রাষ্ট্র নিজে যখন দুষ্ট দমনের সকল কলকব্জা দিয়ে উল্টো শিষ্টেরই গলা টিপে ধরতে থাকে, তখন যে সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তার অনেকখানিই চাপা পড়ে এ সকল পুরস্কার ও তার আয়োজনের ঘটা আর ছটার মধ্যে।
Published : 28 Apr 2024, 08:42 PM
পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রই তার কবি-সাহিত্যিক-লেখক-শিল্পীদের কাজের স্বীকৃতি দেয়, পুরস্কার দেয়। মূলত তিনটি কারণে রাষ্ট্র এটা করে থাকে।
প্রথমত, একটা রাষ্ট্র ও তার শত শত কলকব্জা বা প্রতিষ্ঠান যেভাবে কাজকাম বা ফাংশন করে, সেখানে লেখকেরা যদিও অংশী বা পার্ট নয় সে-অর্থে, কিন্তু তারা যেটা করেন, রাষ্ট্র ও তার কলকব্জাগুলোর নানা ধরণের সংকট, ত্রুটি-বিচ্যুতি বা সীমাবদ্ধতাকে শনাক্ত করেন; এগুলোর পরিণাম-পরিণতি-ভবিষ্যৎ ইত্যাদি অনুমান ও বিশ্লেষণ করেন; এবং প্রথাগত বিবেচার বাইরে গিয়ে সূক্ষ্ম বোধ ও প্রখর কাণ্ডজ্ঞান থেকে করণীয় নির্ধারণ করেন। এটা তারা শুধু তত্ত্ব ও তথ্য দিয়েই করেন না— করেন আবেগে বা বিবেকে বা মরমে ঘা দিয়েও। এমনকি রাষ্ট্রের সমূহ বিপর্যয়ের কালে রাষ্ট্রের কোনো কলকব্জা তার নিজেরই নির্ধারিত করণীয় না করলে, বা উল্টোটা করলে, প্রয়োজনে তারা নির্মোহভাবে বাদ-প্রতিবাদেও শামিল হন। এতে করে রাষ্ট্রের শাসক তাদের প্রতি রুষ্ট হলেও সমাজ তার সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পায়, এবং তাতে মানুষের কল্যাণ হয়। সমাজের কল্যাণ শেষাবধি রাষ্ট্রেরই কল্যাণ। এই দূরবর্তী বৃহৎ স্বার্থ থেকেই মূলত রাষ্ট্র তার নাগরিকের সৃজন-মনন-জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে পুরস্কৃত করে থাকে।
দুই হচ্ছে, নাগরিকেরা যাতে রাষ্ট্রের প্রত্যাশিত ইতিবাচক আচরণ করে এবং তাদের কল্যাণ যেন রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত পথ ধরেই হয় তার জন্য রাষ্ট্র বহু টাকা-পয়সা ব্যয় করে যে বহু ধরণের দপ্তর-অধিদপ্তর-বিভাগ-মন্ত্রণালয়-বাহিনী ইত্যাদি গড়ে তোলে, কবি-সাহিত্যিক-লেখকরা টাকা-পয়সা ছাড়াই সৃজন-মননের তাগিদে যা করেন তাতে রাষ্ট্রের সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরোক্ষভাবে অনেকখানিই হাসিল হয়ে যায়। সে-কারণে রাষ্ট্র সেই গুণীজন কিংবা ঘরে-খেয়ে বনে বিচরণকারীদের চিহ্নিত করতে চায়। চিহ্নিত করে নাগরিকের মাঝেও এমত প্রণোদনা সৃষ্টি করতে ও জাগ্রত রাখতে তাদের সৃজন-মননজাত সাফল্যকে নানা উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে পুরস্কৃত করতে চায়। অর্থাৎ পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র একদিকে তাদের এই ভূমিকাকে যেমন স্বীকৃতি দেয়, তেমনি সেই মহাজনদের পথ অনুসরণ করতেও নাগরিকদের প্ররোচিত করে।
তৃতীয় কারণটি আলাপের আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেন পুরস্কার দেয় এই আলাপটা সেরে আসা প্রয়োজন। এই রাষ্ট্র প্রতিদিন খুন করছে— এ কথা যদি কেউ বলেন, তো তিনি পুরস্কার পাবেন না। এই রাষ্ট্র প্রতিদিন জুলুম-অন্যায়-অবিচার করছে—এ যদি কেউ বলেন তো তিনিও পুরস্কার পাবেন না। এরকম আরো অনেক কিছু বললে বা করলে তিনি পুরস্কার পাবেন না। এমনকি একটা সরকার চায় না, এমন কিছু করলে বা বললেও তিনি সেই বিশেষ সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত পুরস্কার পাবেন না। সেজন্য সরকার বা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের সাথে এখানকার পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাড়ির এক ধরণের মিল পাওয়া যায়। যদি কারো ক্ষেত্রে না পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে সেই অমিলটা মূলত মিলটাকে এক ধরণের সামাজিক বৈধতা দেওয়ার নিমিত্তেই, অন্য কিছু নয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরস্কার প্রদানের তৃতীয় প্রধান কারণটা সংশ্লিষ্ট। এটা হলো, রাষ্ট্র তৈরি হয় মূলত বলপ্রয়োগের যন্ত্র হিসাবে; এবং সেই বলপ্রয়োগের যৌক্তিকতা সৃষ্টির জন্য ইতিবাচক প্রপঞ্চ যেটা নির্মাণ করা হয় তা হলো, শিষ্টকে বাঁচাতে ও তার বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে দুষ্টের উপর বলপ্রয়োগ করা প্রয়োজন— এ না হলে সমাজ দুষ্টে ছেয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্র নিজে যখন দুষ্ট দমনের সকল কলকব্জা দিয়ে উল্টো শিষ্টেরই গলা টিপে ধরতে থাকে, তখন যে সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তার অনেকখানিই চাপা পড়ে এ সকল পুরস্কার ও তার আয়োজনের ঘটা আর ছটার মধ্যে। তাই এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হাত থেকে যে যেই পুরস্কারই যতো যোগ্য বা অযোগ্য হয়েই গ্রহণ করুন না কেন, তা রাষ্ট্রের পুরস্কার প্রদানের এই তৃতীয় উদ্দেশ্যটাই সাধন করার সুযোগ সৃষ্টি করে।
তাহলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কেন লেখকদের পুরস্কার দেয়?
এটার কারণ আমরা সবাই জানি যে, সমাজ থেকে মুনাফা করে সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটির প্রকাশ আয়োজনের ঘটা আর ছটা দেখিয়ে প্রথমে বৃহৎ সামাজিক পুঁজি সৃষ্টি করা, এবং এরপর তার মাধ্যমে আরো মুনাফার সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। কিন্তু রাষ্ট্র ও তার অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তৃতীয় কারণে পুরস্কার দেয় তবে সমাজ এমনভাবে কলূষিত হয় যে, সেখানে তেল আর ঘি-এর কোনো আলাদা লেভেল থাকে না, সবই এক বাটখারায় মাপা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেরও কোনো চরিত্রই দাঁড়ায় না— রক্ষা করা দূরে থাক। বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের বেসরকারি পুরস্কারও তাই এমত চরিত্রহীন।
ধুরন্ধর রাষ্ট্র আর চরিত্রহীন প্রতিষ্ঠানের এসব পুরস্কার তাই সমাজে খুব একটা অর্থ-তাৎপর্য আর গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না; পুরস্কারপ্রাপ্তদের খুব একটা সামাজিক মূল্যও তাই সৃষ্টি হয় না। অসংখ্য পুরস্কার পেতে পেতে তারা ক্রমশ একধরণের এতিম হয়ে ওঠে। শেষে সামনে কিছু আর না দেখে শেষ বয়সে অনেকেই এক ধরণের প্রতিবন্ধীসুলভ আচরণ করতে থাকে।
রাষ্ট্র আর সেইসব প্রতিষ্ঠান তখন এই বলে হাসে: তিন টাকার পুরস্কার দিয়ে তিন লাখ টাকার ঘটা করে তিনশো কোটি টাকার সুনাম কিনেছি— তিন হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বৈধতা বানিয়েছি! মর শালারা পুরস্কার নিয়ে!
হুমায়ূন আহমেদের একটা সুন্দর লেখা আছে আহমদ ছফাকে নিয়ে, যেখানে তিনি ছফার পুরস্কার পাওয়া বিষয়ে যে উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলেন তার পরিণাম একই সাথে মজা করে ও করুণ রসে বর্ণনা করেছেন। আহা! আমাদের দুখিনী পুরস্কারগুলো!