“অভিবাসী ও শরণার্থীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাতের ওই সময়ে অভিবাসী ও শরণার্থীদের কষ্ট লাঘবের বার্তা তিনি দিয়েছিলেন।”
Published : 21 Apr 2025, 11:57 PM
মিয়ামনার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় যখন আলোড়ন পড়ে সারাবিশ্বে, তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে ত্রাহি অবস্থার মুখে বাংলাদেশ; সেই সময়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
ঢাকায় আসার আগে তার মিয়ানমার সফর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার সুযোগ হিসাবে ভাবা হয়েছিল।
তবে, নেপিদো সফরের সময় রাখাইনে নিপীড়নের সমালোচনা করলেও রোহিঙ্গাদের নাম উচ্চারণ না করায় সমালোচনা হচ্ছিল তার। এরপর ঢাকায় এসে ওই জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে সাক্ষাৎ দেন শীর্ষ ক্যাথলিক ধর্মগুরু, বার্তা দেন সব শরণার্থীর প্রতি সহমর্মিতা দেখানোর।
২০১৭ সালের নভেম্বরের শেষ ও ডিসেম্বরের শুরুতে পোপ ফ্রান্সিসের তিনদিনের সেই ঢাকা সফরকে এখনও গভীর অনুরাগ আর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বাংলাদেশের খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। বাংলাদেশের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে তার সাধুবাদ জানানোকেও মনে করেন তারা।
আট বছর আগে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় তার কর্মব্যস্ততার কথা এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন তেজগাঁওয়ের হোলি রোজারিও চার্চের প্রধান পুরোহিত ফাদার জয়ন্ত এস গোমেজ।
পোপের সেই সময়ের সফরের স্মৃতিচারণ করে সোমবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কাকরাইলে এবং তেজগাঁওয়ের চার্চে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নানা আয়োজনের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্মুক্ত উপাসনায় যোগ দিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
ওই বছরের ১ ডিসেম্বর প্রায় ৮০ হাজার খ্রিষ্ট্রান ধর্মাবলম্বীর উপস্থিতিতে ওই মুক্ত উপাসনায় ১৬ জন যাজককে অভিষিক্তও করেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস।
ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে আড়াই ঘণ্টার এই মুক্ত উপাসনায় বাংলাদেশের মানুষ এবং বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় প্রার্থনা করেন পোপ। বক্তৃতা দেন যিশুর অনুসারীদের উদ্দেশ্যে।
ফাদার জয়ন্ত বলেন, “সব সময় শান্তির পক্ষে, প্রকৃতি ও ধরিত্রীকে বাঁচানোর কথা বলতেন তিনি। গরীব, দুঃখী ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অধিকারের কথা বলতেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলতেন। বাংলাদেশে এসেও তেমন বার্তাই তিনি দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাসকেও সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এমন অবস্থা যেন সবসময় থাকে। বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
“অভিবাসী ও শরণার্থীদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সাক্ষাতের ওই সময়ে অভিবাসী ও শরণার্থীদের কষ্ট লাঘবের বার্তা তিনি দিয়েছিলেন।”
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন বাংলাদেশ সফরে আসা তৃতীয় পোপ। তার আগে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন পোপ জন পল।
ঢাকা তিনদিনের কর্মব্যস্ততা
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় পৌঁছালে তাকে স্বাগত জানান তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বর্ণিল আয়োজনে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান পোপ ফ্রান্সিস। সেখানে ফুল দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সাভার থেকে ঢাকার ধানমণ্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন পোপ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর যেই জাদুঘরটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর থেকে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন পোপ ফ্রান্সিস। পরে বঙ্গভবনের দরবার হলে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য তিনি।
সফরের দ্বিতীয় দিন ১ ডিসেম্বর সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উন্মুক্ত উপাসনায় পৌরহিত্য করেন পোপ ফ্রান্সিস। এরপর ঢাকার ভ্যাটিকান দূতাবাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয় তার।
এদিন, কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারের ১৬ জন সদস্যের সাক্ষাৎ দেন পোপ। তাদের দুর্দশার কথা নিজের কানে শুনে আবেগময় হয়ে পড়েন তিনি; তখন রোহিঙ্গা নামটিও তিনি উচ্চারণ করেন।
ওইদিন সেখানে আর্চবিশপ হাউজে বিশপদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি এবং শান্তি কামনায় আন্তঃধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত ঐক্য বিষয়ক সভায় অংশ নেন।
সফরের শেষ দিন ৩ ডিসেম্বর সকালে তেজগাঁওয়ে মাদার টেরিজা হাউজ পরিদর্শনে যান পোপ। সেখানে আশ্রয় নেওয়া অনাথ ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের দুর্দশার কথা শোনেন তিনি।
এরপর তেজগাঁও হলি রোজারিও চার্চে খ্রিস্টান যাজক, ধর্মগুরু ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে চার্চের কবরস্থান পরিদর্শন করেন তিনি। সেখানে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে বিশ্বের জন্য অনন্য নজির হিসেবে তুলে ধরেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান এই ধর্মগুরু।
ওইদিন দুপুরের পর ঢাকায় নটর ডেম কলেজে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর বিকালে ঢাকা ছাড়েন পোপ ফ্রান্সিস।
ওই মতবিনিময়ে আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে পোপ বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো সমাজ কিংবা কোনো ধর্ম বলে তারাই সেরা, তখনই তাদের পতনের শুরু হয়।
বাংলাদেশে পোপের স্মরণে
পোপ ফ্রান্সিসের চিরপ্রস্থানে কালোব্যাজ ধারণ করেছেন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীরা। শোক জানিয়ে কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে টানানো হয়েছে পোপ ফ্রান্সিসের ছবি, করা হয়েছে আলোক প্রজ্জ্বালন। সন্ধ্যায় শীর্ষ ধর্মগুরুর জন্য প্রার্থনাও হয়েছে ওই গীর্জায়।
আনন্দের সঙ্গে যীশুখ্রিষ্টের পুনরুত্থান স্মরণে ইস্টার পালনের এই সময়ে ‘পূণ্যপিতা’ পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে ‘অত্যন্ত মর্মাহত’ হওয়ার কথা বলেন আর্চবিশপ বিজয় এন ডি ক্রুজ।
তিনি বলেন, “আমরা দুঃখে ভারাক্রান্ত। তিনি অত্যন্ত সাধাসিধে একজন মানুষ ছিলেন। সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তার হৃদয়টা অনেক দয়াপূর্ণ। দরিদ্রদের প্রতি তার অনেক ভালোবাসা।
“তার ভালোবাসা ছিল সেই উদ্বাস্তুদের জন্যে, অভিবাসীদের জন্যে, শরণার্থীদের জন্যে এবং তাদের অধিকারের জন্য, তাদের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য তিনি অনবরত কাজ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থার কাছে আবেদন করেছেন, যাতে তাদের প্রতি নজর দেওয়া হয়।”
সবাইকে প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বিজয় এন ডি ক্রুজ বলেন, “আমি সবাইকে, সারা বিশ্বমণ্ডলীকে, বিশেষ করে বাংলাদেশে সবার কাছে প্রার্থনার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে ঈশ্বর আমাদের এই পোপকে চির শান্তি দান করেন।”
পোপের মৃত্যুতে এখনো কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি ঢাকার কাকরাইলের সেন্ট ম্যারিস ক্যাথেড্রাল।
ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশের চ্যান্সেলর ফাদার মিল্টন ডেনিস কোরাইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনো কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। সবার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”