ফেইসবুকে ‘কথা’ দিয়ে যারা গাছ লাগান, আর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা না করে যারা গাছ লাগান, তাদের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।
Published : 28 Apr 2024, 12:07 PM
আমাদের দেশের মানুষের একটা অদ্ভুত ও ইউনিক বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্যটি শর্ট-টাইম-মেমোরি-লস, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা আর স্ববিরোধিতা দিয়ে তৈরি। যেমন একটা উদাহরণ দেই। বিশজন মানুষ আধ ঘণ্টা ধরে টিকেট হাতে বাস কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে। অবশেষে যে বাসটি এল তাও পুরো ভর্তি অবস্থায়। লাইনে দাঁড়ানো পাঁচ নম্বর মানুষটি বাসের ভেতরে থাকাদের উদ্দেশে বলতে লাগলেন, ভাই আপনাদের কোনো আক্কেল নাই? মাঝখানে দাঁড়ায় আছেন কেন? পেছনে যান। এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। অফিসে তো আমাদেরও যেতে হবে, না কি?
এরপর তিনি ঠ্যালা-ধাক্কা দিয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে পড়লেন বাসে। দরজা পেরিয়ে ইঞ্জিনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওই একই লোক আবার চিৎকার করা শুরু করে দিল, এবার লক্ষ্য ড্রাইভার। চিৎকার করে বলবে: ‘এই ব্যাটা ড্রাইভার, গাড়ি ছাড়িস না কেন। এখন অফিসের সময়, দেরি হয়ে যাচ্ছে। এটা কি মুড়ির টিন যে মানুষ ঝাঁকায় ভরবি? আর কত মানুষ নিবি? এক স্টপেজে আধাঘণ্টা দাঁড়ায় থাকে আবার ভাড়া নেয় বিশ টাকা!’ কেউ যদি ভুলেও বলে ভাই একটু পিছনে যান না তবে তিনি উত্তর দেন: ‘পিছে যাবো কই, মানুষের মাথার ওপর? চোখে দেখেন না? পরের বাসে আসেন, দেখতেছেন তো জায়গা নাই।’
এক মিনিট আগের কথাগুলো ভুলতে ভদ্রলোকের ত্রিশ সেকেন্ডও লাগে না।
আমরা আমাদের নিজেদের দোষ ছাড়া পৃথিবীর আর সবার দোষ ধরি ও সেটা ঠিক করতে ব্যস্ত থাকি। আমার পানির ট্যাঙ্কি ওভারলোড হয়ে আধ ঘণ্টা ধরে পানি পড়ে; আমি দেখি না। রাস্তায় পাইপের একটা লিক দিয়ে পানি বেরোচ্ছে; ওয়াসার দারোয়ান থেকে শুরু করে চিফ ইঞ্জিনিয়ার, এমনকি পানি সম্পদ মন্ত্রী অবধি ধুয়ে ফেলি। তিতাস গ্যাসের মিটার রিডার ঢাকায় পাঁচতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলল, এই দুর্নীতির প্রতিবাদ আমি করি সব সময় চুলা জ্বালিয়ে রেখে। চুলা এক ঘণ্টা জ্বললে যা বিল, ২৪ ঘণ্টা জ্বললেও তাই। মাঝখান থেকে আমি দেয়াশলাইয়ের পয়সা বাঁচাই টিনের ছাঁপড়া ঘর তুলব বলে!
একসময় আমরা শুনতাম বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। এই গ্যাস ভারতে রপ্তানি হবে কিনা তা নিয়ে গরম গরম বিতর্ক হতো। আর এখন গ্যাসের অভাবে সার কারখানা বন্ধ। গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে— এই আশায় দশটা কেন্দ্র বানানো হলো। এগুলো এখন বেকার। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে দেয়ার মতো গ্যাস নেই। আগে বললি না কেন বাবা?
বলেছি তো গ্যাস নেই, কিন্তু শুনেছে কে?
১০০ কিউবিক ফুট গ্যাস থাকলে ওঠে ৫০ কিউবিক ফুট, গ্যাস তো গ্যাস— একটা প্রেশার থাকতে হয় তুলতে হলে। কুয়াতে বালতি ফেলে পানির মতো তোলা যায় না!
আমরা অবশ্য চালাক জাতি। গ্যাস নিয়ে নানা বিতর্ক-বিসংবাদ কম হয়নি। এসব কলহ থেকে মুক্ত হতে আমাদের দেশের যা গ্যাস আছে তা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলছি। গাড়ি চালাচ্ছি গ্যাস দিয়ে, ওষুধ বানাচ্ছি, গার্মেন্টস চালাচ্ছি আর শিখা অনির্বাণ তো ঘরে ঘরে। গ্যাস শেষ তো চিন্তাও শেষ— ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয়!
পানির ব্যাপারটা আরও মর্মান্তিক। বাংলাদেশ যে পানির দেশ এটা জানতে ইউএস এনার্জির রিপোর্ট লাগে না। সেই পানির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলেছি। হাজারিবাগে যার চামড়ার কারখানা সে তুরাগ নদী দেখে দুঃখ করে বলে ‘সব তো খাইলি তোরা নদীও গিলে খাইলি।’ যে জায়গায় দুই বাঁশ সমান উচ্চতার পানি ছিল সে জায়গায় বালি ফেলে ‘মডেল টাউন’ বানানো অবৈধ দখলদার ভূমিশিল্পপতি বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে এসি গাড়িতেও নাকে রুমাল দিয়ে বলে ‘ডার্টি নেশন— এভাবে মানুষ নদীতে নোংরা ফেলে?’ ঢাকা শহরের মধ্যে এক কাঠা জমিও ফাঁকা থাকে না, কিছু একটা বানিয়ে বসে থাকে— কি সরকারি কি বেসরকারি। বৃষ্টি যখন হয় তখন পানি মাটির নিচে যাবার পথ খুঁজে পায় না, মানুষের বাসায় জমে বসে থাকে। ওই বাড়ির মালিক দু-দফায় সরকারকে গাল পাড়ে একবার ড্রেনেজ সিস্টেম খারাপ বলে আরেকবার শুকনো মৌসুমে পানি পায় না বলে। আরে বাবা পানি যে মাটির তলা থেকে উঠবে সেখানে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করল কে? সরকারের সংস্থা–গৃহায়ণ অধিদপ্তর, তারা পর্যন্ত খালে-বিলে বালু ফেলে প্লট বানাচ্ছে। আগে সাপ কামড়াত, এখন ওঝা নিজেই কামড়ায়! পালাবি কোথায়?
বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ। বেশিভাগ ভূমিই পলি-জমা উপত্যকা। যেটুকু শক্ত মাটি আছে তার তলায় সামান্য কিছু গ্যাস-কয়লা আছে। কিন্তু এগুলো তুলবার বিদ্যা আমাদের জানা নেই। তাই বিদেশি শেয়ালকে দিয়েছি মুরগির খামার করতে। ইচ্ছেমত খায় ইচ্ছেমত ছড়ায়, দয়া হলে কিছু দেয়। দেশের মেধার ‘সর্বোচ্চ আড়ত’ বুয়েট থেকে মেধাবী কিছু ইঞ্জিনিয়ার বের হয়। যারা ভালো তারা চলে যায় দেশের বাইরে, ওখান থেকে দেশ গেল, দেশের কি হবে টাইপের লেখালেখি করে। আর যারা দেশে আসতে চান, এদের সরকার আনতে চায় না। পাছে শেয়ালেরা বেজার হয়। অবশ্য অনেকে দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে নিজেই শেয়ালে পরিণত হন। প্রশ্ন হলো, আমাদের যেটুকু সম্পদ আছে, তা দিয়ে এতগুলো মানুষের চাহিদা কীভাবে মিটবে? দেশে যেখানে গ্যাস নেই সেখানে টারবাইন ঘুরবে কীভাবে আর বিদ্যুতইবা তৈরি হবে কীভাবে? আর এখনো বা যেটুকু হচ্ছে দশ বছর পর কীভাবে হবে?
এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আল্লাহর কোনো বান্দার চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। গাছপালা বন উজাড় করে জলাভূমি-নদী ভরাট করে সবাই মিলে বড়লোক আর উন্নতির পথে দৌড়াচ্ছি। গাছ থাকলেই দেশটাকে একদম জঙ্গল জঙ্গল মনে হয়। বেশি বেশি গাছ মানেই বেশি ঝামেলা। এজন্যই হয়তো ঝামেলা এড়াতে আমাদের দেশে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সবার আগে গাছ কেটে ফেলা হয়। জলাশয় মেরে ফেলার কারণে, বন-জঙ্গল-গাছ উজাড় হওয়ার কারণে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে এখন ঠিকঠাকমতো বৃষ্টি হয় না। গরম ও তাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় কেউ ব্যাঙের বিয়ে দেয়, কেউবা স্রষ্টার কাছে বৃষ্টির জন্য মোনাজাত করে। আবার কেউ কেউ ‘নারীরা পর্দা করে না’ বলে ‘আল্লাহর গজব’ নামার কথা বলে। কেউ নিজের দোষ দেখে না। সবাই আরেকজনের ওপর দায় চাপায়। হালের সরকার দোষ দেয় আগের সরকারের। আগের আমলের মন্ত্রী-সান্ত্রীরা ফতোয়া দেন এই সরকারের আর ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। চালুনি বলে সুই তোর পেছনে কেন ছ্যাঁদা? এই অবস্থা চলছে যুগের পর যুগ ধরে।
মহাকবি কালিদাস সম্পর্কে একটা গল্প চালু আছে৷ বলা হয়, কম বয়সে তিনি গাছের ডালের আগায় বসে সেই ডালটাকেই কাটতে উদ্যত হয়েছিলেন৷ আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষের কাজকর্ম দেখে সেই গল্প স্মরণে আসে। কালিদাস শুধু একটা গাছের ডাল কাটতে গিয়েছিলেন, আর এক শ্রেণির মানুষ লাভের আশায় দিনের পর দিন বহুমূল্যবান গাছ কেটে চলেছে৷ প্রসঙ্গত, গাছের মূল্য শুধু তার কাঠের দর দিয়ে নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় অক্সিজেন নির্গমণের পরিমাণ দিয়ে৷ পরিবেশকে কলুষমুক্ত রাখতে গাছই ভরসা৷ অথচ গাছ কাটা চলেছে সর্বত্র৷ কখনো উন্নয়ন, কখনো সৌন্দর্যবৃদ্ধি, কখনো গাছ বিক্রির টাকা পকেটে ভরার লোভ ইত্যাদি কারণে গাছকাটা অবিরাম চলছে।
এক শ্রেণির মানুষ আছেন যারা নিজেরা গাছ না লাগালেও গাছ-লাগানোর পক্ষে নিয়মিত ক্যাম্পেইন চালিয়ে যান। ফেইসবুকে আহবান জানান: আসুন সবাই অন্তত দুটি করে গাছ লাগাই। এই আহবান শত শত হাজার হাজার শেয়ার হয়। কিন্তু কেউই গাছ লাগান না। সবাই কেবল আহবান জানান!
ওদিকে আমাদের দেশে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে প্রতিবছর ঘটা করে বৃক্ষরোপণ অভিযান পরিচালনা করে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরও প্রতি বছর বর্ষাকালে পরিবেশ দিবসকে ধরে নিয়মিত গাছ লাগায়। হ্যাঁ, অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেক টাকা ব্যয় করে, অনেক বাদ্য বাজিয়ে প্রতিবছর একই স্থানে, একই গর্তে এসব গাছ লাগানো হয়! এরপর তা গরু-ছাগলের খাদ্য হয়। অথবা অযত্নে মরে যায়। ফেইসবুকে ‘কথা’ দিয়ে যারা গাছ লাগান, আর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা না করে যারা গাছ লাগান, তাদের মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।
আসলে আমরা খুবই চতুর। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে খ্যাতিপাওয়া তথাকথিত মোটিভেশনাল স্পিকারদের মতো আমরা সবাই ভালো সাজতে চাই, কিন্তু কেউ ভালো হতে চাই না। ভালো সাজা সহজ, কিন্তু ভালো হওয়াটা খুব কঠিন। কঠিন কাজ আমরা কেউই পছন্দ করি না।
পরিশেষে আমাদের সুবিধাবাদিতা নিয়ে একটি পুরনো কৌতুক।
এক লোক ফায়ার সার্ভিসে ফোন করেছে। ফায়ারকর্মী ফোন রিসিভ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন।’ ‘আগুন লেগেছে ভাই। আমার একটি ফুলের বাগান আছে, বাগানে অনেক রকমের ফুলের গাছ আছে।’ ‘বুঝতে পেরেছি। দয়া করে তাড়াতাড়ি বলুন কোথায় আসতে হবে?’
‘আমার বাগানের ফুলের গাছগুলো কিন্তু খুব দামি।’
‘বুঝতে পেরেছি, কোথায় আগুন লেগেছে তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘বলছি বলছি, বলার জন্যই তো ফোন করেছি। আগুন লেগেছে আমার পাশের বাড়িতে। উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টর, ৩ নম্বর রোড, ২২২ নম্বর বাসা। আপনারা তো আগুন নেভাতে আসবেন, তাই অনুরোধ আপনারা যখন আগুন নেভাবেন সে সময় আমার বাগানটাতেও একটু পানি ছিটিয়ে দেবেন!’