“নিজেদের হয়রানিমূলক দাবি ছড়িয়ে দিতে তারা সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে,” দুদককে উদ্দেশ করে বলেন ব্রিটিশ এমপি।
Published : 24 Apr 2025, 10:39 PM
বাংলাদেশের ‘কর্তৃপক্ষের’ বিরুদ্ধে নয় মাস ধরে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আসার অভিযোগ তুলেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক।
একের পর এক অভিযোগ তোলা হলেও অভিযোগকারী কর্তৃপক্ষ (দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক) তার সঙ্গে সরাসরি কিংবা তার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেনি বলে বৃহস্পতিবার ‘এক্স’ পোস্টে আবারও দাবি করেছেন তিনি।
তাকে ’অসম্মান‘ করতে যত চেষ্টাই করা হোক তার আইনজীবীরা এসব অভিযোগের বিষয়ে জোরালো আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে পোস্টে তুলে ধরেন তিনি।
’এক্স’ পোস্টে লেবার পার্টির এমপি লেখেন, “৯ মাস ধরে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করে আসছে।
“তারা সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, আমার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেনি এবং কোনো তথ্যপ্রমাণও সরবরাহ করেনি। উল্টো নিজেদের হয়রানিমূলক দাবি ছড়িয়ে দিতে তারা সংবাদমাধ্যমে প্রচার চালিয়েছে।”
এর আগেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিরুদ্ধে টিউলিপ এবং তার আইনজীবী একই অভিযোগ আনেন।
তবে টিউলিপের বিরুদ্ধে ‘তথ্যপ্রমাণের’ ভিত্তিতেই অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
ঢাকার পূর্বাচলে প্লট ও রূপপুর প্রকল্পে ‘অনিয়মের’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরতে বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা দুদক টিউলিপের ঢাকার দুটি ঠিকানায় তিনটি নোটিস পাঠানোর তথ্য দিয়েছে।
অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো নোটিস তিনটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে পাঠানো হয়েছিল। তবে নোটিস পাঠানোর সেই চিঠি কেউ গ্রহণ করেনি।
এসব নোটিস পাঠানো এবং সেগুলোর ‘ফেরত আসা’ বিষয়ক প্রশ্নে দুদকের চেয়ারম্যান মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, টিউলিপ নির্দোষ হলে কেন পদত্যাগ করলেন?
“কেন তিনি তার আইনজীবীদের দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন? দুদক তার আইনজীবীকে ইমেইলের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছে, যেন বাংলাদেশে এই মামলার আইনি লড়াইয়ে অংশ নেন।”
এ নিয়ে দুদক, টিউলিপ ও তার আইনজীবীর কথা চালাচালির মধ্যে ব্রিটিশ এমপির আইনজীবীরা বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থা ‘ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন’ করছে বলে অভিযোগ তোলেন।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্যান্ডার্ড লিখেছে, গত ১৮ মার্চে একটি চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানোর পরও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ টিউলিপের বিষয়ে ‘একটি প্রামাণ্য দলিলও’ হাজির করতে পারেনি বলে নতুন চিঠিতে অভিযোগ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ল ফার্ম স্টেফেনসন হারউড এলএলপি।
এরপর বৃহস্পতিবার টিউলিপ এক্স পোস্টে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে আবার কথা বলেন।
আইন মেনে চলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা তুলে ধরে তিনি লেখেন, “যেখানে জন্মেছি এবং যেখানে আমি একজন সংসদ সদস্য, সেই যুক্তরাজ্যে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনে বিশ্বাস করি।
“২০২৫ সালের মে মাসে এমপি হিসেবে আমার ১০ বছর পূর্ণ হবে। আমার লক্ষ্য নির্বাচনি এলাকার জনগণের সেবা করা এবং সংসদে তাদের কণ্ঠকে জোরালো করা।”
টিউলিপ লিখেছেন, “যে কাজ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছি, তা থেকে আমি বিচ্যুত হব না। আমি নিজের নির্বাচনী এলাকার জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকব।
“আর আমার আইনজীবীরা আমাকে অসম্মান করার যে কোনও প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে জোরালো আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখবে।”
এর আগে গত ১৫ এপ্রিল দুদকে পাঠানো এক চিঠিতে টিউলিপের আইনজীবীরা বলেন, “আমরা আপনাদের আহ্বান জানিয়েছিলাম, আপনারা যদি টিউলিপ সিদ্দিকের প্রতি কোনো যৌক্তিক, সঙ্গত ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন পেশ করতে চান, তাহলে তা আমাদের জানাতে পারেন, যেন আমরা আমাদের মক্কেলের সঙ্গে আলোচনা করে সে বিষয়ে যথাযথভাবে সাড়া দিতে পারি।
“কিন্তু আপনি বা আপনারা আমাদের কোনো প্রশ্ন পাঠাননি কিংবা আমাদের চিঠির কোনো জবাব দেননি। বরং আপনারা আবারও গণমাধ্যমে বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে এমপি সিদ্দিকের বিরুদ্ধে পুনরায় ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছেন।”
টিউলিপের আইনজীবীদের চিঠির বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোমেন গত বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আদালতে যখন কোনো মামলা থাকে, সেটার নিষ্পত্তি আদালতেই হতে হয়। চিঠি চালাচালি কোনো আইনি সমাধান দেয় না।”
এর আগে গত ২২ এপ্রিল তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “দুদক কেবল নথিপত্র ও বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতেই কাজ পরিচালনা করে। টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটি অভিযোগ যুক্তরাজ্যসহ যেকোনো আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এরপর থেকে শেখ হাসিনাসহ শেখ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের খবর সামনে আসছে। দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
এ ধারাবাহিকতায় পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের এক মামলায় গত ১৩ এপ্রিল টিউলিপসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ঢাকার একটি আদালত।
সেই তালিকায় শেখ হাসিনা, টিউলিপের মা শেখ রেহানা, ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি এবং ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর নামও রয়েছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন লন্ডনে নিজের বাড়ির বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ বলেছিলেন, তিনি ভুল কিছু করেছেন, এমন কোনো ‘প্রমাণ কোথাও নেই’।তিনি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের’ শিকার।
বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি দাবি করে সেদিন তিনি বলেন, তাকে ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ শিকার হতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপেরও নাম আসে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর টিউলিপ ও তার বোনোর পাওয়া ‘উপহারের’ ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড দামের একটি ফ্ল্যাট ‘উপহার’ পাওয়ার খবর নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেন টিউলিপ সিদ্দিক।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার অবশ্য পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর টিউলিপের প্রশংসাই করেছিলেন; বলেছিলেন, টিউলিপের জন্য তার দরজা খোলা থাকবে।
তবে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির একজন মুখপাত্র বলেন, টিউলিপ সিদ্দিকের অবিলম্বে এমপি পদ থেকে সরে দাঁড়ানো উচিত।
প্লট দুর্নীতির মামলায় পরোয়ানা জারি নিয়ে আলোচনার মধ্যে ১৫ এপ্রিল টিউলিপের বিরুদ্ধে নতুন আরেকটি মামলা করে দুদক।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে।
আরও পড়ুন-
টিউলিপের দুর্নীতির প্রমাণ কই? দুদকে আইনজীবীর চিঠি
টিউলিপের বক্তব্য জানতে ঢাকার দুই ঠিকানায় তিনবার দুদকের নোটিস
'ঘুষ' হিসেবে ফ্ল্যাট: যা আছে টিউলিপের মামলার এজাহারে
দুদকের অভিযোগ 'সম্পূর্ণ মিথ্যা': পরোয়ানা জারির খবরে টিউলিপের আইনজীবী
হাসিনা, রেহানা, ববির সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপকে গ্রেপ্তারেও পরোয়
দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতেই টিউলিপ 'দুর্নীতির' আসামি: দুদক চেয়ারম্যান