দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের কোনো বই অনলাইনে ফরমায়েশ দেবার প্রক্রিয়া এখনো চালু হয়নি। অথচ এই সুযোগ আছে আমাদের তিন পাশে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী দেশটির বেলায়। তাহলে আমরা কী এমন ডিজিটাল করলাম বা হলাম?
Published : 23 Apr 2024, 04:44 PM
২৩ এপ্রিল ‘বিশ্ব বই দিবস’। দুনিয়াব্যাপী জাতিসংঘ প্রবর্তিত বিশ্ব বই দিবসকে ঘিরে গ্রন্থ প্রকাশনা, পঠন এবং মেধাস্বত্বের তাৎপর্যকে তুলে ধরা হচ্ছে। একইসঙ্গে এর সামনের গলদ বা বাধা দূরীকরণ আর বিদ্যমান বাস্তবতা আর প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার জন্যে চলছে নানা বিতর্ক, নীতিনির্ধারণী আলোচনা আর আইনগত সংস্কারের উদ্যোগ। বিশেষ করে মেধাস্বত্ব, গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা চৌর্যবৃত্তি বা এআই, ই-বুক, শ্রুতিপুস্তক এরকম বিবিধ বিষয় নিয়ে।
নবনিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান তরুণ সদস্যের ভূমিকায় জাতীয় সংসদে গত মেয়াদে জোরালো কণ্ঠস্বর হিসেবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তার বাবা শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীর বিক্রম। তাৎপর্যপূর্ণ পারিবারিক এই পরিচয়টি তার রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে দিয়েছে। নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী সম্পর্কে মোটা দাগে এর বাইরে তেমন কিছু জানা যায় না। মন্ত্রিত্ব লাভের পূর্বে সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গেও দৃশ্যত তার সংশ্লিষ্টতারও কোনো খবর আপাতত আমাদের কাছে নেই। তাতে তেমন কিছু যাবে বা আসবে না। কেননা পরিবহনমন্ত্রী যেমন যানবাহন চালিয়ে দক্ষতা দেখাবেন না, বিমানমন্ত্রী যেমন উড়োজাহাজ চালাবেন না, কৃষিমন্ত্রী যেমন মাঠে নেমে জমি চাষ করবেন না, শিক্ষামন্ত্রী তেমনি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে পাঠদান করবেন না। বইপত্র সংক্রান্ত সরকারি যাবতীয় কাজ যেহেতু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন, কাজেই আমরা সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘বইমন্ত্রী’ বলতেও পারি। নাহিদ ইজাহার খানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা বই নিয়ে অনেক কিছু করবেন তিনি।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন রাজনীতিবিদ লেখক, কবি, অভিনেতা, শিল্পী বা সংস্কৃতির ঠিকাদার বা সংস্কৃতির একজন মোড়ল হবেন— এমন কোনো কারণ নেই। আমআদমি হিসেবে আমরা বুঝি মন্ত্রীর মূল কাজ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে নীতিনির্ধারণী উদ্যোগ গ্রহণ, চলমান ইতিবাচক কর্মযজ্ঞকে বেগবান করা আর প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রমগুলোর বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করে নতুন নীতি প্রণয়নে এগিয়ে আসা। এখানেই একজন মন্ত্রীর যোগ্যতা আর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে বই দিবসের প্রাক্কালে একটা কথা বলে রাখি, একজন মন্ত্রী নিজে গাড়ি চালান বা না চালান, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করুন বা না করুন, কৃষিকাজ করুন বা না করুন, উড়োজাহাজ চালান বা না চালান সবাইকে বই পড়তে হয়। এর কোনো বিকল্প আধুনিক দুনিয়ায় নেই।
বিগত দুই মেয়াদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিদায়ী দুই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী অনেকটা রুটিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। যার ফলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনেকটা আমলাদের খপ্পরে থেকে গেছে। ফলস্বরূপ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলা একাডেমিসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বায়ত্তশাসন খুইয়ে বসেছে। সময় এসেছে প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন এবং নীতিমালার সংস্কার করে স্বায়ত্তশাসন পুনরুদ্ধার করা। একই সঙ্গে বইয়ের মান এবং বাংলা ভাষাসহ অন্যান্য চল্লিশটির মতো আদিবাসী ভাষা রক্ষা ও উৎকর্ষ সাধনে উদ্যোগ গ্রহণ।
এদিকে স্থায়ী অভিধান সভা এবং কেন্দ্রীয় ভাষা উন্নয়ন বোর্ড না থাকার কারণে দেশে বিবদমান ভাষা ব্যবহারে বিশৃঙ্খলা বেড়েই চলেছে। দিন দিন নতুন শব্দ আবির্ভূত এবং আমদানি হলেও সেসবের নিজস্ব পরিভাষা এবং হালনাগাদ ভুক্তির উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেই। এসবের ছাপ বইপুস্তক এবং পত্রপত্রিকায় ভাষা ব্যবহারের ছিরি থেকেই প্রতীয়মান হয়। বাঙালি এখন মুখের ভাষাটিও ঠিকমতো বলতে পারে কি? শিক্ষিত শ্রেণি এমনকি আমলা, চাকরিজীবী, শিক্ষক, গণমাধ্যমের কর্মীবৃন্দ বিশেষ করে টকশোতে অংশগ্রহণকারী অনেকেরই বাংলা বাক্যের আগাপাশতলায় ইংরেজির ব্যবহার বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। এরকম বাস্তবতার প্রতি নতুন প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্ট আকর্ষণ করতে চাই।
এবার মেধাস্বত্ব বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই। যতদূর জানি আমাদের দেশে মেধাস্বত্ব নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। যদিও মাঝেমধ্যে এসব নিয়ে দু-একটি মামলা আলোচনায় আসে। এখানে লেখক শেখ আব্দুল হাকিম বনাম সেবা প্রকাশনীর কাজী আনোয়ার হোসেনের মামলার কথা উল্লেখ করা যায়। মেধাস্বত্ব আইন হালনাগাদ করা, বাস্তবায়ন ও চর্চার জন্য সচেতনতা এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট মহলকেই দেখভাল করতে হবে।
স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও আমাদের কোনো সংস্কৃতি নীতি যেমন নেই, তেমন নেই নির্ভর করবার মতো গ্রন্থ নীতি ও অনুবাদ নীতি। যদিও ২০০৯-২০১৪ মেয়াদের সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের আগ্রহে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছিল। এই কমিটি সংস্কৃতি নীতির জন্যে প্রতিবেদন আকারে একটা খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করেছিলেন। একই সময়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকে প্রধান করে গ্রন্থাগার বিষয়ে প্রতিবেদন দেবার জন্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটিও চমৎকার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়ে এক দশকের অধিককাল পরেও এসব প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সেসব বাস্তবায়নে কোনোরকম উদ্যোগও নেয়া হয়নি।
তাই নতুন প্রতিমন্ত্রীর সামনে সংস্কৃতি নীতি, গ্রন্থনীতি এবং অনুবাদ নীতি প্রণয়নের কর্মযজ্ঞটি রয়ে গেছে। সারাদেশের গ্রন্থাগারগুলোকে ডিজিটাল যোগাযোগ বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা সময়ের দাবি। কার্যকর গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অন্তঃগ্রন্থাগার বই লেনদেন, এমনকি আন্তঃদেশীয় বই লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত বিভাগীয় শহরের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্র্রান্থাগারকে জাতীয় গ্রন্থাগার এবং আর্কাইভসের সঙ্গে সমন্বিত ডিজিটাল কারিগরি ব্যবস্থাপনায় এনে আমাদের প্রকাশনাগুলোকে রক্ষা এবং সহজলভ্য ও ব্যবহার উপযোগিতা বৃদ্ধির জন্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা যেতে পারে। একটি কথা প্রচলিত আছে বাংলাদেশে প্রকাশিত কোনো বই একসময় পাওয়া না গেলেও আমেরিকার কোনো না কোনো গ্রন্থাগারে পাওয়া যাবে। পরাধীন ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা এবং সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞের অনেক নমুনা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলতে চাই চারণকবি মুকুন্দদাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনার কোনো হদিস কারও কাছে নেই।
দেশের মফস্বল শহরগুলোর পাড়া-মহল্লার গ্রন্থাগারগুলো বেশিরভাগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জেলা পর্যায়ের গ্রন্থাগারগুলোর ভূমিকাও খুব একটা আশাপ্রদ নয়। উপজেলা পর্যায়ে গ্রন্থাগারই নেই, যেখানে একটি আধুনিক ও কার্যকর রাষ্ট্রে কম করে হলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণগ্রন্থাগার থাকা দরকার। এমনকি প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার রাজধানী ঢাকাতে গণগ্রন্থাগার বলতে একটি। এই শহরে কম করে হলেও প্রতি ওয়ার্ডে একটি গণগ্রন্থাগার থাকা বাঞ্ছনীয়।
অন্যদিকে পরিবহন শ্রমিক অধ্যুষিত সদরঘাট, সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী এবং শিল্পকারখানা শ্রমিক এলাকা তেজঁগাও, আশুলিয়া এবং সাভারে শ্রমিকদের পঠন-পাঠনের জন্যে কোনোরকম সুযোগ সুবিধা আছে কি? দেশের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার কয়টিতে গ্রন্থাগার রয়েছে? এসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের সহপাঠ্যক্রমিক পড়াশোনার হালহকিকত কোন পর্যায়ে? এসব বিষয়ে হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরার এখতিয়ার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের থাকা দরকার। ডিজিটাল রমরমা অবস্থায় দেশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ডাকঘরগুলো হুমকির মুখে। এগুলোকে আধুনিক-যুগোপযুগী ও ব্যবহারযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে নিয়ে এগুলোকে ডাক, ডিজিটাল তথ্য এবং বইঘর হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গ্রন্থাগার ও পাঠ উন্নয়ন বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সর্বোপরি পাঠ উন্নয়ন ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ। এর পেছনে দায় এবং দায়িত্বটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরই। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে। একটি জাতি বই না পড়ে স্মার্ট হবে কোন দৌলতে আমার মাথায় আসে না। স্মার্ট এবং ডিজিটাল সাফল্য বলতে যদি টিকটক, ফেইসবুক এবং স্মার্টফোনকে বুঝে থাকি তাহলে অবশ্য বলার কিছু থাকে না।
বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে প্রায়ই ছোটদের এমনকি তরুণদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। বলা হয় প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাচ্ছে। আমি অন্য একটি প্রশ্ন তুলতে চাই। খোদ জাতীয় সংসদের তিনশত পঞ্চাশ জন সদস্যের মাঝে কতজনের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার আছে? তারা কে কোন ধরনের বই পড়েন? তাদের সর্বশেষ পড়া বই কোনটি? এই মুহূর্তে কোন বই পড়ছেন? ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’সহ বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো তারা পড়েছেন কিনা? তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার মানুষের জন্য পড়ার ব্যাপারে দশটি বইয়ের নাম চাওয়া হলে, কোন কোন বইয়ের কথা উল্লেখ করবেন? এদের প্রত্যেকে গতবছর কতগুলো বই কিনেছেন? এরকম প্রশ্ন নিয়ে একটি সমীক্ষা করা গেলে একটা চিত্র আমরা পেতে পারি। তাতে ধারণা পাওয়া যেতে পারে, জাতি হিসেবে বই পড়ার অভ্যাসে আমাদের দৌড় কতদূর এবং আমরা স্মার্ট হবার কোন পর্যায়ে আছি।
সরকারের বিগত মেয়াদের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা ক্ষেত্রবিশেষে প্রায়ই পদধারী এবং পদবিধারী লোকজনের জন্মতিথি উদযাপন বা তাদের পুস্তক -অপুস্তকে’র মোড়ক উন্মোচনসহ অনেক তাৎপর্যহীন আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত থেকে মন্ত্রীত্বের পার করে গেছেন। এর বিপরীতে মন্ত্রণালয় অনেকাংশে পরিচালিত হয়েছে আমলাদের খবরদারিতে। বই, গ্রন্থাগার, অনুবাদ, ভাষা সাহিত্য বিষয়ে উল্লেখ করার মতো লাগসই কোনো উদ্যোগ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘ডিজিটাল চৌর্যবৃত্তি’র উত্থানে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের দেশগুলো মেধাস্বত্বকে রক্ষাকবচ দিতে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। অন্য অনেক দেশে এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা বিতর্ক ও পর্যালোচনা চলছে নানা তরফ থেকে। এটি কেবল তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, এটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরও বিবেচ্য প্রসঙ্গ। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের কী হাল?
গুগোলসহ বিদেশী নানা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমাদের সাহিত্যের নানা সৃষ্টি তাদের প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসায় রাজস্ব অর্জনে ব্যবহার করছে। এসব ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে? এ বিষয়ে এ ধরনের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বোঝাপড়া কী? বাইরের অনেক দেশের সঙ্গে গুগলের চুক্তি রয়েছে। আমাদের দেশের সঙ্গে এরকম কোনো চুক্তি আছে কি? থাকলে তা অবিলম্বে জনস্বার্থে প্রকাশ করা দরকার। আর চুক্তি না থাকলে, এখনই এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে নীতিমালার আওতায় এনে চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়া দরকার। বই দিবসে মেধাস্বত্ব রক্ষায় এটিও একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন।
আমাদের দেশে কম ওজনের মানসম্পন্ন কাগজের অভাবে, আমাদের বই কম ডাকমাশুলে বিপণন সম্ভব হয় না। এর সঙ্গে রয়েছে করের ঝামেলা। বই আমদানি-রপ্তানিতে বিদ্যমান কর প্রত্যাহার করা দরকার। এখানে অতীব দুঃখের এবং বিব্রতকর একটি খবর দিতে চাই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও তালিন থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে একটি বইয়ের বেশকিছু সংখ্যা ফরমায়েশ দেয়া হয়েছিল ঢাকায়। ওই বইয়ের প্যাকেট ‘কর সংক্রান্ত’ জটিলতায় বিমানবন্দরে আটকে ছিল। শেষতক বড় অংকের করও পরিশোধ করতে হয়েছে, সেই সঙ্গে দেশের বহুল চর্চিত ‘উপরিও’ খরচ করতে হয়েছে। তারপরই বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের ওই প্যাকেট ছাড় করানো সম্ভব হয়েছে।
বই দিবসের তাৎপর্যের মধ্যে প্রকাশনাও একটি বিবেচ্য বিষয়। আমাদের প্রকাশনা জগৎ এখনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দাঁড়িয়ে কার্যক্রম চালানোর মতো পর্যায়ে যেতে পারেনি। এর পেছনে রয়েছে নানাবিধ গলদ। এসব গলদের লম্বা তালিকা হতে পারে। তবে এখানে মোটাদাগে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। সরকারের বই ক্রয়ের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং স্বাধীন কমিশন কি আছে? বই ব্যবসা এবং প্রকাশনার আড়ালে এক শ্রেণির আমলা এবং প্রকাশক অর্থপাচার এবং কালো টাকা সাদা করার সঙ্গে জড়িত কিনা? একজন লেখক এবং বইয়ের সঙ্গে জড়িত অন্যবিধ কর্মীরা বিশেষ করে বাঁধাইশিল্পী, বানান সংশোধনকারী, সম্পাদক, বিপণনকর্মীদের ‘ভাতেমরা’ অবস্থা, সেখানে কতিপয় প্রকাশক কোন চেরাগের আশীর্বাদে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা ক্লাবসহ দেশের অভিজাত ক্লাবগুলোর সদস্য হতে পারে? এসব বিষয় খতিয়ে দেখে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে এই মন্ত্রণালয়ের অন্যতম অকার্যকর প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আদতে এই প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করার মতো কী করেছে? এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে বিশেষ করে কোরিয়া, জাপান, জর্জিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতে কী ভূমিকা পালন করে তা তুলনা করে দেখা যেতে পারে। দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের কোনো বই অনলাইনে ফরমায়েশ দেবার প্রক্রিয়া এখনো চালু হয়নি। অথচ এই সুযোগ আছে আমাদের তিন পাশে ঘিরে থাকা প্রতিবেশী দেশটির বেলায়। তাহলে আমরা কী এমন ডিজিটাল করলাম বা হলাম? বইয়ের জগৎটাকে নিদারুণ উপেক্ষাই করে গেলাম নাকি?
বই অনুবাদের জন্যে আমাদের কার্যকর কোনো স্বাধীন-স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নেই। অনুবাদের জন্যে প্রয়োজনীয় তহবিল, বৃত্তি এবং প্রণোদনার জন্যে স্বচ্ছ কোনো বন্দোবস্তও নেই। অথচ নানা ভাষায় বিশেষ করে আরবি, ফারসি, চীনা, জাপানি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান, ফরাসি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজিসহ বেশকিছু ভাষায় শিক্ষিত অনেক তরুণ রয়েছে আমাদের দেশে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বই দিবসে এসব বিষয়ে ভাবতে পারে, করণীয় ঠিক করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে।
বই দিবসে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, যাকে এরই মধ্যে দায়িত্বসূত্রে ‘বইমন্ত্রী’ বলেছি, তার উদ্দেশে বহুল ব্যবহৃত কথাটি উল্লেখ করে লেখাটির সমাপ্তি টানতে চাই। ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ তেমনই দেশব্যাপী গ্রন্থাগার এবং পাঠাভ্যাসের বিপ্লব ঘটিয়ে সরকারও ফতুর হবে না।