প্রতিটি ‘হ্যাঁ-না’ বা গণভোটের ফলাফলই নিরঙ্কুশভাবে সরকারের পক্ষে গেছে। সরকার যে ফলাফল চেয়েছে, গণভোটের ফলাফলে তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
Published : 06 Apr 2025, 07:38 PM
সংবিধান সংশোধন-সংস্কার, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সম্প্রতি অনেকে গণভোটের দাবি সামনে আনছেন। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এই দাবিতে সরব। এমনকি গত জানুয়ারিতে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেখানেও সংবিধানের যে কোনো সংশোধনীতে সংসদের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের (বর্তমানে সংসদ যদিও এক কক্ষবিশিষ্ট) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন এবং প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে গণভোটে উপস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানেও তারা গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। প্রশ্ন হলো, গণভোট কখন হয়, কেন হয় এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী গণভোটের সুযোগ আছে কিনা? বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কতগুলো গণভোট হয়েছে এবং সেগুলোর অভিজ্ঞতা কেমন?
গণভোট কী?
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে মতামত গ্রহণের পদ্ধতিই হলো গণভোট। এর মাধ্যমে জনগণের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চূড়ান্তভাবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের জন্য উপস্থাপিত হয়। সুইজারল্যান্ডে ১৭৭৮ সালে প্রথম গণভোট চালু হয়। বিভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। যেমন সংবিধান সংশোধন, গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ইত্যাদি। সংবিধান সংশোধনের জন্য অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালিসহ বেশকিছু দেশে গণভোট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় গণভোটকে ‘একটা বিচিত্র ধরনের নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী আত্মজীবনীতে লিখেছেন: “এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুটি কালো বাক্সের মধ্যে। একটি কালো বাক্সে ‘হ্যাঁ’ লেখা। আরেকটিতে ‘না’। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুই বাক্সের মধ্যে। এই ‘হ্যাঁ’-‘না’ ভোটের নির্বাচনের গোড়াপত্তনকারী পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইউব খান। সরকারি কর্মচারীরাই এই ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকেন। তাই ক্ষমতাসীনের বিরুদ্ধে ‘না’ ভোট পড়ার প্রশ্নই ওঠে না।” (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিন কাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১৮২)।
যেভাবে এল গণভোট
বাংলাদেশের আদি অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানে গণভোটের বিধান ছিল না। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান প্রথম গণভোটের আয়োজন করেন। এজন্য ওই বছরের ২ মে তিনি সামরিক আইন আদেশ জারি করেন— যা সাংবিধানিক বৈধতা পায় ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর সময়। ওই সংশোধনীতে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোট সম্পর্কিত (১খ), (১গ) এবং (১ঘ) বিধান যুক্ত করা হয়। ‘সংবিধান-সংশোধন’ সংক্রান্ত ১৪২ অনুচ্ছেদে (১ক) দফা যুক্ত করে বলা হয়, “(১) দফায় যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও এই সংবিধানের প্রস্তাবনা অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০ বা ৯০ক অনুচ্ছেদ অথবা এই অনুচ্ছেদের কোনো বিধানাবলির সংশোধনের ব্যবস্থা রহিয়াছে এরূপ কোনো বিল উপরিউক্ত উপায়ে গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনার সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন কি করিবেন না এই প্রশ্নটি গণভোটে প্রেরণের ব্যবস্থা করিবেন।”
তবে ১৯৯১ সালে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হয়, যার মাধ্যমে ১৪২ অনুচ্ছেদের (১ক) সংশোধন করে ৫৮, ৮০ ও ৯০ক অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়। অর্থাৎ দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরও সীমিত আকারে সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ ৮, ৪৮ বা ৫৬ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০ জুন তারিখে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গণভোটের বিধান পুরোপুরি বাতিল করা হয়।
তবে গত বছরের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে গত ১৭ ডিসেম্বর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় ১৪২ ধারা বাতিল ঘোষণা করে আদালত গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যদিও আদালতের রায়ে গণভোটের বিধানটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বহাল হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা, জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট ১৮৯৭-এর ৬ ধারা অনুযায়ী কোনো আইনকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সংসদে বিলটি পাস করাতে হয়। (নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, ফেব্রুয়ারি ২০২৫, পৃ. ১৬২)।
জিয়ার গণভোট
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম গণভোট হয় ১৯৭৭ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার প্রতি মানুষের আস্থা আছে কিনা— ওই প্রশ্নে। অফিসিয়ালি এই হ্যাঁ না বাক্সে ভোট পড়ে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৩ হাজার ৮৫৮টি। এর মধ্যে হ্যাঁ ভোট পড়ে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮৭০টি। তার মানে প্রদত্ত ভোটের ৯৮.৮৮ শতাংই জিয়াউর রহমানের ওপর আস্থা রাখেন। বাকি ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৮৯৮টি ভোট পড়ে ‘না’ বাক্সে।
ইতিহাস বলছে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হন। ফলে রাষ্ট্রপতি হওয়া ছিল তার সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু তিনি ওই সময়কে দীর্ঘায়িত করতে চাননি। রাষ্ট্রপতি সায়েম বেতার ভাষণে নিজেকে অসুস্থ উল্লেখ করে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগের ঘোষণা দিলে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। নিজের পদকে বৈধ করার জন্যে তিনি একটি বড় পদক্ষেপ নেন। সেটি হলো গণভোট। বলা হয়, জিয়াউর রহমান ওই সময়ে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন এ কথা সত্য। কিন্তু ৯৯ শতাংশ ভোট পাওয়ার মতো জনপ্রিয় ছিলেন না। (শিরীন মজিদ, শেখ মুজিব থেকে খালেদা জিয়া, কাকলী প্রকাশনী/১৯৯৩, পৃ. ৭৯)।
এরশাদের গণভোট
বাংলাদেশে দ্বিতীয় গণভোট হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনুসৃত নীতি ও কর্মসূচির প্রতি আস্থা এবং স্থগিত সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত তার রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত থাকায় জনগণের সম্মতি আছে কিনা— ওই প্রশ্নে।
বস্তুত বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ নিজের এবং তার সরকারের বৈধতা অর্জন করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াসহ বহু রাজনীতিবিদকে আটক অথবা গৃহবন্দি করেন। সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতগুলো ফের চালু করেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন এবং তার এই অবস্থান সম্পর্কে জনগণের কথিত ম্যান্ডেট নিতে গণভোটের আয়োজন করেন।
সরকারি হিসাবে এই গণভোটে ভোট পড়ে ৪ কোটি ৭৯ লাখ ১০ হাজার ৯৬৪টি। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৬১ হাজার ২৩৩ অর্থাৎ ৯৪.১১ শতাংশ ভোটার এরশাদের পক্ষে ভোট দেন। বাকি ৫.৫০ শতাংশ ভোট পড়ে ‘না’ বাক্সে।
গণভোটের দিন নির্বাচন কেন্দ্রগুলো ছিল শূন্য। জনগণের উপস্থিতি একেবারেই ছিল না। কিন্তু ভোটের বাক্স ব্যালটে ভরে যায়। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরে এরশাদ স্বগর্বে ঘোষণা করেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেট দিয়েছে। (শিরীন মজিদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪)।
মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখছেন, সাফল্যজনকভাবে গণভোট এবং উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারায় এরশাদের মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠে। এ সময় বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় সার্বিকভাবে তাদের মধ্যে একটা হতাশার ভাব বিরাজ করতে থাকে। ২১ মার্চ গণভোটের তিনদিন পর ২৪ মার্চ আকস্মিকভাবে ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মন্ত্রিসভায় যোগদান এক চমক সৃষ্টি করে। তার পথ ধরে বিরোধী শিবিরের আরো বেশ কয়েক নেতা এরশাদের সাথে যোগদানের জন্য দর কষাকষি করতে থাকে। (রাজনীতির তিন কাল, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৫)।
সবশেষ গণভোট
বাংলাদেশের ইতিহাসে তৃতীয় তথা সবশেষ গণভোট হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) বিল, ১৯৯১-এ রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেওয়া উচিত কিনা— এই প্রশ্নে। সরকারি হিসাবে এই ভোটে ৬ কোটি ২২ লাখ ৪ হাজার ১১৮টি ভোট পড়ে হ্যাঁ বাক্সে— যা প্রদত্ত ভোটরে ৮৪.৩৮ শতাংশ। যদিও বেসরকারি হিসাবে বা গবেষকদের লেখায় এই ভোটের সংখ্যা আরও অনেক কম। প্রথম দুটি গণভোটের সঙ্গে তৃতীয় গণভোটের মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, এই ভোট রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতায় টিকে থাকার বৈধতার জন্য নয়, বরং এই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় বিরোধী দলগুলো যে রূপরেখা প্রণয়ন করে তার মূল বক্তব্য ছিল, এরশাদের পতন ঘটিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সার্বভৌম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান। এরশাদের পতনের পর প্রতিটি কাজই তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ঘটেছে।
বিএনপি, আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জামায়াতসহ দেশের প্রায় সকল বিরোধী দল দেশবাসীকে হ্যাঁ ভোট দেয়ার আহ্বান জানায়। একমাত্র ফ্রিডম পার্টি দেশবাসীকে ‘না’ ভোট দেয়ার আহবান জানায়। জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি নিরব থাকে। কিন্তু সংসদে তারাও দ্বাদশ সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেয়।
এই গণভোট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও জনগণের মনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। বিরোধী দলসমূহও তেমন কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেনি। এর কারণ হয়তো এই যে, কিছুদিন আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে এবং সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সংঘাত হয়েছে। তারা পরস্পরের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল।
গণভোটের দর্শন
দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি হ্যাঁ না বা গণভোটের ফলাফলই নিরঙ্কুশভাবে সরকারের পক্ষে গেছে। সরকার যে ফলাফল চেয়েছে, গণভোটের ফলাফলে তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকি ভোটের ফলাফলের চিত্রই বলে দেয় এই গণভোটগুলো আসলে কেমন হয়েছে এবং এসব ভোটে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা ছিল।
বস্তুত এই ধরনের গণভোটের আয়োজন করাই হয় সরকারের মতামতকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সেটিকে আইনি বৈধতা দেয়ার জন্য। এসব গণভোটের প্রত্যক্ষদর্শী এবং গবেষকদের লেখায়ও এটি উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত তিনটি গণভোটেই জনগণের অংশগ্রহণ ছিল অতি সামান্য এবং যে পরিমাণ ভোট পড়েছে বলে দাবি করা হয়, সেগুলো আসলে ভোটের দায়িত্বে থাকা সরকারি লোকজনের সৃষ্ট।
এই ধরনের ভোটের ব্যাপারে নানা কারণেই মানুষের আগ্রহ থাকে না। প্রথমত, এই ভোটে তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন না। কোনো প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না। ফলে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার লোক থাকে না। সরকারও এই ধরনের ভোটে বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হবে, তা প্রত্যাশা করে না। তারা একটি নিয়মরক্ষার আয়োজন করে— যাতে গৃহীত উদ্যোগ বা পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতে আইনি ও সাংবিধানিক প্রশ্নের মুখে না পড়ে। এটা একধরনের গা বাঁচানো তরিকা।
নির্বাচন বললে যেখানে উৎসাহ উদ্দীপনা এবং একইসাথে ভয় ও আতঙ্ক মিলিয়ে একটা টানটান উত্তেজনার ব্যাপার থাকে, গণভোটে তা থাকে না। সরকার নিজেও জানে যে, এই ধরনের ভোটের কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু তারপরও তারা নিজেদের পক্ষে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা আছে প্রমাণের জন্য হ্যাঁ না ভোটের আয়োজন করে থাকে।
সুতরাং, এখন যারা বিভিন্ন ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের দাবি জানাচ্ছেন বা সুপারিশ করছেন, তাদেরকে গণভোটের অতীত অভিজ্ঞতা তথা বিগত তিন গণভোটের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা দরকার। গণভোটের অর্থ যদি হয় সরকার ও তাদের অংশীজনদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত চাপিয়ে দিয়ে তার আইনি বৈধতা দেয়া— তাহলে এটি নিয়েও বিতর্ক হবে। তার চেয়ে বড় কথা, যেহেতু বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে গণভোটের কোনো বিধান নেই, ফলে এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি। সম্প্রতি পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি লিখিতভাবে যে মতামত জমা দিয়েছে, সেখানে তারা সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ ও গণভোটের বিপক্ষে মত দিয়ছে।
পরিশেষে, সংবিধান সংশোধন করে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার আগে শুধু আদালতের রায় অথবা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে গণভোট করা যাবে কিনা— তা আইনি ও সাংবিধানিক প্রশ্ন। তাছাড়া অতীতে যে প্রক্রিয়ায় গণভোট হয়েছে, ওই একই প্রক্রিয়ায় ভোট হলে তার ফলাফল যে কী হবে, সেটি যেহেতু সহজেই অনুমেয়, অতএব ভোটের পদ্ধতি নিয়েও পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।