জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত ৮৫ বার তাদের ভেটো শক্তি প্রয়োগ করেছে, যার অর্ধেকের বেশি ৪৫ বারই করেছে ইসরায়েলের জন্য। কিন্তু অল্প জনসংখ্যার এই দেশটিকে তাদের এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?
Published : 21 Apr 2024, 06:49 PM
ইসরায়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির তৈরি একটি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তারা ভেবেছিল এই দানব তাদের অনুগত থাকবে কিন্তু তা থাকেনি, থাকছে না। অথবা বলতে হয় তারা ফিলিস্তিন নিয়ে এমন এক দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে, যাকে বলা চলে গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতো। এ কথার প্রমাণ ইতিহাসের নানা অধ্যায়ে স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনই বিভিন্ন সময় বলেছেন, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনের প্রধান উপায় দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। গতবছর নভেম্বরে এক এক্স বার্তায় তিনি স্পষ্ট করে এ কথা বলেছিলেন। এমনকি এ বছর জানুয়ারিতেও এমন মন্তব্য করেছেন। দ্য গার্ডিয়ান এ বিষয়ে এক সংবাদও প্রকাশ করেছিল। তারচেয়ে বড় বিষয় ইসরায়েল বাদে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই এই বিষয় ও বাস্তবতার বিরোধিতা করেনি, করছে না। এমনকি দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সংবাদে বাইডেন এমনও মন্তব্য করেছেন যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই মতের বিরোধিতা করেন না। তাই যদি হয় তাহলে জাতিসংঘে সর্বশেষ বৈঠকে কেন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেল না ফিলিস্তিন? বিশ্ব সংবাদ বলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণেই ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বিষয়টি আটকে গেল।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে ভেটো দেয়ার মাধ্যমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ১৯৩টি দেশ ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্ত করতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি সুপারিশ করেছিল কিন্তু তা হতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের কারণে।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের ১২টি দেশই এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও ভেটো প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র। ভোট দানে বিরত থাকে ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ড। এই প্রস্তাব পাশ হতে ৯টি ভোটের প্রয়োজন ছিল কিন্তু কোনো ভেটো প্রদানকারী দেশ (আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স) এর বিরোধিতা করলে তা পাশ হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভেটোধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তা আটকে দেয়।
ফিলিস্তিন এখন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা নিয়ে অবস্থান করছে। পূর্ণ সদস্যপদ পেতে নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন। সেটা তাদের আছেও। সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য দেশ ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নিজেরা সরাসরি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটা করতে পারে। সেখানে জাতিসংঘের নাক গলানোর দরকার নেই। তাহলে জাতিসংঘের কাজ কী? যুক্তরাষ্ট্র কেন এমন প্রস্তাব দিয়েছে বা এমনটা ভাবছে? বাস্তবতা কি আসলে তাই? বাস্তবে কি সেটা সম্ভব? এরকম হলে কয়েক যুগে কেন তা হতে পারল না? কারণ ইসরায়েলে সেটা চায়নি। আর তাদের সেই চাওয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি মদদ জুগিয়েছে। জাতিসংঘে সর্বশেষ ভেটো প্রদানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ইসরায়েল যুগযুগ ধরে বিশ্ব মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিন নামক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলীন ও ধ্বংস করতে কাজ করছে। তাকেই কিনা ফিলিস্তিনের সঙ্গে আলোচনা করে স্বাধীন রাষ্ট্র বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে!
তারা যদি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাজ করবে তাহলে আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব করবে কে? ফিলিস্তিন যখন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে তখন ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে দখলকৃত পশ্চিম তীরে তাদের বসতি বিস্তৃত করছে। ইতিহাসর পাতায় এখন জ্বলজ্বল করছে ফিলিস্তিনের মানচিত্র, কাঠামো ও আকৃতি। সেই সত্যকে তারা কীভাবে অস্বীকার করে? এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কারণেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজও তার স্বীকৃতি পায়নি।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত ৮৫ বার তাদের ভেটো শক্তি প্রয়োগ করেছে, যার অর্ধেকের বেশি ৪৫ বারই করেছে ইসরায়েলের জন্য। কিন্তু অল্প জনসংখ্যার এই দেশটিকে তাদের এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল সম্পর্কের পেছনে আমেরিকান, ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (AIPAC) এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কংগ্রেশনাল ক্লাব নামেও আইপ্যাকের একটি বিশেষ দল আছে যারা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোতে প্রভাব বিস্তারে কাজ করে। এই সংগঠনের সদস্যদের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে তৃণমূলে বসবাসরত ইহুদিদের মধ্যে রয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদিদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকে, তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। শুধু ইহুদি নয়, কট্টরপন্থী খ্রিস্টান ইভানজেলিক গির্জা থেকেও তারা তহবিল সংগ্রহ করে।
ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। সর্বশেষ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ইসরায়েলপন্থী গ্রুপগুলো ৩ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার ডলার তহবিলের যোগান দিয়েছে, যার ৬৩ ভাগ পেয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা, ৩৬ ভাগ পেয়েছেন রিপাবলিকানরা। ওপেন সিক্রেট ডট ওআরজি-এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালের তুলনায় এই নির্বাচনি তহবিলের পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
তারমানে একটা হিসেবে পরিষ্কার এই বছর নভেম্বরের নির্বাচনেও বাইডেন ও ট্রাম্পের নির্বাচনি তহবিলের একটি বড় অংশ আসবে ইহুদি লবি থেকে। ইসরায়েল প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের এই পক্ষপাত এই অর্থের প্রভাবেই পরিলক্ষিত হয়।
১৯৮৫ সাল থেকে উভয় দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। তারপর থেকে তাদের বাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। উভয় দেশ প্রায় ৬০-৭০ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে থাকে যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে। ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। এমনকি কৃত্রিম এই রাষ্ট্র তৈরি হবার পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাদের প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ককে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কূটনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসরায়েল যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে।
এর সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যে সম্পদের প্রাচুর্য আছে তার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। সামরিক দিক থেকে দুর্বল মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর ওপর প্রভাব বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই কৃত্রিম রাষ্ট্রের অবস্থান ও প্রভাবকে অক্ষুণ্ণ রাখতে-বাড়াতে সদা তৎপর। এই হিসেবের সমীকরণেও পরিবর্তন এসেছে। গত দুই দশকে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামরিক অবস্থানের পরিবর্তন ও মেরুকরণ ঘটেছে। চীন-রাশিয়া এই অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন আগের তুলনায় অনেকটা আলগা হয়ে গিয়েছে। আগের সেই একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এখন কাজ করছে না। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থেকেও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। এই অবস্থা যেমন ইসরায়েলের জন্য হুমকি তেমনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্যও প্রবল উদ্বেগের। ওই কারণে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নটাকে ঝুলিয়ে রেখে মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে রাখাটাই তাদের কৌশল। ওই কাজই তারা করছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে জড়িয়ে ফেলছে। এই সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয় মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা বিশ্বকেও নানাভাবে প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্থ করবে। তার একটি নমুনা এখানে শেয়ার করা যথেষ্ট হবে। ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদন বলছে, ইরান ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধ নেবে এই সংবাদের পরই অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯২ ডলারে পৌঁছেছে। যদিও জ্বালানির বাজার স্থিতিশীল রাখতে ওপেক ২২ লাখ ব্যারেল তেল কম উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বাড়লে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তেলের সঙ্গে আছে উন্নয়ন, উৎপাদন, দ্রব্যমূল্য ও জনজীবনের সম্পর্ক।
নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনা ইসরায়েল এবং একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, কার্যকর ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে স্থায়ী শান্তি খোঁজার সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, দুই রাষ্ট্র সমাধানে অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থতা এই অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়াবে এবং কোটি কোটি মানুষকে সহিংসতার মধ্যে বসবাস করতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই বার্তা বিশ্ব জনমতেরই প্রতিধ্বনি।
তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা থাকা অবস্থায় কি ফিলিস্তিনিরা তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখবে না? আপাত ঐতিহাসিক বাস্তবতা সেটাই। যে ক্ষমতার অন্যায় প্রয়োগ একটি সর্বজন স্বীকৃত দেশের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল রাখিবন্ধই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রধান বাধা।
ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন বাস্তবায়নের স্বপ্ন অনেকটাই শেয়ালের কাছে মুরগির নিরাপত্তা চাওয়ার মতো। এমনই এক শর্ত জুড়ে দিয়ে আসলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে কৌশলে অস্বীকার করছে যুক্তরাষ্ট্র।