দীর্ঘদিনের চেনা প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের নতুন দিন বয়ে আনার অভিযান শুরু করতে চান বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
Published : 19 Apr 2025, 09:48 PM
ট্রফি উন্মোচনের আয়োজনে নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত নাজমুল হোসেন শান্ত। তখনও দেখা নেই ক্রেইগ আরভাইনের। কিছুক্ষণ পর সাদা জার্সি গায়ে চাপিয়ে মঞ্চের কাছে এলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে হাত মেলালেন বাংলাদেশ অধিনায়কের সঙ্গে। ট্রফি উন্মোচন পর্বে আরও কয়েক দফায় দেখা গেল দুজনের আন্তরিক করমর্দন। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীকী চিত্র ধরে নিতেও পারেন এটিকে।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে দীর্ঘ দিন ধরেই নিয়মিত দেখা হয় দুই দলের। তলানির দিকের দুই দলের লড়াইকে সামাজিক মাধ্যমে নানা মজার নামে ডাকেন অনেকে। তবে ক্রিকেটারদের তো আর ওসব কৌতূকে মজে যাওয়ার জো নেই। তারা পেশাদার, মনোযোগ তাই মাঠের ক্রিকেটেই। নতুন আরেকটি সিরিজ শুরুর আগে চেনা সেই দুই দলের সামনেই আছে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য।
সেই লক্ষ্যের পথে তাদের ছোটার শুরু সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। রোববার শুরু দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্ট। খেলা শুরু সকাল ১০টায়।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন শেষে পরিচিত এক সংবাদকর্মীকে দেখে আরভাইনের উৎসুক জিজ্ঞাসা, ‘সিলেটের উইকেট-কন্ডিশন কেমন?’ উত্তর পেয়ে জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক সন্তুষ্ট হলেন কি না, বোঝা গেল না। যদিও সংবাদ সম্মেলনে তিনি নিজেই বলে গেছেন, পেস সহায়ক হতে পারে প্রথম ম্যাচের উইকেট।
ভালো উইকেটে খেলার আশায় সাম্প্রতিক সময়ে তিন সংস্করণেই সিলেটে বেশি ম্যাচ দিচ্ছে বিসিবি। দলের প্রধান কোচ ফিল সিমন্সও বার্তা দিয়েছেন, টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির সোপানে পা রাখতে স্পিন বা পেস নির্ভর না হয়ে ‘প্রপার’ উইকেটেই খেলতে চান তারা।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে শান্তও বলেছেন, দেশের ক্রিকেটে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই সিরিজ দিয়েই নতুন কিছু করে দেখাবেন তারা।
ঘরের মাঠে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে অবশ্য খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। গত বছর শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লড়াই করতেই পারেনি তারা। সব মিলিয়ে দেশে সবশেষ ১৬ ম্যাচে জয় মাত্র ৩টি। অথচ দেশের বাইরে ২০২৪ সালে তিন ম্যাচ জিতেছে তারা।
ঘুরে দাঁড়ানোর অভিযানে আপাতত সহজ প্রতিপক্ষকেই পেয়েছে বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সবশেষ আট ম্যাচে তারা হেরেছে মাত্র ১টি। গত ৪ বছরে কোনো দলের বিপক্ষেই টেস্ট জিততে পারেনি জিম্বাবুয়ে।
শঙ্কার জায়গাও অবশ্য থাকছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের সবশেষ জয়টি সিলেটের মাঠেই। ২০১৮ সালে এই মাঠের অভিষেক উৎসব পণ্ড করে ১৫১ রানে জিতেছিল সফরকারীরা।
সাম্প্রতিক ফর্ম অবশ্য এখন আরভাইনদের পক্ষে নয়। তাই তাদের বিপক্ষে জিতলেও তেমন কৃতিত্ব হয়তো পাবেন না শান্তরা। তবে হেরে গেলে নিশ্চিতভাবেই দাঁড়াতে হবে কাঠগড়ায়।
তবে শান্ত অবশ্য এটিকে চাপ ভাবতে চান না। বড় যে কোনো দলের বিপক্ষে যে মানসিকতায় খেলা শুরু করেন, একইভাবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও খেলার লক্ষ্য বাংলাদেশ অধিনায়কের।
“আমরা এভাবে দেখছি না। এই জিনিসগুলা অনেক সময় আপনাদের থেকে আসে। অনেক সময় সাধারণ মানুষ আসলে এই তুলনা করে যে জিম্বাবুয়ে বা অন্য ছোট দল বা বড় দল- এগুলো।”
“পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে আমরা আসলে বল বাই বল চিন্তা করি যে, কীভাবে ওই বলটার সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারি। আমরা কীভাবে সেরা খেলাটা খেলতে পারি, তা গুরুত্বপূর্ণ। জিম্বাবয়ের সঙ্গে যেভাবে খেলব সেই মন-মানসিকতা, শরীরী ভাষা, চিন্তাভাবনা যেন দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের সঙ্গেও থাকে। এই জায়গাটায় যেন পার্থক্য তৈরি না হয়।”
দুই দলের সার্বিক মুখোমুখি পরিসংখ্যানে অবশ্য অনুপ্রেরণা পেতে পারে জিম্বাবুয়ে। এখন পর্যন্ত ১৮ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৮টি। বাংলাদেশের বিপক্ষে এক সময় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা জিম্বাবুয়ে জিতেছে ৭ ম্যাচে।
সময়ে পরিক্রমায় সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাটা পড়েছে অনেকটাই। এখন আর আগের মতো জমে না দুই দলের সিরিজ। তবে নিজেদের সামর্থ্যের সেরা ক্রিকেটে খেলে পুরোনো দিনের লড়াই ফিরিয়ে আনার আশা জিম্বাবুয়ে অধিনায়কের।
“আমরা খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। এমন কোনো জায়গা নেই যেগুলো নিয়ে আমরা কাজ করিনি। এখন শুধু মাঠে গিয়ে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার পালা এবং নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখা যে প্রস্তুতির শতভাগ আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব।”
“দুই দলের মধ্যে সবসময়ই অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। এবার বাংলাদেশের মাঠে খেলা হওয়ায় জিম্বাবুয়ের জন্য কাজটা কিছুটা কঠিন। তবে আমাদের সবসময়ই মনে হয় যে, সুযোগ আছে। এখন আমাদের যে ধরনের ক্রিকেটার আছে, নিশ্চিতভাবেই তাদের (বাংলাদেশ) জন্য হুমকি হতে পারে।”
হুমকি সামাল দিতে বাংলাদেশ দলেও সামর্থ্যবান ক্রিকেটারের কমতি নেই। গত বছরে ঘরের মাঠে নাজুক পারফরম্যান্স ও সামনের দিনগুলোর জন্য আত্মবিশ্বাসের রসদ নেওয়ার আশায় পূর্ণ শক্তির দল নিয়েই সিরিজটি খেলতে নামছে বাংলাদেশ।
তাই ম্যাচের একাদশ সাজানোর সময় হয়তো কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে অধিনায়ক, কোচ ও টিম ম্যানেজমেন্ট। ম্যাচের আগের দিন দুপুরে তাই নিজেদের একাদশ, এমনকি সমন্বয় নিয়েও কোনো ধারণা দিতে চাননি শান্ত।
তবে সবশেষ টেস্টের একাদশে একাধিক পরিবর্তন অধারিতই। চোট কাটিয়ে দলে ফিরছেন অধিনায়ক শান্ত ও অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। ওপেনিংয়ে সাদমান ইসলামের সঙ্গে দেখা যেতে পারে জাকির হাসান বা মাহমুদুল হাসান জয়কে। এরপর থাকবেন অভিজ্ঞ মুমিনুল হক।
উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে মাহিদুল ইসলামের চেয়ে জাকের আলির পক্ষেই যাওয়ার কথা বাংলাদেশের। একমাত্র অলরাউন্ডার হিসেবে থাকবেন মেহেদী হাসান মিরাজ। স্পিন বিভাগের আরেক ভরসা তাইজুল ইসলাম।
পেস বিভাগে হাসান মাহমুদ ও সৈয়দ খালেদ আহমেদের সঙ্গে বাড়তি গতি দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ হতে পারেন নাহিদ রানা। শুক্রবারের অনুশীলনের পর জিম্বাবুয়ের শন উইলিয়ামস অবশ্য বলেছেন, বিশ্ব ক্রিকেটে এখন অনেকেই নাহিদের মতো জোরে বোলিং করেন। তাই মানিয়ে নিতে সমস্যা হবে না জিম্বাবুয়ের।
উইলিয়ামসের এমন মন্তব্য ভালোভাবে নেননি শান্ত। তরুণ গতিতারকাকে নিয়ে একরকম হুমকিই দিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
“এটা কালকে ম্যাচে নাহিদ যখন বল করবে ও প্রতিপক্ষ যখন ব্যাট করবে, তখন আপনি তাদের শরীরী ভাষা দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, নাহিদ রানা কত জোরে বল করে এবং সে কতটা অসাধারণ।”
বাংলাদেশকেও অবশ্য সামলাতে হবে জিম্বাবুয়ের পেস আক্রমণের চ্যালেঞ্জ। সফরকারীদের একমাত্র বিশ্বমানের পেসার ব্লেসিং মুজারাবানির সঙ্গে আছেন আরেক দীর্ঘদেহী বাঁহাতি পেসার রিচার্ড এনগারাভা। নতুন বলে বাংলাদেশের ছন্দহীন ওপেনারদের কঠিন পরীক্ষাই হয়তো নেবেন তারা।
ওপেনারদের মতো ব্যাটিং অর্ডারের বাকিদেরও সামলাতে হবে বড় দায়িত্ব। প্রতিটি বিভাগে ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারলেই মিলবে ইতিবাচক ফল। আর দেশের ক্রিকেটে টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তোলার বড় লক্ষ্য পূরণে জয় দিয়ে যাত্রা শুরুই হতে পারে বড় প্রেরণা।