Published : 03 May 2025, 10:57 AM
একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হতো সাংবাদিকতা হচ্ছে সৌখিন ও স্বচ্ছল লোকের সন্তানদের পেশা— যাদেরকে মাস শেষে বেতনের চিন্তা করতে হয় না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে যারা একসময় কাজ করতেন, তাদের বিরাট অংশের জন্যই এটা ছিল সেকেন্ডারি বা দ্বিতীয় কাজ। অর্থাৎ তিনি হয়তো শিক্ষকতা করেন বা অন্য কোনো চাকরি করেন, ব্যবসা করেন— তার ফাঁকে সাংবাদিকতাটাও করেন এক-আধটু। এটা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব ছিল যতক্ষণ না ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বিকশিত হয়েছে। যতক্ষণ না প্রতি মুহূর্তের খবর জানানোর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। যতক্ষণ না টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ঘটেছে। ফলে একটা সময় পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকরা দিনের সব কাজ সেরে সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে গিয়ে কোনোদিন একটি, কোনোদিন দুটি সংবাদ ফ্যাক্সে ঢাকা অফিসে পাঠাতেন। কোনো কোনোদিন হয়তো একটিও না। আর সংবাদের সংশ্লিষ্ট ছবি এবং বিশেষ সংবাদ ও ছবি পাঠাতেন ডাকে। সেই সংবাদ ও ছবি পরদিন পত্রিকা অফিসে পৌঁছাত। ছাপা হতো তারও দুয়েকদিন পরে। খুব জরুরি হলে অন্য কোনো উপায়ে সংবাদ ও ছবি পাঠানো হতো। যারা স্থানীয় পর্যায়ে এই ধরনের সাংবাদিকতা করতেন, তারা সামাজিকভাবে বেশ সম্মানীয় মানুষ হলেও মাস শেষে তাদের অধিকাংশই কোনো সম্মানি পেতেন না। সম্মানির ব্যাপারে তাদের খুব একটা চাওয়াও ছিল না। কারণ তারা পত্রিকার পাতায় নিজের নামটি ছাপার অক্ষরে দেখে আনন্দ পেতেন। একইসঙ্গে নিজের এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন বলে বিশ্বাস করতেন। ফলে সেখানে সম্মানির বিষয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
কিন্তু এই পুরো দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট। যার মাধ্যমে মুহূর্তেই সংবাদ, ছবি এমনকি ভিডিও পাঠানো যাচ্ছে। ফলে চাহিদাও বেড়েছে। যারা একসময় সারা দিনের কাজ সেরে হেলেদুলে, চা খেতে খেতে, গল্প করতে করতে সংবাদ লিখতেন এবং ধীরে সুস্থে ফ্যাক্সে পাঠাতেন, উপরন্তু যারা কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছেন— তারা ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। সেটা জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়েও।
এখন কোনো পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইন সংবাদমাধ্যমের উপজেলা প্রতিনিধিকেও কম্পিউটারে লিখতে জানতে হয়। ইন্টারনেটে সংবাদ পাঠাতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার উপযোগী কনটেন্ট তৈরি কিংবা কনটেন্টের কাঁচামাল সরবরাহ করতে হয়। এমনকি তাদেরকে ঘটনাস্থল থেকে অথবা বিভিন্ন বিষয়ে লাইভে বা সরাসরি কথা বলতে হয়। এসব কারণে স্থানীয় পর্যায়েও এখন বিপুল সংখ্যক তরুণ সাংবাদিকতায় এসেছেন, আসছেন। প্রশ্ন হলো, তারা কি এই কাজগুলো আর আগের প্রজন্মের মতো বিনা পয়সায় কিংবা নামমাত্র সম্মানিতে করবেন? নিশ্চয়ই করবেন না। এখন স্থানীয় পর্যায়েও এরকম লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যারা শুধুমাত্র পত্রিকার পাতায় নিজের নাম ছাপানো এবং নিজের এলাকার খবর দিয়ে সামাজিক দায় মেটাতে চান কিন্তু তার বিনিময়ে কোনো বেতন বা সম্মানি চান না। কেউ কেউ এরকম থাকতে পারেন যদি তিনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন। যদি সাংবাদিকতা করে তার সংসার চালাতে না হয়।
যদি কারো বিকল্প আয়ের পথ না থাকে, যদি সাংবাদিকতা করেই তাকে চলতে হয়, তাহলে তাকে বেতন দিতে হবে। না দিলে তিনি সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের পরিচয় ব্যবহার করে অবৈধ পথে, অসৎ উপায়ে পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করবেন। এটা শুধু স্থানীয় পর্যায়ের ব্যাপার নয়, সংবাদমাধ্যমের মূল অফিসের কর্মীদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। যদি তাদের ঠিকমতো বেতন না হয়, সংসার চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি না থাকে, তাহলে হয় তাকে বিকল্প কোনো আয়ের পথ খুঁজতে হবে, না হয় অসৎ পথে পা বাড়াতে হবে।
একজন ব্যবসায়ী বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর অসৎ হওয়া আর একজন সাংবাদিকে অসৎ হওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক। মানুষ মনে করে ও বিশ্বাস করে যে, যে কোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি সমাধান করতে পারুন বা না পারুন, অন্তত সমাধানের একটা উপায় বলে দেবেন। এই যে বিশ্বাস জনমনে তৈরি হয়েছে, সাংবাদিককে যদি এর মর্যাদা দিতে হয়, তাহলে আগে তার নিজেকে মর্যাদাবান করে গড়ে তুলতে হবে। যদি তাকে সারাক্ষণ নিজের রুটিরুজি নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়; নিজের চাকরির অনিশ্চয়তা নিয়ে সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতে হয়— তাহলে তার পক্ষে ওই সামাজিক দায়িত্ব পালন তথা জনপ্রত্যাশা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
২.
বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই পেশাগত অনিশ্চয়তা। যেকোনো সময় যেকোনো অজুহাতে কিংবা যেকোনো কারণে যে কারোর চাকরি চলে যেতে পারে। মূলধারার পত্রিকার সাংবাদিক হলে তিনি ওয়েজবোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী কিছু আর্থিক সুবিধা পেলেও টেলিভিশনে কোনো ওয়েজবোর্ডও নেই। ফলে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে চাকরিচ্যুত হলে কোনো আর্থিক সুবিধা নাও পেতে পারেন। না পেলে তিনি সর্বোচ্চ শ্রম আদালতে যেতে পারেন। যদিও অনেকেই এসব ঝামেলায় যেতে চান না।
সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের এই পেশাগত অনিশ্চয়তার বিষয়টি উঠে এসেছে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভাগুলোয় সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। তাদের মতে, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ, সাহসী, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। এছাড়া কমিশনের ওয়েবসাইটে দেশজুড়ে আসা পরামর্শগুলোতেও বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
কমিশন মনে করে, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা মূলত তাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের গত পাঁচ দশকের গণমাধ্যম বিকাশে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার দিকে তেমন নজর দেওয়া হয়নি। বর্তমানে অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। তবে তাদের মধ্যে খুব কমই সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন-ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধার প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী সব পেশার শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও গত ৫৪ বছরে গণমাধ্যমকর্মীদের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ, অন্যান্য পেশায় শ্রম আইন যতটা প্রয়োগ হয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তা একেবারেই অপ্রতুল। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন্স অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর বিধানসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়নি। এছাড়া প্রেস কাউন্সিলকেও সাংবাদিকদের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার বিষয়ে কোনো ভূমিকা বা এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।
সাংবাদিক-কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন সময় ওয়েজ বোর্ড গঠিত হলেও এর বাস্তবায়নে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিছু পত্রিকা এখনো পঞ্চম ওয়েজ বোর্ডের বেতন কাঠামো অনুসরণ করে, আবার কিছু প্রথম সারির পত্রিকা নির্ধারিত কাঠামোর চেয়ে বেশি সুবিধা দেয়। নবম ওয়েজ বোর্ড ঘোষিত হলেও তা শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা-বাসসে পূর্ণভাবে এবং ইংরেজি দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে আংশিকভাবে কার্যকর হয়েছে, অন্য কোথাও নয়। সংবাদপত্র মালিক সমিতির মামলায় এর বাস্তবায়ন গত ছয় বছর ধরে আটকে আছে। এছাড়া মালিকদের সংগঠন (নোয়াব) ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে দুর্নীতির কারণে অসম প্রতিযোগিতার অভিযোগ এনেছে।
বাস্তবতা হলো, বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহার ও অন্যান্য কারণে ঢাকায় জীবনযাপনের ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সেই তুলনায় সংবাদকর্মীদের প্রকৃত মজুরি মোটেও বাড়েনি। ১৯৬৩ সালে সাংবাদিকদের সর্বনিম্ন গ্রেডের ন্যূনতম বেতন ছিল প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার বেতনের সমান। কিন্তু বর্তমান বেতন কাঠামোয় কোনো মিল নেই। আবার ঢাকার বাইরে জীবনযাপনের ব্যয় কিছুটা কম হলেও সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিদের যে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তাও বর্তমান জীবনযাপনের ক্ষেত্রে একেবারেই অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের সংবাদদাতাদের কোনো বেতনই দেওয়া হয় না।
গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন মতবিনিময় সভায় অনেক সাংবাদিক জানিয়েছেন যে, তাদের চাকরির ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই। কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনো সময় বিনা নোটিশে সাংবাদিকদের বরখাস্ত করা হয়। অনেক সময় নিয়োগপত্রেও অন্যায়ভাবে সেরকম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। অনেক সময় ঘুম থেকে উঠে সাংবাদিক তার মোবাইলের মেসেজে জানতে পারেন যে তার চাকরি নেই। অনেক সময় অ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফিরে এসে সাংবাদিক দেখতে পান তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। অথচ শ্রম আইনে ছাঁটাই, বরখাস্ত বা চাকরি থেকে ডিসচার্জ করার সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এবং সেক্ষেত্রে সাংবাদিককে আগে থেকে নোটিশ প্রদান এবং ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে, যা বেশির ভাগ গণমাধ্যম লঙ্ঘন করে থাকে।
৩.
সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষায় বেশ কিছু সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম কমিশন। যেমন নিয়োগপত্র ও ছবিসহ পরিচয়পত্র ছাড়া এবং বিনা বেতনে কোনো সাংবাদিককে অস্থায়ী, স্থায়ী কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা যাবে না; সাংবাদিকদের শিক্ষানবিশ চাকরির মেয়াদ এক বছরের বেশি হবে না; সাংবাদিকদের স্থায়ী চাকরির শুরুতে একটি অভিন্ন ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করা প্রয়োজন, যা হবে সরকারি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার মূল বেতনের সমান; ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেশি হওয়ার দরুন ঢাকায় নিয়োজিত সাংবাদিকরা মূল বেতনের সঙ্গে ‘ঢাকা ভাতা’ (অ্যালাউন্স) প্রাপ্য হবেন; মূল বেতনের বাইরে সাংবাদিকরা বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, মূল বেতনের সমপরিমাণ উৎসব ভাতা, ঝুঁকি ভাতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অবসর ভাতা কিংবা গ্র্যাচুইটি পাবেন; প্রতি বছরের শুরুতে পূর্ব বছরের গড় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকদের বেতন বাড়বে ইত্যাদি।
একইভাবে সাংবাদিকের জন্য ঝুঁকি ভাতা, বিমা ও পেনশন চালু করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশনও। সাংবাদিক কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়ে শ্রম সংস্কার কমিশন প্রতিবেদনটিতে সব ধরনের সংবাদমাধ্যমের (ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট) সাংবাদিক ও কর্মীদের জন্য ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্ট ১৯৭৪’ এর আদলে পৃথক আইন প্রণয়ন বা বিদ্যমান শ্রম আইনে পৃথক অধ্যায় সংযোজনের সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে বিদ্যমান শ্রম আইনে ‘সংবাদপত্র শ্রমিক’ এর সংজ্ঞা সম্প্রসারণ করে ‘গণমাধ্যম শ্রমিক/কর্মী’ করা এবং অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট অর্থাৎ রেডিও, টেলিভিশনসহ সব ধরনের গণমাধ্যমকর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলেছে।
সাংবাদিকদের বেতন নিয়মিতকরণের লক্ষ্যে প্রতিটি মিডিয়ার কর্তৃপক্ষকে/মালিককে প্রতি মাসের বেতন পরিশোধের ডকুমেন্ট কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে পাঠানোর বিধান করা, সব সাংবাদিকের জন্য ঝুঁকি ভাতা, বিমা ও পেনশন চালু করারও সুপারিশ করেছে।
গণমাধ্যম ও শ্রম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো নিঃসন্দেহে সাংবাদিকদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য জরুরি। যদি সত্যিই এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে সাংবাদিকের পেশাগত অনিশ্চয়তা কমবে এবং তার মধ্য দিয়ে তাদের অন্তত আর্থিক দুশ্চিতা হ্রাস পাবে। কেননা সাংবাদিকদের এমনিতেই নানাবিধ ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। বিশেষ করে অপরাধসংশ্লিষ্ট এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। যদিও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে কিংবা কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের কারণে তিনি আহত হলে বা তার জীবন বিপন্ন হলেও রাষ্ট্র তো দূরে থাক, তার নিজের প্রতিষ্ঠানও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পাশে থাকে না। ফলে কমিশনের সুপারিশগুলো আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, সেটা পুরোপুরি নির্ভর করছে সংবাদমাধ্যমের মালিকদের ওপর। তারা আন্তরিক না হলে ঝুঁকি ভাতা তো বটেই, সাংবাদিকরা অন্তত মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বেতন পাবেন, উৎসব ভাতা ও বোনাস পাবেন, হুটহাট চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্কে থাকবেন না, চাকরি ছেড়ে দিলে বা চলে গেলে নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সুবিধা পাবেন—সেটিও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
অতএব, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে সংবাদমাধ্যমের মালিকদের প্রতি এই অনুরোধ থাকলো, যারা আপনাদের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং আপনাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষায় যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছেন—সেই সংবাদকর্মীদের মাস শেষে যেন অন্তত বেতন নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে না হয়, অন্তত এটুকু নিশ্চিত করুন।
সাংবাদিকতা মানে যদি প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতাই হয়, তাহলে পেশাগত নিশ্চয়তা ছাড়া কারো পক্ষে সাংবাদিকতা করা সম্ভব কি না, সেটি বিরাট প্রশ্ন। কেননা, সংবাদকর্মীকে যদি সারাক্ষণ নিজের চাকরি বাঁচানো কিংবা মাস শেষে বেতন হবে কি না; মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বছর শেষে ইনক্রিমেন্ট হবে কি না; নির্দিষ্ট সময়ের পরে পদোন্নতি হবে কি না— এসব নিয়ে চিন্তা করতে হয়; বয়স ও বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি তার চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে যায় এবং জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে যদি তার মধ্যে এই উপলব্ধি তৈরি হয় যে, সাংবাদিকতায় এসে ভুল করেছি— তাহলে তার পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও নির্মোহ সাংবাদিকতা করা দুরূহ।