এখন এসেছি এই নতুন শহর ওফেনবাখে। মানে আমাদের নতুন করে আবার প্রয়োজনীয় রাস্তা, ট্রাম ও বাস স্টপেজ, কেনাকাটার দোকান ইত্যাদি চিনতে হবে। ইতোমধ্যে কীভাবে জায়গা চিনতে হবে, তার একটা পদ্ধতি আমরা বের করেছিলাম। আমরা তখনও জানি না যে ট্যুরিস্ট ম্যাপ দেখে এগুলো বের করা যায়। আর কেউ এ বিষয়ে আমাদের বলেনি।
পরের দিন নাস্তা করার পর আমরা তিন জন বেড়িয়ে পড়লাম। বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখে নিলাম, আমাদের বাসার পাশের বড় রাস্তার নাম কী? এখানে রাস্তাগুলোর ক্রসিং-এ সাইন বোর্ডের মত বেশ বড় বড় করে লেখা থাকে, কোন রাস্তার কী নাম। দেখতে পেলাম, লেখা আছে বেটিনা স্ট্রিট।
আগেই জেনেছিলাম, আমাদের এই বাসার কাছেই বাস স্টপেজ আছে। আমাদের বাসাটা ছিল বেটিনা স্ট্রিট ও লুডভিগ স্ট্রিটের ক্রসিং-এর একটা রুটির দোকানের পর। সুতরাং মনে হলো, বেড়িয়ে ফিরে আসতে পারবো।
প্রথম প্রথম এই ধরনের নতুন দেশে, মানে যেখানে ইংরেজির ব্যবহার কম এবং যেখানে রাস্তায় আমাদের দেশের তুলনায় খুব কম মানুষ চলাচল করে, সেখানে প্রয়োজনবোধে জিজ্ঞেস করার লোক পাওয়া কষ্টকর। যা-ও আবার পাওয়া যায়, দেখা যাবে সে বলছে যে ‘নো ইংলিশ’।
আমাদের বন্ধুরা আমাদের বলে দিয়েছিল, বাসা থেকে বেরিয়ে বাম দিকে সোজা হাঁটলেই এক সময় ট্রামের লাইন দেখা যাবে এবং ওখানে একটি স্টপেজও আছে। আমরা সোজা হাঁটছি, বেশ কয়েকটা ক্রসিংও পার হলাম। তারপর দেখেছি সেই আকাঙ্ক্ষিত ট্রাম লাইন। তখন অবশ্য ট্রাম চলাচল দেখা যাচ্ছিলো না। পরে দেখেছি। আসলে খুব একটা দূরে স্টপেজটি ছিল না। কিন্তু কথায় আছে যে অনিশ্চিত পথ দূর মনে হয়। মনে হয়, সেদিন আমাদের তাই হয়েছিল।
সম্ভবত পাঁচটা চৌরাস্তা পার হতে হয়েছিল, তারপর দেখলাম ট্রাম চলতে। আমাদের মন খুশি হয়ে গেল। যেন বিরাট একটা কিছু পেয়ে গেছি। নতুন জায়গায় গেলে মনে হয় অনুভূতি এরকমই হয়। ওই মুহূর্তে মানুষের মাথায় অন্য কিছু থাকে না। তখন ছোটখাটো প্রাপ্তির মধ্যে মানুষ আনন্দ খুঁজে পায়।
ট্রাম স্টপেজের কাছে গিয়েই বন্ধুদের কথা মতো মার্কেট প্লেস, যাকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘মার্কট প্লাজ’, সেই জায়গাটি দেখার জন্য আবার হাতের বাম দিকে হাঁটতে থাকলাম। বাসা থেকে এই স্টপেজের যতটুকু দূরত্ব, মনে হলো ওখান থেকে মার্কট প্লাজের ততটুকুই দূরত্ব।
মার্কট প্লাজের কাছে এসে প্রচুর দোকানপাট এবং জনসমাগম দেখে বোঝা গেল, এটাই ওফেনবাখ শহরের কেন্দ্র মানে ‘ওফেনবাখমার্কট প্লাজ’। ওই সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ১৬ নাম্বার ট্রামের শেষ স্টপেজে ছিল এই মার্কট প্লাজ। সেই জায়গায় ঘোরাঘুরি করে বেশ সময় পার করে আমরা আবার যাওয়ার সময় যে পথ দিয়ে গিয়েছিলাম, সেই পথের দিকেই পা বাড়ালাম, যাতে রাস্তা হারানোর ঝুঁকি না থাকে।
ফিরতি পথে চোখে পড়ল, কিছুদূর সামনে ‘আলদি’ নামে পেনি মার্কেটের মতো একটি দোকান। এই দোকানের নাম ফ্রাঙ্কফুর্ট আসার পরই শুনেছি, কারণ এসব দোকানের পণ্য তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দোকানের চেয়ে বেশ সস্তা। পরবর্তীতে আমরা এই দোকান থেকে অনেক বাজার করেছি।
আমরা সেই দোকানে ঢুকলাম। ওখান থেকে মুরগির অংশ বিশেষ, যেটাকে আমরা বলতাম- মুরগির পার্টস, আর আলাদাভাবে মুরগির গিলা-কলিজার প্যাকেট কিনলাম। মোট কথা, পেট চালানোর মতো যত সস্তা খাবার পাওয়া যায়, সেগুলো কিছু কিনে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাসায় এসে আবার সেই সংগ্রাম, পেটের ক্ষুধা মেটাতে হবে। তাই দুপুরে আবার আমরা তিন জন লেগে গেলাম আলু আর ডিম সেদ্ধ ভর্তা আর ভাত করতে। তখন এসব খাবার খুব একটা খারাপ লাগতো না। কারণ পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলো যে পাচ্ছিলাম, সেটাকে অনেক বড়ই মনে হতো। এভাবে এগিয়ে চলল আমাদের প্রবাস জীবন আর তিনজনের সংসার।
চলবে ...
লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |