কার্ডিনাল হিসেবে কনক্লেভে আমন্ত্রিত হলেও অসুস্থ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও যেতে পারছেন না ভ্যাটিকানে।
Published : 24 Apr 2025, 12:46 AM
বৈচিত্র্য এনে চার্চকে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার যে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস, তার ফল হিসাবে প্রথম কার্ডিনাল পেয়েছিল মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ।
জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ নিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর এই দেশে প্যাট্রিক ডি’রোজারিওকে কলেজ অব কার্ডিনালে জায়গা করে দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
পোপ ফ্রান্সিসের প্রস্থানে চার্চকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যেতে তার ভূমিকার কথাই স্মরণ করলেন কার্ডিনাল প্যাট্রিক। বললেন, “তিনি শুধু চার্চের লোক ছিলেন না, ছিলেন পুরো মানবাজাতির লোক।”
২০১৩ সালে ভ্যাটিকানের দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরের মাথায় ২০১৬ সালে প্যাট্রিক ডি’রোজারিওকে কার্ডিনাল করেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। সেই সময় ঢাকার আর্চবিশপ ছিলেন ডি’রোজারিও। সারা পৃথিবীতে হলি ক্রস সংঘ থেকে আসা দ্বিতীয় কার্ডিনাল তিনি।
তার ঠিক এক বছর পর ঢাকায় এসেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। ২০১৭ সালে ৩০ নভেম্বরের থেকে ডিসেম্বরের ২ তারিখ ওই সফরে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
পোপের দায়িত্বকে ধর্মীয় আবরণের বাইরে নিয়ে যেতে পোপ ফ্রান্সিস যে ভূমিকা রেখেছেন, তার পাশাপাশি তার বাংলাদেশ সফরের স্মৃতিকথাও শোনান কার্ডিনাল প্যাট্রিক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস সবসময় মানুষের কাছে যেতেন, দরিদ্র মানুষের কাছে, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে। তার প্রকাশ হিসাবে বাংলাদেশ থেকে কার্ডিনাল করলেন এবং সফর করতে এলেন। এটা ছিল তার ভালোবাসার প্রকাশ।”
প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, “তিনি (পোপ ফ্রান্সিস) যীশুর শিক্ষা কেবল বক্তৃতায় দেননি, মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। সব ধরনের মানুষের কাছে গেছেন-নারী, পুরুষ, সমকামী, কারাবন্দি থেকে শুরু করে সবার কাছে। অভিবাসীদের গ্রহণের কথা বলতেন।
“তিনি বলতেন, পৃথিবী হচ্ছে বাড়ি। সেই বাড়ি এখন আর্তনাদ করছে, কষ্ট পাচ্ছে। পরিবেশের কথা বলতেন। রাষ্ট্র নেতাদের বলতেন, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যেতে চাচ্ছেন।”
বাংলাদেশের এসে নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রেহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তাদের দুর্দশা লাঘবের যে বার্তা পোপ ফ্রান্সিস দিয়েছিলেন, তাও স্মরণ করেন ঢাকার সাবেক আর্চবিশপ।
তিনি বলেন, “সকল ধর্মের মানুষের কাছে গিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। যীশুর শিক্ষাকে শুধু পৌরহিত্য বা যাজকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন।”
পোপের বিদায়ে হৃদয়বিদীর্ণ হওয়ার কথা সোমবার এক বার্তায় লিখেছেন প্যাট্রিক ডি’রোজারিও। বলেছেন, পোপ ফ্রান্সিসের আধ্যত্মিক যাত্রায় তিনিও সহগামী।
ওই বার্তা তিনি লিখেছেন, “পূন্য পিতা পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর খবর খুবই যন্ত্রণার এবং হৃদয়বিদারক। প্রভুর প্রজাদের সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে যাত্রা তিনি সম্পন্ন করেছেন এবং সেই দায়িত্ব তিনি সম্পন্ন করেছেন, যে দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন উৎকৃষ্ট ধর্মউপদেশক যীশু খ্রিস্টের উদাহরণ থেকে, যিনি তার দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন, কষ্ট ভোগ করেছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পুনরুত্থিত হয়েছেন।
“পূণ্য পিতা আমাদের সঙ্গে ইস্টার পালন করেছেন এবং প্রস্থান করছেন পুনরুত্থানের পূর্ণতা নিয়ে।”
পোপ ফ্রান্সিসের ১২ বছরের দায়িত্বে গীর্জার পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ে যিশু খ্রিষ্টের ‘পুনরুত্থান’ প্রত্যক্ষ করার কথা তুলে ধরে প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, “দয়াময় প্রভু তাকে বক্ষে জড়িয়ে নিক এবং আমাদের এই সম্মিলিত যাত্রায় গির্জার ওপর সব ধরনের আশির্বাদ বর্ষণ করুক।”
নিজের চিকিৎসার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “৭ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত আমার হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার এই সময়ে আধ্যাত্মিকভাবে অনুপ্রাণিত যাত্রায় আমি আছি, যার উদাহরণ তিনি (পোপ ফ্রান্সিস) তৈরি করেছিলেন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে গিয়ে এবং আরোগ্যলাভের সময়ে।”
মঙ্গলবার থেকে ভ্যাটিকানে শুরু হওয়া কার্ডিনালদের সম্মিলনে আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ওই বার্তায় প্যাট্রিক ডি’রোজারিও লিখেছেন, “আমার ইচ্ছা ছিল বিদায়ী পূণ্য পিতার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতার প্রকাশ ঘটাতে কার্ডিনাল ভাইদের সঙ্গে মিলিত হই।
“কিন্তু ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত নয় আমার হৃদযন্ত্র। আমি তার (পোপ ফ্রান্সিস) এবং অন্যদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক যাত্রায় সহগামী হব। একইভাবে আমি সহগামী হব কলেজ অব কার্ডিনালস এবং কনক্লেভ সদস্যদের সঙ্গে।”
কনক্লেভসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় যে পথ দেখিয়ে গেছেন পোপ ফ্রান্সিস, তা ঠিকমত প্রতিপালনের জন্য প্রার্থনা করার কথাও লিখেছেন তিনি।
সবশেষে তিনি প্রার্থনা করেন, “প্রভু, গির্জার জন্য আপনার ইচ্ছা ও পরিকল্পনার প্রকাশ ঘটান। পৃথিবীর এই সংকটময় পরিস্থিতিতে গির্জাকে এমনভাবে পথ দেখান, যেভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আপনার সেবক পোপ ফ্রান্সিস এবং ইস্টার দিনের বার্তায়ও সেটা জানিয়ে গেছেন।”
শারীরিক অবস্থার কারণে যাওয়া হচ্ছে না ভ্যাটিকানে
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর নতুন পোপ নির্বাচনের যে আনুষ্ঠানিকতা, সেখানে প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসাবে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল ঢাকার এমেরিটাস আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিওর। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কারণে যেতে পারছেন না তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকটমকে তিনি বলেন, সম্প্রতি তার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়েছে। এখন বাসায় বিশ্রামে আছেন।
কোনো পোপের মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যের বিস্তৃত ধর্মীয় ও অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গে চলে পরবর্তী পোপ নির্বাচনের ঐতিহাসিক আনুষ্ঠানিকতা।
ভ্যাটিকান সিটিতে ওই আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত হন সারা পৃথিবীর কার্ডিনালরা। কনক্লেভ নামে পরিচিত ওই সম্মিলনে বয়স যাদের ৮০ বছরের নিচে, তারা ভোট দিতে পারেন। আর এর উপরে যাদের বয়স, তাদের ভোটাধিকার না থাকলেও বিতর্কে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে।
২০১৬ সালে কার্ডিনাল হওয়ার পর প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেছিলেন, “পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ চার্চ থেকে অধিকার পেল প্রথমবার। কোনো দেশ থেকে যখন কেউ কার্ডিনাল হিসেবে মনোনয়ন পান, তখন তা ওই দেশের জন্য সম্মানের। এটি একটি রেকর্ড। এটি একটি স্বীকৃতি, যা ধর্মগুরু নিজে দেন।”
কিন্তু সুযোগ যখন এল, তখন শারীরিক কারণে উপস্থিত না হতে পারার কথা তুলে ধরে এক প্রশ্নে প্যাট্রিক ডি’রোজারিও বলেন, “এইটা দুইটা ভাগে হয়ে থাকে। প্রথমত, পোপ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে সপ্তাহখানেক আলোচনা হয়। যেটা মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। আমি সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলাম। কিন্তু শরীরের অবস্থার কারণে আমার যাওয়া হচ্ছে না।
“দ্বিতীয়ত, মূল কনক্লেভ যেটা, সেখানে ভোটাভুটিতে অংশ নেবেন ১৩৫ জন, যাদের বয়স ৮০ বছরের নিচে। আমারতো ৮১, সাড়ে ৮১ বছর বয়স হয়েছে। আমার সেখানে থাকার সুযোগ নাই।”
১৯৪৩ সালের পহেলা অক্টোবর বরিশালের পাদ্রিশিবপুরে জন্ম নেওয়া প্যাট্রিক রোজারিও বিভিন্ন সেমিনারিতে দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পর হলি ক্রস সংঘের আওতায় ১৯৭২ সালে ফাদার বা পুরোহিত হন।
১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহীর এবং ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামের বিশপের দায়িত্ব পালন করেন।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের কাছ থেকে পলিউম সম্মাননা পেয়েছিলেন প্যাট্রিক রোজারিও, যা ক্যাথলিক যাজকদের সর্বোচ্চ সম্মাননা।
বর্তমানে মোট ২৫২ জন কার্ডিনালের মধ্যে ১৩৫ জনের বয়স রয়েছে ৮০ বছরের নিচে। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হবেন পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরসূরি।
পোপের প্রস্থানে ক্যাথলিক মণ্ডলীর শোক
ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু এবং ভ্যাটিকান সিটির প্রধান পোপ ফ্রান্সিসের চিরপ্রস্থানে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ খ্রিষ্টমণ্ডলী।
বুধবার ঢাকার আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজের পাঠানো বার্তায় এই শোক প্রকাশ করা হয়। আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীরও সভাপতি।
শোকবার্তায় বলা হয়, “পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এক অসাধারণ মানবতাবাদী নেতা, যিনি শান্তি, সহানুভূতি এবং সাম্যের বার্তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে কাথলিক চার্চ বিশ্বব্যাপী দরিদ্র, শরণার্থী, অভিবাসী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছেন|
“তিনি ধর্মীয় সহাবস্থান এবং আন্তঃধর্মীয় সংলাপের এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ছিলেন। বিশ্ব ধর্মীয় নেতৃত্বে তার অবদান ও মানবিক মূল্যবোধ সকলের অনুপ্রেরণা।”
২০১৭ সালে সবুজ শ্যামল বাংলার বুকে তার আসার কথা স্মরণ করে শোকবার্তায় বলা হয়, “গভীর মমতা ও ভালোবাসায় তিনি শুনেছেন মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের কষ্টের কথা, প্রকাশ্যে নীরবে কেঁদেছেন আর নাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে।
“এমনিভাবে অন্যায়-অন্যায্যতা, নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং প্রকৃতি ও দরিদ্রদের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থানের কারণে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন বিশ্ববিবেক।”
মৃত্যুর ঠিক আগের দিন ইস্টারের শুভেচ্ছা জানাতে পোপ ফ্রান্সিসের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার বারান্দায় আসার কথা তুলে ধরে শোকবার্তায় বলা হয়, “পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু শুধুমাত্র ক্যাথলিকদের জন্যই বড় ক্ষতি নয়, ধর্মীয় অঙ্গণে এক অপূরণীয় ক্ষতি।
“দরিদ্র, প্রান্তিক ও অসহায় মানুষের পাশে থাকার যে কৃষ্টি পোপ ফ্রান্সিস সৃষ্টি করেছেন, তা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। প্রয়াত পোপ আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকুন। আমরা তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।”
২০১৭ সালে পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের সময় রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে নিয়ে আসা এবং দোভাষীর ভূমিকা পালন করেছিলেন কারিতাস বাংলাদেশের পরিচালক জেমস গোমেজ। পোপের সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই সময়কে এখনও গভীর অনুরাগে স্মরণ করেন তিনি।
জেমস গোমেজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে দুর্যোগ কবলিত দরিদ্র নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেন। ২০১৭ সালে পোপ যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, কক্সবাজার হতে একটি ছোট্ট রোহিঙ্গা গ্রুপকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।
“তখন আমি দোভাষী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি পোপ ফ্রান্সিসের কাছে যাওয়ার। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে প্রতিটি ব্যক্তির দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা শ্রবণ করেছিলেন। সারা বিশ্ব তখন দেখেছে যে তিনি সকলকে সাথে নিয়ে প্রার্থনা করেছেন।”
পুরোনো খবর:
বাংলাদেশ থেকে প্রথম কার্ডিনাল হলেন প্যাট্রিক ডি রোজারিও