এই লেখাটার ইচ্ছে হয় তখন, যখন এই কয়দিন আগে একবার একটা সংবাদ সামনে আসে, এক শ্রমিক আত্মহত্যা করেছে। দেখেই মাথায় এল, আমার ভাই বেঁচে থাকলে সেও কি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিত!
Published : 24 Apr 2025, 05:14 PM
এক অদ্ভুত বয়ে চলা জীবন। আজ বারোটা বছর চলে গেল। বারো বছর আগে এই দিনে আমি সিলেট থেকে ঢাকায় রওয়ানা হই। এর কয় ঘণ্টা পর সেখানে পৌঁছাই তার তেমন কিছু আমার মনে নেই। তবে আগের একটা প্রচণ্ড অদ্ভুত স্মৃতি মনে আছে।
এর আগের বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাই। বের হয়ে বহু মানুষের ভিড়ে, পথ ঠেলে কিছুটা দূরে যেয়ে একটা বাসে উঠি। কিন্তু সেই বাস গিয়ে থামল সাভার।
ঢাকা শহরে এমন ব্যস্ততা, ‘অর্ধেক রাস্তা গিয়ে’ আপনাকে নামিয়ে দেয় এরকম ঘটনা সবার জীবনেই কয়েকবার ঘটেছে বলে অনুমান করা যায়। এত মানুষ থাকতে বাস এখানে কেন থামাবে সেই বিতর্কে না গিয়ে সবাই নেমে গেল। যে জায়গায় পুরো জাহাঙ্গীরনগর থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মানুষকে হাঁটতে দেখা যায়, সেখানে এতটুকু আসতে পারাও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ভেবে আমরাও নেমে গেলাম।
বাস থেকে নামলেও, সেই বাস আমাদের সাভারের কোথায় নামিয়ে দিল তখনও টের করতে পারলাম না। শুধু মনে আছে, আশপাশের সব থেকে উঁচু বিল্ডিংটার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার কিছুটা দূরত্বে সেই ফুটওভারব্রিজ, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি অন্তত কয়েক হাজার গাড়ি চলে যেতে দেখেছি কয়েক সেকেন্ডে।
এত ভিড়ে এই জায়গাটা খুব একটা মন থাকার কথা নয়। তবে মনে আছে কারণ রানা প্লাজা ছিল আশপাশের সবথেকে উচু বিল্ডিং। সেখানেই ঠিক পাশের ফ্লাইওভারটায় উঠে আমি অনেকক্ষণ কেবল গাড়ির হর্ন আর মানুষের চলা দেখেছিলাম। বাসও যেহেতু কম কিছুটা পরে বাস পাওয়া যাবে ভেবে চা খাওয়ার জন্য দেরি করি। ঠিক সেই রানা প্লাজার সামনে। মানুষ, ভিড়। সেই উচু বিল্ডিংটা। সেই অদ্ভুত বিল্ডিংটাই একদিন এভাবে ভেঙে পড়বে আর সেখানে আমারই পরিচিত কেউ থাকবে, সেটা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, কিংবা জীববিজ্ঞান, বা আমার অনেক প্রিয় গণিতের বিষয়ে মিলে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। শেষে এসে মিলল রাজনীতি বিজ্ঞানে।
কয়েকবছর আগে একবার রানা প্লাজার সামনের বেদিটা ভেঙে ফেলার কথা শুনেছিলাম। সেই সময় কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কারণ এই বেদিটা আমার দেখা পৃথিবীর দ্বিতীয় সুন্দর বেদি।
এর মধ্যে বারোটি বছর গেল। চলেই গেল। এত সুন্দর বেদিটা এখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। শক্ত হাত, অথচ আমার ভাইয়ের হাত ছিল নরম। ছোটবেলার কাস্তে, আর আমার মামার হাতুড়ি। এখানে যা ছিল সেটা আদতে আমারও জীবন। এরপর থেকেই ঢাকা গেলে সেই বেদিটা হয়ে যায় আমার উদ্দেশ্য পালনের জায়গা। ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা পরিত্যক্ত জায়গাটা। বছরের একদিন আলো জলে, মানুষ আসে। সেই জায়গাটা নিশ্চয়ই দখলেরও অনেক চেষ্টা হয়েছে। এই সময় সেই সময় মিলিয়ে পরিচিতজনদের সঙ্গে প্ল্যান করি, এই জায়গাটায় একদিন একটা অনেক বড় বেদি থাকবে। আমার এখান দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক উঁচু বিল্ডিংটা দেখার জন্য যতটুকু মাথা উঁচু করতে হয়, ঠিক ততটুকু মাথা উঁচু করে আমি এই বেদিটা দেখব। সেই বেদিতে লেখা থাকবে পৃথিবীর সব খেটে খাওয়া মানুষের নাম।
আমার জীবনের অনেকগুলো আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে এটিই সর্বোচ্চতম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাজের জায়গায় যেখানেই বলি সবাই কোনো না কোনো ভাবে রিলেট করতে আসে। অনেক দিন হয়ে গেছে। তাও মানুষজন কাছে এসে দুটো কথা বলে, আমি কিছুটা হাসি কিছুটা মলিন হয়ে তাদের ধন্যাবাদ জানাই।
কয়দিন আগে একবার একটা সংবাদ সামনে আসে, এক শ্রমিক আত্মহত্যা করেছে। দেখেই মাথায় এল, আমার ভাই বেঁচে থাকলে সেও কি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিত! সাভারে যারা থাকেন, শ্রমিকদের জীবন যারা দেখেছেন, তারা জানেন, তারা আসলে কীভাবে থাকেন। অনেকেই আমার সঙ্গেও গেছেন, দেখেছেন। সেই জীবন আদতে যে জীবন, তা না দেখলে বুঝবার উপায়ও নেই। তারপর অনেক দিন গেল। এখনও শ্রমিকের রাস্তায় নামা লাগে বকেয়া বেতনের জন্য। তাহলে আমাদের বারোটা বছর কই গেল। কই গেছে আমি অবশ্য জানি।
বারোটা বছর আমার গেছে একটা সম্মানের ডিগ্রি নিতে। একটা রাজনৈতিক পরিচয়ের অর্জনও আছে। চাকরি, কোভিড। আর তার পরের সম্মান্নোত্তর জীবন। কিন্তু শ্রমিকদের জীবন বদলাল না। সরকার বদলাল চারবার।
বাবার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হলে, আলাপ করি, তুমি যে ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে তোমার কী পরিশ্রম হত না! ছোটবেলায় আমাকে যে কয়েক ঘণ্টা কাজে নিয়ে যাইতা সেইটা ফাঁকি দেওয়ার জন্য যে আমি পড়তে বসার ভান ধরতাম, সেখান থেকে এই পর্যন্ত একটা স্বতত্র জীবন হলো। এই পথে কত মানুষের হাত, অবদান। বন্ধু, পরিচিতজন। কিন্তু এতটা পরিশ্রমের কি দরকার ছিল! কেবল নিজের বাবার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে চাই, দেশে শ্রমিকের জীবন বদলালে, চাকরি অথবা খাদ্যের বিনিময়ে জুলুম না করলে, চিকিৎসা, তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিলে অনেক পরিবর্তনই সম্ভব। আর সব থেকে আগে চাকরিতে নিরাপত্তা।
এরপর মানুষের কেবল ব্যক্তিগত দুঃখের দায়ও যদি থাকে, পৃথিবীর শ্রমিকের জন্য কথা বলা আমার জন্য আজীবন মালিকানা। আর সেখান থেকেই চাই, বেদি লাগবে না, আগে মানুষকে শ্রমের মর্যাদাটুকু দেওয়া হোক।
আরও পড়ুন-