জার্মানিতে ৪০ বছর: ঘুরে ঘুরে ভাষা জানা

জার্মানিতে আমরা এসেছিলাম ১৪ অক্টোবর ১৯৭৭ সালে। তারপর অল্প কয়েকদিনেই আমাদের সম্পূর্ণ নতুন নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা জমা হতে থাকল।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Feb 2017, 06:31 AM
Updated : 19 Feb 2017, 06:31 AM

প্রথম দিকে ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা আমাদের কাছে খুব ঠাণ্ডা লাগতো। আবার আমাদের কাছে এই শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তেমন পোশাক ছিল না। যদিও তখন একেবারেই প্রয়োজন ছাড়া তেমন কোথায়ও বের হতাম না। আর বের হবই বা কোথায়? না চিনি রাস্তা, না জানি ভাষা। তাই শীতের কষ্ট তখনও আমাদের পাকরাও করতে পারেনি।

খুব ভাল করেই মনে আছে ১৯৭৭ সালের ১৯ অক্টোবরে ফ্রাঙ্কফুর্টের আবহাওয়া বেশ আরামপ্রদ মনে হলো। কারণ ওই দিনটিতে ওখানকার তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। তাই ভাবলাম আজকের দিনটা একটু বেরবো।

এর মধ্যে চলে আসলো গেণ্ডারিয়া অঞ্চলের আমাদের এক বন্ধুর ছোট ভাই খালিদ। ও আমাদের দেখে খুশিই হলো। খুশি হওয়ারই কথা, কারণ এই বিদেশে পরিচিত একজন মানে অনেককিছু। তার মধ্যে আবার আমরা এক সাথে তিনজন।

দুপুরে খাবার পর (তখন আমরা ফরহাদ আর নিজামের খাবার তৈরির সময় টুকিটাকি কাজ করার চেষ্টা করতে শুরু করেছি, কারণ ক'দিনই বা বসে বসে খাওয়া যায়?) খালিদকে নিয়ে বের হলাম।

ওইদিন আর ১০ টাকার ওভারকোট পরতে হয়নি। তার পরিবর্তে গায়ে চাপালাম ঢাকা থেকে নিয়ে আসা পরিচিত দর্জি দিয়ে তৈরি একটি ব্লেজার। রওনা দেওয়ার বছর খানেক আগে সেলিম আর আমি একই কাপড় দিয়ে দু'টো ব্লেজার বানিয়েছিলাম। তখন ঢাকায় ওই ধরনের ব্লেজার ছিল আধুনিক।

মনে পড়ে, ব্লেজারকে আরও আধুনিক করার জন্য গুলিস্তানের পুরনো বোতামের দোকান থেকে বড় বড় সাইজের চকচকে বোতামও কিনেছিলাম। আর ওই সময় ঢাকায় ছিল বেল বটম প্যান্টের যুগ। আমার শেষের প্যান্টটি ছিল পায়ের নিচের দিকে চওড়ায় ২৮ ইঞ্চি।

আসার পরেই লক্ষ করলাম, আমাদের এই ধরনের ডিজাইনের প্যান্ট এখানে অচল। বাকি যে দু'টো প্যান্ট নিয়ে এসেছিলাম, সেই প্যান্টগুলো দেশে ব্যবহার ছেড়ে দিলেও এখানে হয়ে উঠল আমার সম্বল।

রাস্তায় বেরিয়ে দু'দিক দেখছি, দেখছি চলার পথে বাড়ি-ঘর। লক্ষ করলাম বাড়ির ছাদগুলো আমাদের দেশের বাসা-বাড়ির মত সমান না, দু'দিক থেকেই ঢালু। আর হবেই বা না কেন? এটা তো তুষার আর জমে থাকা বরফের দেশ, তাই ছাদগুলোকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে। যেন তাপমাত্রা বাড়লে জল গড়িয়ে নিচে নেমে যেতে পারে।

সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়াতে এই প্রথম সবকিছু নতুন করে ঝকঝকে মনে হলো। ভাবছিলাম, কত জেনারেশনের শ্রমের বিনিময়ে জার্মানরা আজকের এই অবস্থায় এসেছে। এরপরও তো দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ তাদের উপর দিয়ে গেছে।

আমরা বাসা থেকে বেরোলাম, এবার পিচ্চি খালেদ হচ্ছে আমাদের গাইড। খালিদের বয়স তখন মনে হয় ১৮, সে ওই বয়সেই জার্মানিতে চলে গিয়েছিল। ও ছিল স্মার্ট ছেলে, বাল্যকালে ঢাকার একটি বাংলা চলচিত্রে শিশু চরিত্রে অভিনয়ও করেছিল।

খালিদ সামনে আর আমরা তিনজন পেছনে। আমরা হাঁটা পথেই এগোলাম। আবার সেই 'বাহনহফের' কাছাকাছি প্রায় বিপরীতের একটি রাস্তায় খালিদ আমাদের নিয়ে গেল। দু'দিন আমরা যে 'কাইজার স্ট্রিট' দিয়ে আমাদের 'টাউনুস ট্রিট'-এর ঘরে গিয়েছি, এই রাস্তা হলো তার আগের ট্রাম চলাচলের রাস্তা 'মুন্সেনার স্ট্রিট'।

আমরা খালিদের নেতৃত্বে ট্রাম লাইন ধরে এগোতে লাগলাম। মিনিট দশেক পর খালিদ একটি বিশাল উঁচু দালানের সামনে এসে বলল, "এটা হচ্ছে ৱথিয়েটার প্লাজ', যেখানে থিয়েটার হয়।"

এবার জার্মান শব্দ 'প্লাজ' মানে যে 'স্থান' বা ইংরেজিতে 'প্লেস'- সেটা শিখলাম। আমরা আরও দশ মিনিট হেঁটে ফ্রাঙ্কফুর্টের কেন্দ্রস্থল 'জেইল'  (Zeil)-এর কাছাকাছি পৌঁছালাম। তখন অবশ্য জানা ছিল না, আমরা প্রখ্যাত জার্মান কবি-লেখক-দার্শনিক ভলফগাং গোয়েথের বাড়ির (জন্ম ২৮ আগস্ট ১৭৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টে, মৃত্যু ২২ মার্চ ১৮৩২ সালে) খুব কাছ দিয়েই গিয়েছিলাম।

একটু সামনে এগিয়েই চোখে পড়লো পুরাতন একটি চার্চ,যার নাম 'পাউল কিরসে'। এবার শিখলাম যে জার্মান ভাষায় চার্চকে 'কিরসে' বলে। এই চার্চকে দেখেই মনে হয়েছিল যে এটা একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। পরে জেনেছি, এই গির্জাটি মধ্যযুগের। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৪ সালে এই গির্জাটি মিত্র বাহিনীর বোমা বর্ষণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধ শেষে এটাকে আবার নির্মাণ করা হয়। বলতে গেলে, এই গির্জা হলো আমার জার্মানিতে প্রথম কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখা।

ওই সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট 'ছায়েলের' উপর দিয়ে ট্রাম চলাচল করত, এখনকার মত এত দোকান-পাট আর সাজসজ্জা ছিল না। তবে 'কাউফহফ' (Kaufhof) নামে বড় দোকানটি ছিল। চোখে পড়ল সেই স্টোরের সামনে সবুজ জ্যাকেট পরিহিত একজন ইন্ডিয়ান, মানে আমাদের অঞ্চলের লোক। তার সামনে একটি টানা ট্রলি, যেখানে উপরের দিকে বড় প্লাস্টিকের ক্লিপ দিয়ে একটি পত্রিকা ঝুলিয়ে রেখেছে। এর অর্থ হলো, সে ফ্রাঙ্কফুর্টের একটি দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করছে।

পত্রিকার নাম তখন ঠিক মত উচ্চারণ করতে পারি নাই, তবে এই সেই 'Frankfurter Rundschaw' যার সাথে ওই সময়ের বহু বাঙালী, পাকিস্থানি আর ইন্ডিয়ানের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সামনের দিকে হাঁটতে গিয়ে এরকম আরও কয়েকজন পত্রিকা বিক্রেতাদের চোখে পড়ল। এদের মধ্যে খালেদের পরিচিত একজন বাঙালীকেও পাওয়া গেল। আমরা তার সাথে পরিচিত হলাম।

আলাপের মধ্যেই সেখানে আমাদের সাথে দেখা হলো দু'জন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর সাথে। মনে হলো, ছুটির এই দিনে সুন্দর আবহাওয়ার কারণে তারা বেড়াতে বেড়িয়েছেন। এরাও আমাদের সাথে কথায় যোগ দিলেন, কুশল-বার্তা বিনিময় হলো। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কতোদিন ধরে আমরা জার্মানিতে আছি?

উত্তরে আমরা বললাম, এই তো এই মাসের ১৪ তারিখ থেকে এখানে আছি।

এবার আমরা জানতে চাইলাম, তারা কতোদিন যাবত জার্মানিতে আছেন?

উত্তরে তারা জানালেন, ১৩ বছর ধরে আছেন।

জানি না এই উত্তর শুনে আমাদের কার কী মনে হয়েছিল, তবে আমি ভীষণ অবাক হয়েছিলাম! তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জিজ্ঞেস করলাম, এত দিন ধরে আছেন কীভাবে?

তারা জানালেন, এই তো কেটে যাচ্ছে দিন। জানালেন যে তাদের কাছে বিগত ১৩ বছর খুব দীর্ঘ মনে হয় না।

এখন সেদিন তাদের ১৩ বছরের কথা শুনে আমার অবাক হওয়ার কথা ভাবলে মনে হয়, সেই আমি এখন ১৩ বছরের তিনগুণ সময় ইতোমধ্যে এখানে পার করে দিয়েছি। এটাই বাস্তব, জীবনে সামনের দিনগুলো একটু লম্বা মনে হলেও ফেলে আসা দিনগুলো মনে হয়- এই তো সেদিনের ঘটনা।

সন্ধ্যার আগে আগেই আবার আমরা আমাদের আস্তানায় ফিরে আসলাম। রাতে বন্ধুদের সাথে কিছু সময় আড্ডা ও খাওয়া হলো। তারপর সেলিম আর রশিদ আমাদের ভাড়া নেওয়া 'টাউনুস স্ট্রিট'-এর ঘরের দিকে চলে গেল। আর আমি স্লোসেন স্ট্রিটের ৪ নাম্বারে থেকে গেলাম। এরপর থেকে আমাকে রাত কাটানোর জন্য আর ওই এলাকায় যেতে হয়নি।


চলবে ...

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!