সময় যেন এদিক-সেদিক ছুটছিল কেবল। অধরচন্দ্র স্কুল থেকে এনাম হসপিটাল। সেখান থেকে রানা প্লাজা, তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঙ্গু হাসপাতাল। সাভার সিএমএইচ। কোথাও নেই সঞ্জিত।
Published : 28 Apr 2024, 12:06 PM
সঞ্জিত বেঁচে থাকলে ওর বয়স হতো বত্রিশের কাছাকাছি। মানে আমার থেকে একটু বাড়িয়ে বললাম। ছোটবেলা থেকে আমাদের সংসারে জন্ম নিবন্ধনের কোনো রেওয়াজ ছিল না। তাই আমরা কেউই আমাদের সঠিক জন্মদিন জানি না। আমাদের মা-বাবা, বড় ভাই কারোরই না। এই যে লিখছি, এই লেখাটিও আমাদের আগের প্রজন্ম পড়তে পারত না। এখন অবশ্য কয়েকজন আছে যারা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পড়ছে।
আমাদের জন্ম তারিখ এসেছে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তির কাছ থেকে। কারটা কোথা থেকে এসেছে আমি জানি না। তবে আমার প্রাতিষ্ঠানিক জন্মদিনটা এসেছে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনু দিদিমণির কাছ থেকে।
অনু দিদিমণি আমার জীবনের এক মহাগল্প, সেই গল্প আরেকদিন করা যাবে। আজ করব আমার ভাইয়ের গল্প। আমার বন্ধুর গল্প। আমার দরদ মাখানো সেই ভাই, তার গল্প।
আমি আর সঞ্জিত মোটামুটি দুই বছরের বড় ছোট। রীতি অনুযায়ী বড়দের দাদা, ছোড়দা (ছোট দা) মেজদা (মেজো দা) বলার কথা থাকলেও সঞ্জিতকে আমি আজীবন নাম ধরে ডেকেছি। আমাকে কতবার চেষ্টা করানো হয়েছে তাকে দাদা ডাকতে, অথচ কেন জানি কখনো ডাকাই হলো না।
অবশ্য কখনো ইচ্ছেও করেনি। বড় হয়েছি একসাথে। একসাথে আমরা সব করেছি। হাওরে গরু চরানো থেকে শুরু করে একসাথে ঘুমানো, খাওয়া-দাওয়া সবকিছু করেছি একসাথে।
কোনো একসময় সঞ্জিত পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিয়েছিল। তারপর দুই বছর বিরতি দিয়ে আমরা কিছুদিন একসাথে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশুনা করেছিলাম। আমি ওকে কিছুটা অংক করাতাম, মাঝে মাঝে এ বি সি ডি পড়াতাম। যদিও আমিও পারতাম না। মানে আমার থেকে ও কিছুটা কম পারত।
বড় হয়ে সিটকম সিরিজ ইয়াং শেল্ডন দেখে আমার খুব সঞ্জিতের কথা মনে পড়ত। ও বেঁচে থাকলে হয়ত আমরা কোনোদিন একসাথে এই সিরিজটি দেখতাম।
আমি নিজেও ইংরেজি বর্ণমালা ভালো করে শিখেছি ক্লাস থ্রি-ফোরে। কিন্তু মনে আছে একবার আমরা একসাথে প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও দিয়েছিলাম। কিছুটা অনৈতিকতাও করেছিলাম বোধহয়। মানে আমি তাকে হেল্প করেছিলাম। এখন সব খুব স্পষ্ট মনে পড়ে না। তারপর কীভাবে যেন সে আর পড়াশোনাটা করল না।
ঠিক কোন বছর আমার মনে নেই, তবে সঞ্জিত যখন পড়াশোনা ছেড়ে দিল, ওই সময়ের কাছাকাছিই হবে। বাবা ওকে দিরাই উপজেলা সদরে (সুনামগঞ্জ জেলা) একটা মুদি দোকানে দিয়ে এলেন। এসব মুদি দোকানে কিছুদিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলে নাকি ‘অনেক কিছু’ শেখা যায়। এখন যেমন আমরা আনপেইড ইন্টার্নশিপ করি, তেমন। মানে বিনা পারিশ্রমিকে খাটানো। তারপর একদিন বড় হয়ে এমন একটা দোকানের মালিক হওয়া যাবে— এমনই একটা অতি সাধারণ গল্প। সেই ভরসায় সঞ্জিতকে রেখে আসেন বাবা।
কয়দিন হল! দুই/তিন দিনের বেশি না। তখন বর্ষাকাল। আমাদের বাড়ি থেকে এক ঘণ্টার নদীপথ বয়ে উপজেলা সদরে আসতে হতো। আমি সকালে কোনো এক কাজে (সম্ভবত বই/খাতা কিনতে) বাজারে যাই। সারাদিন কী করেছি কিছুই মনে নেই। কেবল মনে আছে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে, কোনো এক সময় ওই দোকানের মালিককে দেখেছি সঞ্জিতকে হালকা একটু ধমকের সুরে কথা বলতে। সেটা দেখে আমার কি কান্না! সেই কান্না শেষপর্যন্ত গড়াল সঞ্জিতকে নিয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত। এরপর আর সে ওই দোকানে যায়নি।
আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি, সঞ্জিত সুনামগঞ্জে একটা সেলুনের দোকানে দীর্ঘদিন কাজ করে নিজেই একটা দোকান দিয়েছে আমাদের উপজেলায়। ভালোই কি চলছিল? জানতাম না আমি। তখন আমি সিলেটে, কলেজে পড়ি।
আমাদের সংসার তখন খুব একটা ভালো চলছিল না। এটা সেটা দশটা কাজ করেও বাবার গোছানো সংসারে টানাপোড়েন যাচ্ছিল। এর আগের কয়েক বছর একবার বন্যা, পরেরবার খরা— এভাবে কাটছিল। এদিকে কলেজে পড়ার জন্য আমাকে সিলেটে থাকতে হয়। পরিচিত এক লোকের কাছ থেকে তখন আমি দেড়া সুদে (ধারের টাকার দেড়গুণ দিতে হতো) খরচের টাকা নিতে থাকি। আর মাঝেমধ্যে সঞ্জিতের কাছ থেকে নিতাম হাত খরচের টাকা।
তখন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে কম খরচে টাকা-পয়সা আনানো যেত। একবার খুব প্রয়োজনে সঞ্জিত আমাকে এক হাজার টাকা পাঠায়। ওই টাকার রশিদ কীভাবে যেন আমার কাছে রয়ে গেল। বহু বছর সেটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তবে কতদিন থাকবে জানি না। এই রশিদ আমাকে সঞ্জিতের সঙ্গে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ১৩ ডিজিটের এই কোড নম্বরটিই (সম্ভবত) এখন সঞ্জিত হয়ে আমার সঙ্গে রয়ে গেছে।
একসময় দেড়া সুদের ধারের টাকা বাড়তে বাড়তে লাখ দেড়েক টাকা হলো। এদিকে টানা দুইবছর ফসল ভালো না হওয়ায় সেই টাকা শোধ করাও দায় হয়ে দাঁড়াল। তারপর কতকিছু পেরিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে বাবা পাড়ি জমালেন ঢাকা। নিজেদের মাড়াই মেশিন, গরু, নৌকা সব বিক্রি করে অর্ধেক টাকা শোধ করা গেছিল বটে, বাকি অর্ধেক টাকা দিতে হয়েছিল সঞ্জিতের মৃত্যুর পর।