আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় আমলারাই ভরসা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের জন্য পারলে আলাদা শহর, আলাদা রাজধানী, আলাদা সড়ক থাকা দরকার।
Published : 05 May 2024, 04:41 PM
একজনের নামে বদনাম করতে না পারলে, কলঙ্ক আরোপ করতে না পারলে, গালাগাল দিতে না পারলে আমাদের দেশের মানুষের ভাত হজম হয় না। বিশেষ করে যারা একটু ভালো আছে, এগিয়ে আছে, তাদের ব্যাপারে তো সমাজের মানুষের মহা-অ্যালার্জি। চান্স পেলেই সমালোচনা-নিন্দা করা হয়।
আমলাদের কথাই ধরা যাক। গণমাধ্যমে সামান্য একটা খবর বেরিয়েছে যে, আমলারা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য আলাদা একটা বিশ্ববিদ্যালয় চান। এই সংবাদ পাঠ করেই ফেইসবুকবাসী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। শুরু হয়েছে নিন্দা আর সমালোচনার ঝড়! যেন তারা বিরাট অন্যায় করে ফেলেছেন! কেন বাবা নিজের সন্তানদের ভালো কে না চায়? নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, মানুষের মতো মানুষ বানানোর জন্য আলাদা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা খুবই উন্নত একটা প্রস্তাব। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান খুব খারাপ। বিশ্বমান তো দূরের কথা এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় আমাদেরগুলোর অবস্থান তিনশর পরে। এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমলাদের সন্তান পড়ে কীভাবে? সাধারণ মানুষের না হয় কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাদের সন্তানরা এখানকার যেকোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লিখিয়ে কোনোমতে একটা সার্টিফিকেট বাগিয়ে তাইরে-নাইরে করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আমলার সন্তানরা তা কীভাবে পারে? নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। আমলারা বুঝলেই দোষ?
আমলারা কী ফেলনা? দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য না হোক, পরিবারের জন্য নিজের ভবিষ্যতের জন্য তারা কী কিছুই করতে পারবে না? এই দেশে আমলা হওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। দিনের পর দিন বিসিএস গাইড মুখস্ত করা, কত কত তথ্য মগজে ঢুকানো, বাছাই পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, মেডিকেল টেস্ট, ফিটনেস, থানা পুলিশের ‘রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না’-সংক্রান্ত সনদ ইত্যাদি পার হয়ে তবেই একজন আমলা হওয়া। এরপর কয়েক বছর শুধু ট্রেনিং আর ট্রেনিং। ঘষে-মেজে একজন দক্ষ আমলায় পরিণত করার সীমাহীন প্রয়াস। এই আমলারাই দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। প্রশাসন পরিচালনাকারী। রাষ্ট্রের স্থায়ী কর্মচারী। সন্তানদের জন্য তারা একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাইবে না তো কি বাদুড়ঝুলা বহুমুখী সমবায় সমিতির লোকেরা চাইবে?
আমাদের সমাজে আমলাদের সমালোচনার মূল কারণ তাদের সামাজিক অবস্থান। এদেশে যারা সবচেয়ে ভালো আছে, তারা হলেন আমলাশ্রেণি। তাদের অর্থ আছে, বিত্ত আছে, সীমাহীন ক্ষমতা আছে, বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, নিরাপত্তা আছে, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আছে, টাকা বানানোর অসংখ্য সোজা ও বাঁকা পথের সন্ধান আছে। তাই তাদের ব্যাপারে এত সমালোচনা। আমলারা ভদ্র-নম্র-শান্ত বলেই তাদের নিয়ে ফেইসবুকবাসী এত-এত কটূকথা বলতে পারছে। আমলারা যদি ষাঁড়ের মতো গুঁতাতে পারত, তাহলে তাদের নিয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না!
আমাদের দেশে কোনো কোনো পেশাজীবী গ্রুপ আছে যাদের আলাদা হাসপাতাল, ব্যাংক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কেট, আবাসিক, এমনকি পোশাক পর্যন্ত আছে। তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু বলে না। অথচ আমলারা সন্তানদের জন্য আলাদা একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাইতেই এত শোরগোল?
আমলাদের ব্যাপারে আমাদের ইতিবাচক হতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এ অবস্থায় আমলারাই ভরসা। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, তাদের জন্য পারলে আলাদা শহর, আলাদা রাজধানী, আলাদা সড়ক থাকা দরকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হাসপাতাল, ট্রেন, দূরপাল্লার বাস, লন্ড্রি, পাবলিক টয়লেট ইত্যাদিও থাকা দরকার। সবখানে তাদের আলাদা ব্যবস্থা থাকা দরকার। সারাদেশে সবখানে ‘আমলাদের জন্য সংরক্ষিত’ স্থান বরাদ্দ রেখে সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা দরকার।
আমাদের বই-পুস্তকগুলোও সংশোধন হওয়া দরকার। সেখানে আমলাদের সাফল্যের গল্প, জিরো থেকে হিরো হবার কাহিনি স্থান পাবে। রূপকথার কাহিনি নয়, আমলা, আমলাদের সন্তান, তাদের নাতিপুতির গল্প থাকবে সেখানে। সাধারণ মানুষের সন্তানরা যেন সে কাহিনি পড়ে অনুপ্রাণিত হতে পারে। নিজেরা ভবিষ্যতে আমলা হবার স্বপ্ন দেখতে পারে। খেলাধুলা নয়, বাঁদরামি নয়, ছেলেমেয়েদের ধ্যানজ্ঞান হবে পড়া আর পড়া। জ্ঞানভিত্তিক একটি ডিজিটাল সমাজ গড়তে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
আমলাদেরও নিজেদের ভবিষ্যৎ আরও ঝরঝরে করার ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত। তাদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা দরকার। সংগঠন ছাড়া এ যুগে সফল হওয়া কঠিন। ওসব বিসিএস সমিতি-টমিতি দিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজন রাজনৈতিক সংগঠন। ওই সংগঠনের প্রধান কে হবেন? প্রধান হবেন তিনি যিনি চাটুকারিতায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন। এই পোস্ট দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, এখনো কানাঘুষা শোনা যায় যে, আমলাদের বদলিতে পেঁয়াজের যেমন সিন্ডিকেট আছে, লবণের যেমন সিন্ডিকেট আছে তেমন আমলাদেরও সিন্ডিকেট আছে। ওই সিন্ডিকেটের সন্ধান যদি ঠিকমতো পাওয়া যায় তাহলে তরতর করে ওপরে উঠতে দেরি হয় না। এমনকি তিনি আগেই ঠিক করে ফেলতে পারেন চাকরিতে যখন তিনি রিটায়ারমেন্টে যাবেন তখন তিনি কোন পোস্টে যাবেন। সেটার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়া প্রয়োজন।
আরেকটি কথা, সমালোচনাকে পাত্তা দিলে হবে না। আপনাদের দুই কান কাটা হতে হবে। মনে রাখবেন, আমলাদের নিয়ে সবাই সমালোচনা করতে পছন্দ করে। ভারতের নামজাদা অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু পর্যন্ত 'পলিসিমেকার্স জার্নাল’ নামক স্মৃতিকথায় আমলাদের বিষয়ে অনেক কিছু বলেছেন। তিনি লিখেছেন, বিশেষ চিহ্ন দেয়া তোয়ালে। উঁচু-নিচু করা যায় এমন চেয়ার, যাতে করে অন্যদের তুলনায় নিজেকে সবসময় উচুঁতে রাখা যায়। যেকোনো কিছুতেই ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে একগাদা অনুমতি আদায়ের হিড়িক। আর সময়ানুবর্তিতা বাড়ানোর জন্য নিরলস চেষ্টা।
অধ্যাপক বসু তার বইতে লিখেছেন, একবার তিনি এক সরকারি সভা চলার সময় কতবার এই স্যার শব্দটি বলা হয়, সেটার হিসেব রাখবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি গুনে দেখলেন, একজন সিনিয়র আমলা “গড়ে প্রতি মিনিটে ১৬ বার করে স্যার বলছিলেন (সেখানে একজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন)।” অধ্যাপক বসু হিসেব করে দেখলেন, ওই আমলার প্রতিবার স্যার বলতে যদি আধা সেকেন্ড করে সময় লেগে থাকে, তিনি যতক্ষণ কথা বলেছেন, তার ১৩ শতাংশ সময় ধরে কেবল স্যারই বলে গেছেন।
অধ্যাপক বসু আরও লিখেছেন, “কোনো কিছুর অনুমতির জন্য আবেদনপত্র সাধারণত আমলাতন্ত্রের পিরামিড কাঠামোর নিচ হতে উপরের দিকে যায়। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এর মধ্যে একেবারে মামুলি কিছু বিষয়ও একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে, মন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়।”
কাজেই লোকজন সবকিছুর জন্যই অনুমতি চায়— কোনো অসুস্থ আত্মীয়কে দেখার জন্য একদিন ছুটি নেয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয়ে কোন ব্রান্ডের কফি পরিবেশন করা হবে সেটি, কিংবা বিশ্রাম কক্ষকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আরেকজন সহকারী নিয়োগের জন্যও।
অধ্যাপক বসু লিখেছেন, “এ ধরনের প্রস্তাবগুলো কার্ডবোর্ডের ফোল্ডারে ফিতা দিয়ে বাঁধা অবস্থায় এক রুম হতে আরেক রুমে, আমলাতন্ত্রের নিচ হতে উপরে ঘুরতে থাকে। ফাইলটি ভরে উঠতে থাকে ঊর্ধ্বতন আমলাদের লেখা নোটে।”
অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় অধ্যাপক বসু দেখেছিলেন বিভিন্ন সরকারি নথি এবং কাগজপত্র যেসব ফোল্ডারে রাখা হয়, তার প্রতিটিতে দুটি পাতা থাকে, যেখানে ৪৪টি বহুল ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ পাওয়া যাবে। বিভিন্ন দফতরের প্রধান এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এগুলো লিখে থাকেন। যেটা তাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তা হলো সেখানে কোনো কাজে দেরি না করা এবং সময়মত শেষ করার জন্য যেভাবে তাগিদ দেয়া হয়। যেমন:
‘অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নিন’; ‘বিলম্ব সহ্য করা হবে না’; ‘বিলম্ব অবশ্যই পরিহার করতে হবে’; ‘দেরি হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে হবে’; ‘আজকেই জবাব দিন/কোনো বিলম্ব ছাড়া এখনই জবাব দিন’; আজকেই ইস্যু করুন’ ইত্যাদি।
আমলাদের নিয়ে যে কেবল কৌশিক বসুর মতো অর্থনীতিবিদই ইয়ার্কি করেছেন তা নয়, এমনকি গত শতকের ষাটের দশকে আবদুল গণি হাজারী নামে এক কবি ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি উল্লেখ করছি:
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী/ তোমার দিকে মুখ ফেরালাম/ হে প্রভু আমাদের ত্রাণ করো/ বিশ্রামে বিধ্বস্ত আমরা/কতিপয় আমলার স্ত্রী/ হে প্রভু আমাদের স্বামীরা/ অগাধ নথিপত্রে ডুবুরি/ (কি তোলে তা তারাই জানে)
পরিবার-পরিকল্পনায় আমরা নিঃস্ব/ সময় আমাদের পিষ্ট করে যায়/ আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী/ সকাল থেকে সন্ধ্যা/ কোন মহৎ চিন্তার কিনারে/ এবং ফ্যাশান পত্রিকার বিবর্ণ পাতা/ দৈনিক কাগজে সিনেমার ইস্তেহার/ স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের উলঙ্গ ছবি/ এবং একটি প্রাপ্ত-প্রায় মহত্ত্বের শিহরণ।
কোমরের উপত্যকায় মেদের আক্রমণ/ উদরের স্ফীতি/ চিবুকের দ্বিত্ব/ স্তনের অস্বাস্থ্যে শংকিত/ হে প্রভু আমরা/ চর্বির মসোলিয়ামে হাঁসফাঁস/ আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী/ ভাঁড়ার আমাদের লক্ষী/ বালিশের ভাঁজে উদ্বৃত্ত হাত খরচ/ আয়নার দেরাজে হেলেন কার্টিস/ এনি ফ্রেঞ্চ-মিল্ক/ এষ্ট্রিনযেন্ট/ ডিওডরেন্ট হ্যান্ড লোশন/ রেভ্লন ক্রিশ্চিয়ান ডিয়োর/ এবং রুবিনষ্টিন/ অবশ্য স্বামীদের কাছ থেকেই/ উষ্ণ প্রেমের ঘাট্তির/ প্রৌঢ় ক্ষতিপূরণ/ আর্দালীর কুর্নিশে গর্বিত/ স্বামীরা অফিসে সর্বক্ষণ/ অন্যের পদোন্নতির বাধা/ দরখাস্ত নাকচ/ এবং কতিপয় পদস্থ দস্তখত/ বাড়ী ফিরেও হায়/ বন্ধুর প্রমোশনে ঈর্ষিত/ বেনামী ব্যবসার লাভক্ষতি/ তারপর টেলিফোন/ তারপর টেলিফোন/ তারপরও টেলিফোন/ আমাদের ঠোঁটের রেভ্লন/ মুখের ফাউন্ডেশন/ কপালের সযত্ন টিপ/ শুকিয়ে আসে/ বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি/ অতঃপর হে প্রভু/ দ্বিতীয় ব্যক্তির চিন্তা/ আমাদের উন্মনা করে যায়/ পুরাতন প্রেমিক বিবাহিত/ তরুণদের মাসী/ সাবর্ডিনেটের আম্মা/ বোনের সংসারে নানী/ এবং বৈকালের নিমন্ত্রণ বাসি/ বিলেতী পত্রিকার পাতায়/ মেগির প্রেম/ জ্যাকেলিনের স্তব/ লিজ টেলরের ছেনালী/ বি-বির মাপজোক/ লোলার লোলুপতা/ এবং মেরেলিনের আত্মহত্যা/ এবং আত্মহত্যা/ এবং আত্মহত্যা/ হায়রে বৈকালের নিমন্ত্রণ/ অতঃপর হে প্রভু/ আমাদের রাত্রির শরীর পান্সে/ জানালার চাঁদ নিরক্ত/ ব্যবহৃত দেহ/ নাকডাকা স্বামী/ বিনিদ্র রাত/ এবং ট্র্যাংকুইলাইজার/ হে প্রভু অনন্যোপায়/ তোমার দিকে মুখ ফেরালাম/ আমাদের কোন কাজ দাও/ ভ্যানিটি ব্যাগে আয়না/ ফাউন্ডেশন আর গ্যালার রং/ এবং সমাজ সেবা/ কিন্ডারগার্টেনের শ্রাদ্ধ/ লেডিজ ক্লাবের সামনের সীট/ কিংবা স্বামীর পদাধিকারে/ শিশুসদনের উদ্বোধন-আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী/ হে প্রভু/ যে-কোন একটা কাজ দাও/ নিজেদের নিক্ষেপ করি/ তার গহ্বরে।
কাজেই হে আমলাগণ, সমালোচনায় কান দিবেন না। কানে তুলা প্রয়োজনে পিঠে কুলা বেধে আপনারা লক্ষ্যে অবিচল থাকুন। জয় আপনাদের সুনিশ্চিত!