এর চেয়েও কম রানে বাংলাদেশ অলআউট হয়েছে আগে নানা সময়ে, কিন্তু জিম্বাবুয়ের বোলিংয়ের বিপক্ষে এতটা বাজে ব্যাটিংয়ে ফুটে উঠল দেশের ব্যাটিংয়ের কঙ্কাল।
Published : 20 Apr 2025, 08:03 PM
আউট হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর টিভি পর্দায় দেখা গেল নাজমুল হোসেন শান্তকে। তখনও ডাগআউটে বসে আছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। মাথায় হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে তিনি শূন্য দৃষ্টিতে। হয়তো নিজের আউটের কথাই ভাবছিলেন তখনও। একটু পর হয়তো নিজের আউট ভুলেই গেলেন অধিনায়ক। তার সতীর্থরা যে বাজে শটের প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে গেলেন তাকেও!
সাদমান ইসলামকে দিয়ে শুরু। তার অনুসারী মাহমুদুল হাসান জয়। লাঞ্চের পর শান্তর সেই আউট। এরপর একে একে মুশফিকুর রহিম, মুমিনুল হক, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম। কাকে রেখে কার কথা বলা যায়! কেবল মিরাজের আউটের বোলারের কিছু কৃতিত্ব আছে। বাকিদের বিদায় একান্তই নিজেদের ‘উদারতায়।’ উইকেটে থাকার অপরাগতায়।
বাজে শটের ট্রফিটা তাদের যে কাউকে উপহার দেওয়া যায়!
১৯১ রানে গুটিয় যাওয়া মানে ভয়ঙ্কর বাজে কোনো স্কোর নয় অবশ্যই। নিজেদের ১৫১ টেস্টে ১০৭ বার এর চেয়ে কম রানে অলআউট হয়েছে বাংলাদেশ। সবশেষ টেস্টেই তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে প্রথম ইনিংসে ১৬৪ রানের পুঁজি নিয়েও। ভয়ঙ্কর ধস তো কতবারই নেমেছে এই দলের ব্যাটিংয়ে। কিন্তু জিম্বাবুয়ের এই মানের বোলিংয়ের বিপক্ষে দেশের মাঠে যে ব্যাটিং প্রদর্শনী মেলে ধরল বাংলাদেশ, শান্ত-মুশফিকরা যেভাবে উইকেটের মূল্যকে পায়ে পিষ্ট করলেন অনায়াস পায়ে, সবচেয়ে বাজে ব্যাটিং প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে থাকার জোর লড়াই করতে পারে এই ইনিংস।
এই মাঠেই দুই দলের সবশেষ টেস্টের উদাহরণ অবশ্য আসতে পারে। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের অভিষেক টেস্ট সেটি। ২০১৮ সালে সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ১৪৩ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬৯ রানে শেষ হয়ে ১৫১ রানে ম্যাচ হেরেছিল বাংলাদেশ।
এবার বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা বলবে সময়।
তবে তবে ব্যাটসম্যানদের সময়টা যে ভালো নয়, তা ফুটে উঠেছে আবার। প্রথম দিনে নিজেদের খাদের ফেলার সব আয়োজন করেছের ব্যাটসম্যানরাই। টেস্ট শুরুর দুই দিন আগে কোচ ফিল সিমন্স বলেছিলেন, টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের আগের চেয়ে আঁটসাঁট মনে হচ্ছে তার কাছে। সাদমান ইসলাম ও মাহমুদুল হাসান জয় যেন বুড়ো আঙুল দেখালেন কোচের চোখের সামনে।
প্রথম আট ওভারে ভালো খেলছিলেন দুজন। ভিক্টর নিয়াউচি আক্রমণে এসে শুরুতে ছিলেন একটু অগোছালো। কিন্তু দ্রুতই তিনি এলোমেলো করে দিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে।
তার ‘ওয়াইড অব দা স্টাম্প’ করা ডেলিভারির অ্যাঙ্গেল ধরতে পারলেন না সাদমান। শরীর থেকে দূরে আলগা এক ড্রাইভ খেলে ধরা পড়লেন তিনি গালিতে। তার পরের ওভারে বাইরের বলে দৃষ্টিকটূভাবে খোঁচা দিয়ে আউট জয়।
এই নিয়ে টানা ১৫ টেস্ট ইনিংসে ফিফটি নেই জয়ের। ক্যারিয়ারে এই একইভাবে কতবার আউট হলেন তিনি, নিজেও হয়তো বলতে পারবেন না।
দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা কিংবা উন্নতির কোনো ছাপ নেই!
অধিনায়ক শান্ত থিতু হয়েও আউট হচ্ছেন বারবার। ম্য্যাচের আগের দিন শুনিয়েছিলেন সেই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার প্রত্যয়। কিন্তু নিজেকে দেওয়া কথা রাখতে পারলেন না অধিনায়ক। ৪০ রানে উইকেট তুলে দিলেন প্রতিপক্ষের হাতে।
সবশষ ১৮ ইনিংসে তার ফিফটি একটি। সবশেষ ১০ ইনিংসর সাতটিতে ২০ ছুঁয়ে পঞ্চাশে যেতে পেরেছেন স্রেফ একবার। অধিনায়কের কাছে দলের দাবি তো আরও বেশি কিছু!
অভিজ্ঞতার দিক থেকে দাবিটা সবচেয়ে বেশি মুশফিকুর রহিম ও মুমিনুল হকের কাছে। প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করতে না পেরে ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন মুশফিক। তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার পরিচয় টিকে আছেন কেবল টেস্ট আঙিনাতেই। কিন্তু এখানেও তার পারফরম্যান্স তথৈবচ। এই নিয়ে টানা ১১ ইনিংসে ফিফটি নেই তার।
৪ রান করে আউট হয়েছেন এ দিন। রান না পাওয়ার চেয়েও চোখে পড়ার মতো ছিল তার আউট হওয়ার ধরন। বাঁহাতি স্পিনার ওয়েলিংটন মাসাকাদজার শর্ট ডেলিভারিটিতে কাট করতে পারতেন মুশফিক। অন সাইডে খেলতে পারতেন যে কোনো জায়গায়। কিন্তু তিনি তুলে দিলেন শর্ট মিড উইকেটের হাতে। নির্বিষ এক ডেলিভারিতে অনেক কষ্ট করে যেন সফল হলেন উইকেট বিলিয়ে দেওয়ায়।
ইনিংসের একমাত্র ফিফটি এসেছে মুমিনুলের ব্যাট থেকে। যদিও খুব দৃষ্টিসুখকর ছিল না তার ইনিংস, ভালো কয়েকটি শট খেললেও পরাস্ত হয়েছেন অনেকবার, শূন্য রানে জীবন পাওয়ার পর অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন কয়েকবার। সবকিছুর পরও টিকে ছিলেন। যখন তার কাছে প্রয়োজন ছিল আরও বড় কিছুম তখন তিনিও আত্মহত্যার মিছিলের স্বতস্ফূর্ত সৈনিক।
মেহেদী হাসান মিরাজ আউট হয়েছেন ব্লেসিং মুজারাবানির শর্ট বলে। বেশ ভালো বাউন্সার সেটি, তবে এমন ভয়ঙ্কর নয় যে এড়ানোই যাবে না। শর্ট বলে তার দুর্বলতা বের করে গত কিছুদিনে সব সংস্করণেই তার শরীর তাক করে বল করছে প্রতিপক্ষ দলগুলি। মিরাজ নিশ্চয়ই করণীয় বুঝতে পারছেন!
তাইজুল ইসলামকে একই কাতারে রাখা কঠিন। ব্যাটিং তো আর তার মূল কাজ নয়! তবে ব্যাট হাতে নানা সময়ে লড়াই করেছেন বলে তার দিকেও তাকিয়ে ছিল দল। বাজে শটের মেলায় তিনিও সেজেছেন অন্য ব্যাটসম্যানদের রূপেই।
জাকের আলি আউট হয়েছেন বড় শটের চেষ্টায়। লোয়ার অর্ডার দিয়ে আরেকটু লড়াইয়ের চেষ্টা হয়তো তিনি করতে পারতেন। তবে সঙ্গীহীনতার সময়টায় তাকে দায় দেওয়া কঠিন।
সবশেষ ১২ ইনিংসে এই নিয়ে আটবার দুইশর নিচে গুটিয়ে গেল বাংলাদেশ। ব্যাটিং ব্যর্থতা তাই সত্যিকার অর্থে নতুন কিছু নয়। তবে জিম্বাবুয়ের এই বোলিংয়ের বিপক্ষে দেশের মাঠে যেভাবে আউট হলেন একের পর এক ব্যাটসম্যান, এই দলের ব্যাটিং পৌঁছে গেল নতুন তলানিতে।