর্থাৎ খুব শিগগিরই কি কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
আবার যারা প্রশ্ন তুলছে নানা রকমের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁক গলে এই হামলা হলো কি করে? তাদের প্রশ্নওতো অবান্তর নয়। ভারতের মধ্যেই অনেকে অভিযোগ তুলছেন, এটি রাষ্ট্রীয় মদদে সাজানো হামলা। পুলাওয়ামা হামলার সময়ও একই ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিলে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই কি এভাবে মানুষ মারা যায়? আবার প্রশ্ন হলো কাশ্মীর নিরাপদ বলে ভারত সরকারের যে দাবি করে আসছে, এ ধরনের হামলায় সেই দাবির মুখে ছাই পড়ে। তার ওপর পর্যটকদের ওপর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে খোদ কাশ্মীরের মানুষই। তাই তারাও প্রতিবাদে ফুঁসেছেন।
কিন্তু স্রেফ পাকিস্তানবিরোধী লেন্সে শুধু ধর্মের অপব্যবহার ভাবনা থেকে পুরো ঘটনা দেখা কিংবা তার বিপরীতে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন থিউরি দিয়ে বিবেচনা না করে ভারত ও পাকিস্তান কি যৌথভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? দিন শেষে মরে তো মানুষ। মানুষের ধর্ম থাকে। সন্ত্রাসের ধর্ম নেই।