এ বাড়িটি নিয়ে খোদ আমেরিকানদের মধ্যেও কৌতূহলের শেষ নেই।
Published : 24 Apr 2024, 11:54 AM
দিনটা ছিল শুক্রবার। হোয়াইট হাউসের সামনে একদল প্রবাসীকে দেখতে পেয়েই বেজে উঠলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। মূল গেটের সামনে ক্যাসেটে গানটি শোনার সঙ্গে সবাই থমকে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণের জন্য। নিজেরাও গাইলেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সেখানে লাল-সবুজের পতাকা দৃশ্যমান না হলেও প্রতিটি বাঙালির হৃদয়পটে ভেসে উঠেছিল তা।
নানা কারণে বিশ্বের কাছে ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত এ হোয়াইট হাউসের অধিকর্তা। এমন একটি ভবনের ভেতরে থেকে কীভাবে এতসব সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, কোথায় বসে সিদ্ধান্ত নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট! মাঝে মধ্যে অতিথি আপ্যায়নের ঘটনাও কোন টেবিলে ঘটে, কোথায় ঘুমান প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট লেডি, কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় গোটা বিশ্বের পরিস্থিতি! এসব নিয়ে খোদ আমেরিকানদের মধ্যেও কৌতূহলের শেষ নেই।
কারণ, ইচ্ছা করলেই এই হাউসের ভেতর প্রবেশাধিকার মেলে না। এই ভবনের বাসিন্দা ছাড়া সবাইকেই সিকিউরিটি পয়েন্ট অতিক্রম করতে হয়। পটভূমি পরীক্ষা করা হয় পরিদর্শনে আগ্রহীদের। তারপর অন্তত তিনটি চেক পয়েন্ট পাড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়।
প্রতিটি চলার পথ, কক্ষ, ডাইনিং রুম, সিনেমা হল, গসিপ রুম, ব্রিফিং রুম সবখানে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ, কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। নিরাপত্তা প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে ভিডিও করা সম্ভব হয় না। তবে আইফোনের সুবাদে ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠবে না এমন শর্তে সবকিছুর ছবি সংগ্রহ করার অনুমতি দেওয়া হয় দর্শনার্থী অথবা ভ্রমণকারীকে।
ভবনটি তন্ন তন্ন করে দেখার আগ পর্যন্ত থাকা কৌতূহল একেবারেই চুপসে যায় ৩০/৪০ মিনিট পরিভ্রমণের পর। কারণ, সবকিছুই স্বাভাবিক। বিছানা, ডাইনিং টেবিল, অতিথি কক্ষ, ব্রিফিং রুম- সবকিছু একই রকম, চিরচেনা। মিটিং রুমেও কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই।
হোয়াইট হাউস পরিভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল ১৯ এপ্রিল। ৩৮ জনের একটি টিমে সবাই ছিলাম বাংলাদেশি-আমেরিকান। নেতৃত্ব দেন ডেমোক্র্যাট আনিস আহমেদ। তিনি মাঝে মধ্যেই প্রবাসীদের জন্য এমন আয়োজনে নেতৃত্ব দেন, চলতি পথে সবাইকে নিজ ভাষায় জানিয়ে দেন কক্ষগুলোর ইতিহাস-ঐতিহ্য। অর্থাৎ গাইডের ভূমিকা নেন তিনি। কোথায় দাঁড়িয়ে ছবি উঠানো সম্ভব, সেটিও তারই ইশারায় ঘটেছে।
ধীরে চলার অবকাশ নেই, কোথাও অকারণে সময়ক্ষেপণেরও সুযোগ নেই। সক্রিয় থাকতে হয় সারাক্ষণ। কারণ, সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। উচ্চস্বরে, এমনকি ফোনে কথা বলা মানা। তবে বোবা হয়ে চলতে হয়। প্রয়োজনে চেনা-জানারা স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলতে পারেন। পরিভ্রমণ শেষে অনেকেরই একই উচ্চারণ ‘দিল্লিকা লাড্ডু’। তারপরও ভবনটি নিয়ে জানার কৌতূহল থেমে থাকে না।
হোয়াইট হাউস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক বাসভবন। ওয়াশিংটন ডি.সির ১৬০০ পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত এ বাসভবনটি ১৭৯২ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। জন অ্যাডামসের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টই এ বাসভবনে ছিলেন।
এ ভবনের স্থপতি ছিলেন জেমস হোবান, তিনি আয়ারল্যান্ডের নাগরিক। পুরো ভবনটি মূলত তিনটি আলাদা ভাগে বিভক্ত- ওয়েস্ট উইং, ইস্ট উইং ও এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স। ভবনের মোট আয়তন প্রায় ৫৫ হাজার বর্গফুট।
চারতলা এ ভবনে রয়েছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর। তার মধ্যে অন্যতম হলো প্রেসিডেন্টস রুম, ওভাল অফিস ও ক্যাবিনেট রুম। আগে প্রেসিডেন্টস রুমে সেক্রেটারি দপ্তর ও প্রেসিডেন্টের দপ্তর ছিল। বর্তমানে এই কক্ষ ডাইনিং রুম বা খাবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ওভাল অফিসটি বর্তমানে প্রেসিডেন্টের প্রধান দপ্তর। ডিম্বাকৃতির এই কক্ষের জানালাগুলো বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে তৈরি। কক্ষটির অন্দরসজ্জা ও আসবাব প্রেসিডেন্টের পছন্দ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়।
ক্যাবিনেট রুমে প্রেসিডেন্ট তার মন্ত্রীসভার সঙ্গে বৈঠক করেন। হোয়াইট হাউসের রীতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সব সময় টেবিলের মাঝখানে বসেন। গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে সিচুয়েশন রুম। ৫ হাজার বর্গফুটের এই ঘরে প্রেসিডেন্ট আসেন সমস্যার মুখোমুখি হলে। এখানে তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন। সিচুয়েশন রুম চালান ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্মীরা। তারপর হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিং রুম, এখান থেকে সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলেন প্রেসিডেন্ট।
হোয়াইট হাউস চত্বরের কেন্দ্রীয় ভবন হলো এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স। এটি মূলত ওয়েস্ট ও ইস্ট উইংয়ের মাঝখানে অবস্থিত। এই ভবনে আছে সবুজ, নীল ও লাল কক্ষ। এসব কক্ষের জানালার পর্দা, মেঝের কার্পেটসহ গৃহসজ্জার সামগ্রীর রং কক্ষের নাম অনুসারে হয়ে থাকে। এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্সের পূর্বদিকে দ্বিতল ভবনটি হলো ইস্ট উইং।
ভবনের দ্বিতীয় তলায় আছে ফার্স্ট লেডির দপ্তর। এছাড়া এই ভবনে আছে একটি পারিবারিক থিয়েটার হল, যেখানে প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যরা দিনের যেকোনো সময় নিজেদের পছন্দের সিনেমা উপভোগ করতে পারেন। এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্সের ফার্স্ট ফ্লোরে আছে ক্রস হল। এটি হোয়াইট হাউসের সবচেয়ে প্রশস্ত হলওয়ে। ক্রস হল স্টেট ডাইনিং রুম ও ইস্ট রুমের সঙ্গে এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্সের সংযোগ স্থাপন করেছে।
অনেকেই হয়ত ভাবেন বাড়িটার নাম হোয়াইট হাউস কেন? কারণ, ১৮১২ সালে সংঘটিত হয় ইংল্যান্ড-আমেরিকা যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালে ১৮১৪ সালের ২৪ অগাস্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হোয়াইট হাউস জ্বালিয়ে দেয়। তারপর বিল্ডিংয়ের ছোট একটি অংশ শুধু অবশিষ্ট ছিল। বিল্ডিংটির বিভিন্ন জায়গায় তখন আগুন ও ধোঁয়ার দাগ ঢাকতে এর দেয়ালে সাদা রং দেওয়া হয়। সেই থেকে মূলত একে ‘হোয়াইট হাউস’ বলা শুরু হয়। হোয়াইট হাউসের মোট রুমের সংখ্যা ১৩২।
এই ভ্রমণে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের এই দলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক লাবলু আনসার, বিশ্ববাংলা টোয়েন্টিফোর টিভির চেয়ারপার্সন আলিম খান আকাশ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নুরুন্নাহার নিশা খান, আলভি খান, স্নেহা খান, আলিসা খান, সাফিন চৌধুরী, আসমা চৌধুরী, শামীন চৌধুরী, সারাহ চৌধুরী, ওমর চৌধুরী, হাসিনা পারভিন, তাসমিয়া দিয়া, সাফকাত চৌধুরী, নাফিজা আহমেদ, সুজাত হোসেন, লোকমান খান, শাহানা সুলতানা, তারেক মেহেদী, নাবিল আহমেদ, সাঈদ হারুন, রফিকুল আলম, ফরিদা পারভিন, কাজী ইসলাম, জাকির চৌধরী, মাহমুদা ইসলাম, সৈয়দ জুনায়েদ, কারাবি চৌধরী, মিজানুর রহমান, রাহেলা সুইটি, নূরজাহান খাতুন, নাসিমা আহমেদ ও মোহাম্মদ খান।