ভোগবাদ এবং বৈষম্যমূলক অর্থনীতিকে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
Published : 22 Apr 2025, 08:08 PM
বেলেম জলবায়ু সম্মেলনের আগেই চলে গেলেন পোপ ফ্রান্সিস। খুব চাইছিলাম ব্রাজিলের আমাজন বনের ভেতর অনুষ্ঠেয় বেলেম জলবায়ু সম্মেলনে তাঁর দরকারি বক্তৃতা শুনব। ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মের এই সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার বহু পরিচয়। বিশেষ করে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ ও জলবায়ুকর্মী।
তাঁর প্রয়াণের পর জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থার প্রধান সাইমন স্টেইল বলেন, পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন মানব মর্যাদার এক বিশাল ব্যক্তিত্ব যিনি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু তৎপরতার ক্ষেত্রে একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বের প্রাতিষ্ঠানিক বড় ধর্মগুলোর ধর্মগুরুদের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে জোরালো বৈশ্বিক তৎপরতা খুব একটা দেখা যায় না। এক্ষেত্রে পোপ ফ্রান্সিস অবশ্যই বিরল।
পোপ ফ্রান্সিস সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেই প্রথম তাঁর জলবায়ু-চিন্তার সাথে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। ‘লাউদাতো-সি’ নিয়ে তখন সবেমাত্র আলাপের ডানা মেলছে। পরিবেশ ও জলবায়ু প্রশ্নে পোপ ফ্রান্সিসের এক মুক্তি-আকাঙ্ক্ষা। তাঁর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ ঘটে ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশে এসেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। অবশ্য এর আগে ১৯৮৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তঃধর্মীয় সভায় তিনি বাংলাদেশে সকল ধর্মের সহাবস্থানকে বিশ্বে এক চমৎকার উদাহরণ হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন।
অন্তর মানখিন, ইউজিন নকরেক, রাখী ম্রং, মিঠুন রাকসাম আরো কত জন আমরা ভোর থেকেই সোহরাওয়ার্দীর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। পাহাড়, শালবন, চাবাগান, সীমান্তবর্তী গ্রাম, আদিবাসী-বাঙালি খ্রিষ্টানসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ভিড় জমেছিল। ভিড়ের দাপটে শীত উধাও হয়েছিল। সেই সফরে তিনি রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের জন্য তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে পোপ ফ্রান্সিসের লাউদাতো-সি বোঝার চেষ্টা করেছি নানাজনের কাছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আর্চবিশপ থিওটনিয়াস গোমেজ কিংবা পরিবেশ-গবেষক ফিলিপ গাইনের কথা ও কাজ বেশ কাজে লেগেছে।
আমার কাজের ক্ষেত্র যেহেতু অপুস্তকীয় ধর্মদর্শন, সেক্ষেত্রে আমি সর্বদা প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান ধর্মগুলোর পরিবেশচিন্তাকে নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করি। বিশেষ করে পরিবেশ সুরক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের অবদান ও তৎপরতা কেমন তা বোঝার চেষ্টা করি। সমকালে পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষা প্রশ্নে পোপ ফ্রান্সিস প্রাতিষ্ঠানিক একটি ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ত্ব হিসেবে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা, ধর্মীয় স্টেরিওটাইপ এবং বাইনারির বাইরে এসে একটি পাবলিক ডিসকোর্সও তৈরি করেছে। ইসলাম, হিন্দু-সনাতন, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টধর্মে প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় বহু স্পষ্ট বার্তা আছে। ইসলাম ধর্মে কোনো কারণ ছাড়া গাছের পাতাও ছিঁড়তে নিষেধ করা হয়েছে কিংবা প্রাকৃতিক পানি বিনষ্ট না করার নির্দেশ আছে। কিন্তু আমরা কী দেখি? মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বন পুড়ে যায় অক্সিডেন্টালের খননে কিংবা বড়লোকের গাড়ি চলাচলের জন্য এক্সপ্রেসওয়ে করে কেটে ফেলা হয়ে ঢাকার পান্থকুঞ্জের দুই হাজার গাছ। প্রাকৃতিক পানির সাথে চরম অন্যথা করা হচ্ছে। গরিবের কাছ থেকে সকল পানির আধার ছিনতাই করা হয়েছে। খাবার পানি আজ নির্দয়ভাবে বোতলবন্দি হয়েছে।
প্রকৃতি এবং পরিবেশ সুরক্ষায় ধর্মীয় বার্তাগুলো তাহলে মানুষ মানছে না কেন? কেন জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে পৃথিবীর আয়ু নিঃস্ব করা হচ্ছে? আমাজন থেকে সুন্দরবন আজ রক্তাক্ত কেন? প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষা প্রশ্নে তাহলে দায় ও দায়িত্ব কোথায়? বিশ্বব্যাপী এসব আলাপ জোরালো হচ্ছে। বাংলাদেশে জলবায়ু ও পরিবেশ জিজ্ঞাসাকে প্রাতিষ্ঠানিক বৃহৎ ধর্মপরিসর থেকে আমরা কীভাবে পাঠ করব? অথচ বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপুস্তকীয় ধর্মের কত অবিস্মরণীয় সব ধর্মগুরু, ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও তাত্ত্বিক কিংবা চর্চাকারী রয়েছেন।
মিশর জলবায়ু সম্মেলনের আগভাগে ব্রাত্য আমিন ও সৌম্য সরকার তখন নির্মাণ করছিলেন প্রামাণ্যচিত্র ‘নো আর্ক’। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বড় ধর্মগুলো এবং তাদের ধর্মীয় নেতারা কী করছেন, কীভাবে ভাবছেন এবং কীভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু আন্দোলনে এসব বার্তা সঙ্গী হতে পারে এমন প্রশ্নগুলো খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছিলাম আমরা তখন বাংলাদেশের নানাপ্রান্তে, নানা ধর্মীয় জীবনে এবং ধর্মীয় তাত্ত্বিক ও নেতাদের সান্নিধ্যে। ‘নো আর্ক’ নির্মাণের সময়েও বহু লেখার পাশাপাশি আবারও পোপ ফ্রান্সিসের পরিবেশ ও জলবায়ু সংক্রান্ত কাজগুলো বোঝার চেষ্টা হয়েছে। খুব স্পষ্টভাবে নিওলিবারেল ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। ভোগবাদ এবং বৈষম্যমূলক অর্থনীতিকে পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।সংকট মোকাবেলায় ক্যাথলিক সম্প্রদায়সহ সকল মানুষকেই দায়িত্বশীল হতে আহবান জানিয়েছেন।
সর্বশেষ বাকু জলবায়ু সম্মেলনে আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় আমাজন বনের বহু আদিবাসী মানুষের। ইয়ানুমামীসহ আমাজন বনের আদিবাসীদের অধিকার সংগ্রামে সংহতি জানিয়ে সোচ্চার ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। স্বর্ণখনির জন্য আমাজন বন ও ইয়ানুমামীদের বসত লন্ডভন্ড করছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। স্বর্ণখনির ফলে মারাত্মক পারদ দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত সেখানকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। খুব কম ধর্মীয় নেতাকেই আমরা বহুজাতিক দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখি। এক্ষেত্রে পোপ ফ্রান্সিস পরিবেশপ্রশ্নে দায় ও দরদের বার্তা স্পষ্ট করেছেন। পোপ বলতেন, পৃথিবী গ্রহটি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে, আমাদের খুব দ্রুত দায়িত্বশীল হতে হবে। আজকের নিওলিবারেল এই নির্দয় পৃথিবীতে পোপ ফ্রান্সিসের জলবায়ু-বার্তা পরিবেশ আন্দোলন জাগিয়ে রাখতে খুবই জরুরি।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের আগেই এক পরিবেশ মুক্তিবার্তা হিসেবে ‘লাউদাতো সি’ (তোমার প্রশংসা হোক) ঘোষণা করেন পোপ ফ্রান্সিস। ২০১৫ সালের ১৮ জুন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। জলবায়ু সংকট ও পরিবেশগত অবক্ষয়ের জন্য পোপ দায়িত্বহীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভোগবাদের সমালোচনা করেছেন। কোনো সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে ঘোষিত পরিবেশ ও জলবায়ু মুক্তিবার্তা হিসেবে লাউদাতো-সি বেশ আলোচিত। প্রধান ছয়টি অধ্যায়ে বিবৃত এই বার্তা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার বাইরে এসে একধরণের প্রতিবেশ-রাজনৈতিক বয়ানও হাজির করেছে। তৃতীয় অধ্যায়ে পরিবেশগত সংকটের অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক ব্যাখা দেয়া হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে প্রতিবেশগত দিক বর্ণিত হয়েছে এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে পরিবেশগত শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গগুলো টানা হয়েছে। ফ্রান্সিস শিল্পবিপ্লব পরবর্তী মানুষের ইতিহাসকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ হিসেবে ব্যাখা করেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ও মানবসৃষ্ট ন্যারেটিভকে গ্রহণ করেন। ফ্রান্সিস পৃথিবীর ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক-জেলের পক্ষে দাঁড়িয়ে কৃষি সুরক্ষার দাবি জানান এবং ঘোষণা করেন ক্ষুদ্র কৃষিখামারগুলো পৃথিবীর সকলের খাদ্য জোগায় কিন্তু কম বর্জ্য উৎপাদন করে। ২০১৫ সাল থেকে লাউদাতো-সি’র প্রকৃতি-দর্শনকে কেন্দ্র করে কিছু পরিবেশ আন্দোলন শুরু হয়।
পৃথিবী নামক গ্রহটিকে ফ্রান্সিস সকলের ‘সাধারণ একক গৃহ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন এবং এই ঘর গোছানো এবং সাজানোর জন্য সকলের ঐক্য ও ভালোবাসা জাগ্রত করার কথা বলেছেন। ২০২৩ সালে দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্য বিশ্বনেতাদের সামনে পাঠ করেন কার্ডিনাল সেক্রেটারি পিয়েত্রো পারোলিন। দুবাই জলবায়ু ভাষণে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস মানে গডের বিরুদ্ধে অপরাধ’। ফ্রান্সিস স্পষ্ট করে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বড় অভিঘাত সামাল দিতে হয় গরিব মানুষকে কিন্তু এই গরিব মানুষেরা এই সংকটের জন্য দায়ী নয়। জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে পোপ ফ্রান্সিস তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন এবং বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানি হ্রাসকরণের আন্দোলনে তিনি সর্বদা সেচ্চার ছিলেন। নিঃসেন্দেহে পৃথিবীর এক ক্ষমতাময় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার জন্য জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভর অথনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কোনো সহজ সরল বিষয় ছিল না। ফ্রান্সিস মূলত পরিবেশ ও জলবায়ু সংকটে দুর্গত মানুষের দুঃখ, বঞ্চনা এবং বৈষম্য দূরীকরণের আলাপ বেশি টেনেছেন। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি, দায়িত্ববোধ এবং প্রেম-ভক্তিকে পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন হিসেবে দেখেন। দুবাই জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮ এ বিশ্বনেতৃত্বকে জীবাশ্ম জ্বালানির অবসান ঘটানোর জোর আহবান জানিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
যুদ্ধ এবং অস্ত্রবাণিজ্যের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য ছিল তাঁর। এক বক্তৃতায় তিনি জানান, যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, লেবানন, ইউক্রেইন, সুদান, মিয়ানমার সবাই। মৃত্যুর আগের দিন ইস্টার সানডের বার্তায় ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতির জোর আহবান জানিয়ে গেছেন পোপ। অস্ত্রবাণিজ্য এবং মিলিটারাইজেশনের জন্য যে বিনিয়োগ ও অর্থবরাদ্দ হয় তা বাতিল করে সেই অর্থায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর ক্ষুধা দূর করা সম্ভব এবং একইসাথে টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় ব্যয় করা সম্ভব বলে মনে করতেন পোপ ফ্রান্সিস। কিন্তু যুদ্ধবাজ মুনাফাখোর লুটেরা নিওলিবারেল বিশ্ব-ক্ষমতা কী পোপ ফ্রান্সিসের বার্তাকে পাঠ করে না। তাই পরিবেশ ও জলবায়ুর শরীর স্বাস্থ্য ভাঙছে অনর্গল। ভোগবাদ, বিনাশী উন্নয়ন ও নিওলিবারেল বাহাদুরির বিপরীতে জনতার পরিবেশ ও জলবায়ু মুক্তির গান একদিন সকল অর্গল ভাঙবেই। একজন পোপ ফ্রান্সিস এই আকাংখাই হয়তো করেছিলেন।
১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনার ফ্লোরেসে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্সিস, পারিবারিক নাম জর্জ মারিও বার্গোগ্লিও। ২০০১ সালে তিনি পোপ দ্বিতীয় জন পলের মাধ্যমে কার্ডিনাল নির্বাচিত হন। সোসাইটি অব জেসাসের (জেসুইটস) সদস্য হিসেবে ফ্রান্সিস ছিলেন প্রথম পোপ। ফ্রান্সিসের মা-বাবা ইতালির। ধর্মগুরু হয়ে ওঠার আগে বাউন্সার, দারোয়ান, রসায়নবিদ কিংবা খাদ্য প্রযুক্তিবিদ হিসেবে কাজ করেছিলেন ফ্রান্সিস। ২০১৩ সালে ফ্রান্সিস পোপ নির্বাচিত হন। ২১ এপ্রিল ভ্যাটিকান সিটির কাসা সান্তা মার্তা ভবনে মারা গেছেন ফ্রান্সিস।