চটকদার শিরোনাম, বিতর্কিত বিষয়, মূল বিষয়ের বাইরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ‘সসি’ বিষয়কে প্রধান আকর্ষণীয় করে পরিবেশনই এখন সংবাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে— যা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
Published : 03 May 2024, 12:40 PM
গণমাধ্যম কি এখন ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত? এই প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের জনপরিসরে বেশ সক্রিয়। কেননা, যেকোনো সংবাদকে এখন ভাইরাল করাই যেন গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মূল কারণ গণমাধ্যমকে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে।
বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশ— যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুশিক্ষিত মানুষের হার খুব বেশি না হলেও অধিকাংশ মানুষের হাতেই এখন স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট এবং তাদের প্রায় সকলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষ করে ফেইসবুক ব্যবহারকারী।
স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে এবং আর্থিক লাভের সম্ভাবনা মাথায় রেখে এখন প্রচুর কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৈরি হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরাও ইউটিউব চ্যানেল খুলে নানারকম কনটেন্ট বানাচ্ছেন এবং অনেকেই টাকা উপার্জন করছেন।
ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এখন অনস্বীকার্য বাস্তবতা। কিন্তু গণমাধ্যমের যেমন গেটকিপার আছেন, সম্পাদকীয় নীতিমালা আছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা না থাকায় একজন ব্যবহারকারী যা খুশি লিখতে পারেন। যেকোনো কনটেন্ট তিনি সত্যাসত্য বিচার না করেই আপ করে দিতে পারেন। কিন্তু মুশকিল হলো, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমও এখন অনেক সময় যাচাই-বাছাই না করে তথ্য পরিবেশন করছে এবং পরে দেখা যাচ্ছে সেটি অর্ধ সত্য অথবা ভুল।
অনেক গণমাধ্যম তাদের ডিজিটাল প্লাটফর্মে এমন সব কনটেন্ট ও শিরোনাম দিচ্ছে যা সাংবাদিকতার নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদিও এইসব কনটেন্টই বেশি ‘খাচ্ছে’। খাচ্ছে মানে ভাইরাল হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এইসব কনটেন্ট ও চটকদার শিরোনামওয়ালা খবরের ভেতরে ঢুকে পাঠক হতাশ, বিভ্রান্ত ও বিরক্ত হয় এবং গালি দেয়। সংবাদের নিচে নানারকম নেতিবাচক মন্তব্য লেখে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, অনেক পাঠক এখন এই ধরনের শিরোনাম দেখলে সংবাদের ভেতরে না গিয়ে আগে কমেন্ট পড়ে। কেউ কেউ এমনও লেখে যে, ‘সংবাদ নয় কমেন্ট পড়তে এসেছি।’ এই ধরনের ঘটনা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতায় বড় ধরনের ধাক্কা দেয়।
সম্প্রতি নারী আম্পায়ারের অধীনে খেলতে না চাওয়ার বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় দলের একাধিক ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলেও পরে জানা যায় সেটি ভুল। এটি হয়েছে মূলত ভাইরাল জ্বরের কারণে। চটকদার শিরোনাম, বিতর্কিত বিষয়, মূল বিষয়ের বাইরে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ‘সসি’ বিষয়কে প্রধান করে আকর্ষণীয় করে পরিবেশনই এখন সংবাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে— যা গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী যেকোনো কথাকে ‘তথ্য’ হিসেবে ছড়িয়ে দিতে পারেন, যেটি পরে হয়তো যেটি অপতথ্য বা গুজব হিসেবেও প্রমাণিত হতে পারে। মুশকিল হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনোকিছু ছড়িয়ে গেলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সেটি বিশ্বাস করে। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীরা কোনো কিছু শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি যাচাই-বাছাই ছাড়া দিতে পারেন না। না পারলে তখন মানুষের মনে ধারণা তৈরি হয়, গণমাধ্যম বুঝি তথ্যটি গোপন করছে।
এমনিতেই নানাবিধ আইনি কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিত ভয়-ভীতির মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করতে হয়। এমতাবস্থায় অনেক সংবাদই এখন গণমাধ্যমে আসার আগেই মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জেনে যায় এবং তাতে করে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও কমছে।
ডিজিটাল মাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় মুদ্রিত সংবাদপত্রের পাঠক এবং টেলিভিশনের দর্শক কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মানুষ এখন হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে চায়। মোবাইল ফোনেই সে সব খবর ও বিনোদন চায়। যে কারণে পত্রিকা ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন কমে গেছে বিপুল হারে। বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে গণমাধ্যমের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু ভালো ও রুচিশীল কনটেন্ট ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে খুব বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে না। বরং বিতর্কিত, চটকদার শিরোনাম, প্রোপাগান্ডা, অর্ধসত্য সংবাদ ও কনটেন্ট খুব দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে এবং যে কনটেন্ট যত বেশি ভাইরাল হচ্ছে, সেই কনটেন্ট দিয়ে তত বেশি টাকা উপার্জন করা সহজ হচ্ছে। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মূলধারার অনেক টেলিভিশন চ্যানেলও। তারাও এখন স্রোতে গা ভাসিয়ে এমন সব কনটেন্ট তৈরি করছে, যা তাদের আয় বাড়াচ্ছে, কিন্তু গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমাচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে চাপ মোকাবেলা করে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতা করা এবং অন্যদিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহের কারণে ভাইরাল কনটেন্ট বানাতে গিয়ে আস্থা হারানো— এই দুই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন সত্যিই একটা সংকটকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, এমন কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি সে আগে কখনো হয়নি। এটি তার অস্তিত্বের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। তারওপর আছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের নানাবিধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব। গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের সেই স্বার্থও রক্ষা করে চলতে হয়। প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকেরই একাধিক ব্যবসা আছে। অতএব ওইসব ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাদেরকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে হয়। অতএব গণমাধ্যম চাইলেই সব বিষয়ে খুব খোলামেলা বা অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা করতে পারে না। কারণ যে মালিকের যে ধরনের ব্যবসা, ওই ধরনের ব্যবসাসম্পর্কিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তার প্রতিদ্বন্দ্বী গণমাধ্যমগুলোকেও একইভাবে পাল্টা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে উৎসাহ জোগায়। অতএব দিনশেষে এগুলো হয়ে ওঠে করপোরেট প্রতিষ্ঠানের লড়াই— যেখানে নির্মোহ সাংবাদিকতার চেয়ে করপোরেট স্বার্থই প্রধান বিবেচ্য।
এরকম বাস্তবতায় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে সেটি হলো, তাহলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ভবিষ্যৎ কী? কী করে টিকে থাকবে? এরকম পরিস্থিতিতে কী করে জনআস্থা ও ব্যবসা ধরে রাখবে?
মানুষ এখন দ্রুত এবং সংক্ষেপে অনেক কিছু জানতে চায়। ছবি ও ভিডিও চায়। যে কারণে শর্ট ভিডিওর চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। যে কারণে গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের এখন প্রতিনিয়তই টেলিভিশনের কনটেন্ট নিয়ে ভাবতে হচ্ছে যে, এই ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যুগে তাহলে কি সংবাদের ভাষা ও বিশ্লেষণেও পরিবর্তন আনতে হবে? গণমাধ্যমের নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে কি আপোস করতে হবে? মানুষ যা চায়, ওই ধরনের কনটেন্ট দিতে হবে? মানুষ বলতে এখানে কোন শ্রেণির দর্শককে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিবেচনায় নেবে? টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কি তাহলে ইউটিউব ও ফেইসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কনটেন্ট বানাবে? সেটি কি গণমাধ্যমের কাজ? আবার যদি সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র বা অনলাইন পোর্টালগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যায়, তাহলে সে আর্থিক সংকটে পড়বে কিনা? উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম তার দর্শন, নীতিনৈতিকতা ও আদর্শিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে কিনা— ওই প্রশ্নও এখন বেশ জোরেশোরে সামনে আসছে। এতসব সীমাবদ্ধতা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি অর্থনীতির দেশে স্বাধীন, নির্মোহ, বস্তুনিষ্ঠ এবং দেশ ও জনস্বার্থমুখী সাংবাদিকতা বিরাট চ্যালেঞ্জ। অনেকটা স্বপ্নের মতো।
অতএব এরকম একটি বিরুদ্ধস্রোতে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কী করে টিকে থাকবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন এবং এই টিকে থাকার মন্ত্র আবিষ্কার করাই এখন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রধান কাজ। সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে গণমাধ্যমের এমন একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ও আদর্শ থেকেও বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এরকম বাস্তবতায় গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গণমাধ্যম টিকবে কিনা বা টিকলেও কোন ফরম্যাটে থাকবে; তার অনুষ্ঠান ভাবনা ও ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হবে কিনা; সংবাদের ভাষা বদলাতে হবে কিনা; সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ যে ধরনের ও যে আকারের কনটেন্ট দেখে অভ্যস্ত, গণমাধ্যমও তার সংবাদ ও বিশ্লেষণ ওইভাবে তৈরি করবে কিনা; যদি তাই করে তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে গণমাধ্যমের পার্থক্য থাকবে কোথায়— এসব প্রশ্ন সামনে আসছে। তার মানে গণমাধ্যমকে একটা নতুন মডেল তৈরি করতে হবে কিনা; প্রচলিত এবং বহু বছর ধরে চলে আসা তার মডেল এখন অচল কিনা, ওই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আবার নতুন মডেল তৈরি করতে হলে সেটি কেমন হবে? সেটি কি সোশ্যাল মিডিয়া তথা ডিজিটাল প্লাটফর্ম মাথায় রেখে বানাতে হবে? এই বিষয়গুলো নিয়ে অনেক বেশি কথা বলা এবং একাডেমিক পরিসরে তো বটেই, গণমাধ্যমকর্মীদের নিজেদের মধ্যেই আলাপ-আলোচনা জোরদার করা দরকার।
পরিশেষে এটিও মনে রাখতে হবে যে, স্রোতে গা ভাসানো যেমন গণমাধ্যমের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থি, তেমনি তাকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে, জনআস্থা অর্জন করে চলতে হবে এবং একইসঙ্গে ব্যবসাও ধরে রাখতে হবে। ফলে লড়াইটা খুব কঠিন। এই লড়াইয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে বরং সঙ্গী করে গণমাধ্যম কী করে নিজের নীতি-আদর্শ ও বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রেখে টিকে থাকতে পারে, ওই কৌশল বের করাই এখন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রধান এজেন্ডা হওয়া উচিত।