Published : 30 Apr 2025, 08:02 PM
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মার্চে বাংলাদেশ সফরের সময় রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। যার মূল উদ্দেশ্য সংঘাত-বিধ্বস্ত রাখাইন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। নিতান্তই মানবিক একটি প্রচেষ্টা। তবে বাস্তবতা অনেক জটিল। মিয়ানমারের দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ, জাতিগোষ্ঠীগত বিভাজন, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি এবং সর্বোপরি জান্তা সরকারের ক্ষমতার বিপরীতে রাখাইনের প্রায় নব্বই শতাংশ অঞ্চলে সশস্ত্র বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখল।
সব মিলিয়ে এই করিডোর কেবল ত্রাণ বিতরণের বিষয় নয়, এটি একটি কৌশলগত রণক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। যে প্রশ্নটি বিশ্লেষক বিশেষজ্ঞরা তুলছেন, তা হলো এই মানবিক উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো সমীকরণের অংশ হওয়ার শঙ্কায় পড়ছে কিনা? কেউ কেউতো ‘প্রক্সি ওয়ার’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার করতেও পিছপা হচ্ছেন না।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের পর, রাখাইনে আলোচিত করিডোর নিয়ে বাংলাদেশও নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন সরকার এই করিডোরের জন্য নীতিগতভাবে রাজি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব অবশ্য বললেন, “সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো এনটিটির সাথে এই তথাকথিত করিডোর নিয়ে আলোচনা করেনি এখনও। তবে নীতিগতভাবে রাজি। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সাথে আলোচনা করা হবে।” তার এই বক্তব্য ভিন্ন সমীকরণের শঙ্কাগুলো উড়িয়ে দেয় বটে।
তবে যে প্রশ্নটি কেউ তুলছে না তা হলো, এই করিডোরের আলোচনা, গঠন বা বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার তথা ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের ভূমিকা কি হবে? মানবিক করিডোরের মূল ভাবনাই হলো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের সব অংশের সাথে আলোচনার মাধ্যমে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ। তাহলে এই করিডোরে নন স্টেট অ্যাক্টর হিসাবে আরাকান আর্মি যেমন পার্টি, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনরাও পার্টি। জান্তার সাথে আলোচনা না করে এই করিডোর বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এতে আরাকান আর্মির ডি-ফ্যাক্টো শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো হতে পারে। মিয়ানমার সরকার এই উদ্যোগকে নিজের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, সিরিয়া, গাজা, কিংবা ইথিওপিয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে যেভাবে মানবিক করিডোরকে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের অংশ বানানো হয়েছে, রাখাইনের ক্ষেত্রেও সেই ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না।
বাংলাদেশ বারবারই বলছে, জাতিসংঘের উদ্যোগে সহযোগিতামূলক প্রতিবেশীর দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতিসংঘ কার্যালয় বলছে, এখানে তাদের কাজ করার সুযোগ সীমিত। এক্ষেত্রে দুই সরকারকেই আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে রাখাইনে কোনো সহায়তা সরবরাহ বা পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার দুই সরকারকেই একমত হতে হবে।
জাতিসংঘের এই অবস্থানে পরিষ্কার যে জান্তা সরকারকে অন্ধকারে রেখে করিডোর সম্ভব নয়। বরং তা করা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কা থাকে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা করবে কে? ঢাকা নাকি জাতিসংঘ। নাকি যুদ্ধে লিপ্ত অংশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে একমত হয়ে বাংলাদেশ যেন সহযোগিতা করতে পারে সেই পথ প্রশস্ত করবে? মনে রাখতে হবে আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক যোগাযোগের স্বীকৃত চ্যানেল ঢাকা-নেপিদো। তাই নেপিদোর সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া করিডোরকে মিয়ানমার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে তুলে ধরতে পারে, তাতে চীন-রাশিয়ার মতো মিত্র রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক সহায়তাকে বিদেশি হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এছাড়া, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের সহযোগিতা অপরিহার্য। তাদের বাদ দিয়ে যদি করিডোর চালু হয়, তাহলে জান্তা সরকার আন্তর্জাতিক দায়ভার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে। তাই মানবিকতা ও বাস্তবতার সন্ধি দরকার। সব পক্ষ রাজি হলেও, করিডোরের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি সংযুক্ত করতে হবে। শুধু ত্রাণ নয়, একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও সামাজিক সমাধান দরকার। এক্ষেত্রে করিডোর ব্যবস্থাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করে করিডোরের বিনিময়ে প্রত্যাবাসন ধাঁচে আলোচনার সুযোগ তৈরি করা উচিত। আবার বাংলাদেশকে স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এই করিডোর দেশের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হবে না।
রাখাইনের প্রস্তাবিত মানবিক করিডোর আসলে একটি বহুমাত্রিক কৌশলগত ক্ষেত্র, যেখানে মানবতা, ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা ও প্রত্যাবাসন, সব একসাথে জড়িত। তাই বাংলাদেশের কেবল মানবিকতার ভাষা নয়, কৌশলের ভাষা ব্যবহার করাটাও জরুরি। এই করিডোরের মাধ্যমে সহানুভূতির প্রবাহ যেমন তৈরি হতে পারে, তেমনি অসতর্ক হলে তা-ই হয়ে উঠতে পারে নতুন সংকট সূত্রপাতের কারণ।