এখন হাওরে বাইরের শ্রমিক খুব একটা না আসায় স্থানীয় শ্রমজীবীদের এই সময়ে ব্যাপক চাহিদা থাকে।
Published : 06 May 2024, 09:37 AM
কৃষক যেমন সারাবছরের একমাত্র ফসল গোলায় তোলার জন্য বৈশাখের শুরু থেকেই হাওরের দিকে তাকিয়ে থাকেন; ঠিক তেমনি শ্রমিকরাও এই সময়ে অন্যসব কাজ ফেলে ছুটে আসেন ধান কেটে ‘খোরাকি’ সংগ্রহের জন্য।
হাওরের ধান কাটতে বড়জোড় ১৫ থেকে ২০ দিনের মতো সময় লাগে। এই সময়ে দিনরাত কাজ করে কেউ কেউ পাঁচ-ছয় মাসের ‘খোরাকি’ সংগ্রহ করতে পারেছেন বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।
তাদের ভাষ্য, এখন হাওরে বাইরের শ্রমিক খুব একটা না আসায় স্থানীয় শ্রমজীবীদের এই সময়ে ব্যাপক চাহিদা থাকে। ফলে কাজ পেতে যেমন অসুবিধা হয় না; তেমনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের কিছু সুবিধাও বেড়েছে।
হাওরের সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকদের কাছে ‘খোরাকি’ মানে, ন্যূনতম তিন বেলা পেটভরে ভাত খাওয়ার মতো ধান বা চাল গোলায় থাকা। ভাতের জন্য প্রয়োজনীয় চালের বাইরে উদ্বৃত্ত কিছুটা অংশ বিক্রি করে ডাল, তেল, লবণ, মসলাপাতি ক্রয় করা হয়। যেন ‘কর্মহীন বর্ষাকাল’ কিংবা ‘চৈত্রের নিদানে’ ঘরের মানুষকে না খেয়ে থাকতে না হয়।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের দেখার হাওরে সদড়গর গ্রামের শ্রমিক আমির আলী একটি দলের নেতৃত্ব দেন। তার দলে তিনিসহ মোট নয়জন শ্রমিক। তারা এবার ধান কেটেছেন ইসলামপুর গ্রামের একজন কৃষকের।
আমির আলী বলছিলেন, “ইবার দিনমাদান ভালো থাকলেও খুবই গরম। গরমে ধান কাটতে কষ্ট হইছে। ইবার ধান কাইটা ১২-১৩ মণ ধান সংগ্রহ করেছে প্রত্যেকে। এইডা দিয়া ৪-৫ মাসের ভাতের চিন্তা দূর হয়েছে।
“এখন অন্য কাজ করে সংসারের বাদবাকি কাজ করতে পারব”, বলেন এই শ্রমিক।
হাওরের শ্রমজীবী মানুষ এখন আর শুধু কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন না। ধান কাটা শেষ হলে বর্ষাকালে স্থানীয়ভাবেই তারা বিকল্প কর্মসংস্থানে যুক্ত হন কিংবা শহরে গিয়ে কাজ করেন। ফলে এক-দুই দশক আগেও যে শ্রমিককে শুধু কৃষির ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হত; এখন অধিকাংশ শ্রমিকের কাছেই কৃষি বছরের একটি ‘নির্দিষ্ট সময়ের কাজে’ পরিণত হয়েছে। যা তাকে বাড়তি উপার্জন দেয়।
রোববার কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হাওরের ৯৭ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এ বছর সাতটি জেলায় (সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া) শুধু হাওরে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৪ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। আর সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৩৩ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, হাওরে এবার বোরো আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে। প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার পরিবার এই ধান চাষের সঙ্গে যুক্ত। এই ধান কাটতে এবার নিয়মিত ১ লাখ ৯০ হাজার শ্রমিক, ৩০ হাজার মৌসুমি শ্রমিক এবং বাইরের জেলার আরও প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক যুক্ত ছিলেন।
এর সঙ্গে ছিল প্রায় ৮ শতাধিক হার্ভেস্টার। কৃষি প্রকৌশল কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, একটা হার্ভেস্টার ১০০ শ্রমিকের সমান কাজ করতে পারে।
৭ হিস্যায় কাজ শ্রমিকদের
হাওরের কৃষকরা জানান, দুই-তিন দশক আগেও ঢাকার সাভার, বরিশাল, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চল থেকে বিপুল শ্রমিক আসতো হাওরে ধান কাটতে। এলাকা ভেদে তাদের ‘বেফারি’ ও বা ‘ভাগালু’ বলা হতো। কিন্তু এখন সেসব এলাকায় আর্থ-সামজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। ফলে কাজের জন্য শ্রমিক আর হাওরে তেমন একটা আসে না।
এ কারণে অল্প সময়ে ধান কাটার জন্য স্থানীয় শ্রমিকরাই ভরসা হয়ে উঠেছেন কৃষকদের কাছে। কৃষকরা জানালেন, আগে ধান কাটার সময় খাওয়া-থাকার সংস্থান শ্রমিকদেরই করতে হত। কিন্তু এখন শ্রমিক সংকটের কারণে কৃষক নিজেই তাদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা করেন।
কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধান কাটা শ্রমিকরা মূলত ৭ হিস্যায় কাজ করে থাকেন। অর্থাৎ ধান কেটে মাড়াই শেষে ৬ টুকরি ধান গুণে এক টুকরি পারিশ্রমিক নেন শ্রমিকরা।
অনেক শ্রমিক নগদ টাকায়ও ধান কাটেন। এক বেলা ধান কেটে একজন শ্রমিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান।
সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী গ্রামের কৃষক ছাদির মিয়া বলেন, “ছোটবেলায় দেখেছি বরিশাল, ঝালকাটি, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল থেকে বেপারিরা আসতেন দলে দলে। তারা সঙ্গে বিক্রির জন্য বিভিন্ন জিনিসও নিয়ে আসতেন। যা ধানের বিনিময়ে ও এবং টাকায় বিক্রি করতেন। এখন আর এসব এলাকা থেকে কেউ আসেন না। কারণ তারা আমাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, “এখন আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকেই শ্রমিকরা আসেন। এবারও আমার ৭০ কেয়ার (৩ শতাংশে এক কেয়ার) জমির ধান কাটতে উত্তর সুরমা এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১৮ জন শ্রমিক গত ১৫ দিন ধরে টানা ধান কেটেছেন। ধান কাটা প্রায় শেষ। আর মাত্র দুই কেয়ার জমির ধান রয়েছে।
“শ্রমিকরা এবার প্রায় দেড়শ মণ ধান ভাগে নেবে আমার কাছ থেকে। এর বাইরে নারী শ্রমিকরাও মাড়াই দিয়ে আরও ৫০ মণের মতো ধান নেবে। আমার জমিতে এক হাজার মণেরও বেশি ধান পাব”, বলেন ছাদির মিয়া।
দেখার হাওরের কান্দিগাঁও গ্রামের কৃষক জাহিদ মিয়া বলেন, “আমার ধান কাটা শেষ হয়েছে। আমি একবার শ্রমিকদের খাইয়েছি। থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সাত হিস্যায় ধান কেটে তারা প্রায় শত মণ ধান সংগ্রহ করেছেন।”
তিনি বলেন, “শ্রমিক সংকটের সময়ে দ্রুত ধান কেটে তুলতে আমরা এখন শ্রমিকদের ধানের হিস্যার পাশাপাশি খাওয়ার ব্যবস্থাও করি। এতে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।”
সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের কাইয়ারগাঁও গ্রামের আব্দুর রব (শ্রমিক সরদার) ঈদের দুই দিন আগে দেখার হাওরের হালুয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক জাহিদ মিয়ার ধান কাটতে আসেন। তার সঙ্গে ১৩ জন শ্রমিক আছেন।
তারা উঠেছেন সুনামগঞ্জ টেকনিক্যাল সেন্টারের বারান্দায়। রাতে এখানে থাকেন। সকালে বেরিয়ে যান; আবার রাতে ফিরেন। ধান কাটা শেষ পর্যায়ে বলে জানান এই শ্রমিক সর্দার।
এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধান কাটা, মাড়াই ও গোলাজাত সহজে করতে পেরেছেন কৃষক। আব্দুর রব বলেন, “আমরা এর মধ্যেই ১০-১২ মণ করে ধান সংগ্রহ করতে পেরেছি। আরও কয়েকদিন আছে। এটা দিয়ে বছরের অন্তত ৫-৬ মাস খোরাকি হয়ে যাবে।”
এই দলের অপর শ্রমিক (বাবুর্চি) কাইয়ারগাঁও গ্রামের মিজান মিয়া বলেন, “একবেলা আমাদেরকে কৃষক খাওয়ায়। বাকি দুই বেলা আমরা নিজেরা খাই। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ও হিস্যার ধান সংগ্রহ এবং শুকানোসহ অন্যান্য কাজ আমিই করেছি। যাওয়ার দিন ধান নিয়ে বাড়িতে যাব সবাই।”
এই দলের বেপারি (ধান কাটা শ্রমিক) আব্দুস সাত্তার (৬৫) ছেলে রমজান মিয়াকে নিয়ে ধান কাটতে এসেছেন। ছোটবেলা থেকেই সাত্তার বাবার হাত ধরে ধান কাটতে আসেন। এখন তার সঙ্গে ছেলেরাও আসে।
আব্দুস সাত্তার বলেন, “আমার ছয় সন্তান ও আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে আটজনের সংসার। ধান কেটে প্রায় ৩০ মণ ধান সংগ্রহ হয়েছে। এ দিয়ে মোটামুটি বছরের অর্ধেক সময় চলে যাবে। এই সময় খাওন নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”
মিরেরচর গ্রামের বেপারি (শ্রমিক সর্দার) কবীর মিয়া ১৮ জনের দল নিয়ে দেখার হাওরের লক্ষ্মণশ্রী গ্রামের কৃষক সাদির মিয়ার ধান কাটতে এসেছেন ঈদের তিন দিন পর।
কবীর মিয়া বলছিলেন, “দু-একদিনের মধ্যে ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। আমরা ১৫ দিনের মতো ১৮ জন শ্রমিক কৃষকের জিম্মায় থেকেছি, খেয়েছি। এবার ১৪-১৫ মণের মতো ধান সংগ্রহ করেছি জনপ্রতি। কৃষকের ফসলও ভালো হয়েছে।”
এই দলের শ্রমিক ঢালাগাঁও গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, “কৃষকের ওপর খেয়ে আমরা ১৩-১৪ মণ ধান সংগ্রহ করেছি। এই ধান আমাদের বাবুর্চি খলায় শুকিয়ে বস্তায় ভরে রেখেছে। যাওয়ার সময় ধান নিয়ে বাড়িতে চলে যাব। এই ধানে বছরের অর্ধেকটা সময় আমার ছোট পরিবার নিয়ে খেতে পারবো। খাওনের সংস্থান হওয়ায় আমি খুশি।”
পিছিয়ে নেই নারী শ্রমিকরাও
দেখার হাওরের ঝাউয়ার অংশে এক সকালে গিয়ে দেখা যায়, হাওরের কান্দায় কয়েকজন নারী শ্রমিক যন্ত্রে ধান মাড়াই করছেন। কৃষক তাদেরকে ধানের বিনিময়ে মাড়াইয়ে নিযুক্ত করেছেন। প্রতিদিন এই নারীরা ১৫-২০ কেজি ধান সংগ্রহ করতে পারেন মাড়াই করে। খড় শুকিয়ে সেখান থেকেও ভাগ পান নারী শ্রমিকরা। সেই খড় তারা নিয়ে যান নিজের বাড়ির গবাদিপশুর জন্য।
মাড়াই কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক কালিপুর গ্রামের নূরজাহান বিবি বলেন, “আমার ছয় জনের সংসার। স্বামী তেমন রুজি করতে পারে না। আমি বৈশাখে সারাদিন রোদে পুড়ে ধান মাড়াই ও খড় শুকিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ৮-১০ মণ ধান সংগ্রহ করতে পারি।
“এই ধান দিয়ে ৩-৪ মাস অনায়াসে খেতে পারি। আমার শ্রমে কৃষকেরও লাভ, আমারও লাভ হচ্ছে।”
সদর উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের কিষাণী আলমচান বিবি বলেন, “বৈশাখি তোলার সময় নারীরা ঘরে থাকে না। অনেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আমরাও রাতদিন কাজ করি। নারী শ্রমিকরাও মজুরি পান। আমিও স্থানীয় কয়েকজন নারী শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছিলাম।”
‘একটা হার্ভেস্টার ১০০ শ্রমিকের কাজ করে’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হাওরভুক্ত সাত জেলায় এবার ৪ হাজার ৪০০টির বেশি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা চলেছে। এর মধ্যে এ বছরই নতুন ১০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশের অন্য এলাকা থেকেও হাওরের বোরো ধান কাটার জন্য কম্বাইন হার্ভেস্টার নিয়ে আসা হয়েছে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে ধান কাটা সম্ভব হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, কৃষকের পাকা ধান দ্রুত কাটতে ৭০ ভাগ ভর্তুকিতে সরকার প্রায় ৮৫০টি হার্ভেস্টর যন্ত্র দিয়েছে। এর মধ্যে ৬ শতাধিক যন্ত্রই সচল ছিল।
“একটি যন্ত্র একদিনে ১০০ শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। এ ছাড়া আরও ২০০টির মতো রিপার আছে। রিপারে দৈনিক ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে।
এ ছাড়া ১ লাখ ৯০ হাজার শ্রমিক, ৩০ হাজার মৌসুমি শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরও প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক সুনামগঞ্জে এবার ধান কেটেছেন বলে জানান বিমল চন্দ্র সোম।