আমাদের প্রত্যেককে তখন কাজের জন্যই হোক বা কাজ খোঁজার জন্যই হোক, বাবা জায়গায় যেতে হতো। আর আমার ৯ জানুয়ারি থেকে তো ভাষা শেখার স্কুলের জন্যই ফ্রাঙ্কফুর্টে যেতে হবে। তাই আমরা ব্যক্তিগতভাবে মাসিক টিকিট কিনলাম।
সবাই যার যার কাজে বের হয়ে যেতাম, আর সন্ধ্যার পর সবাই বসে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতাম। সেই সাদাকালো টেলিভিশনের তিনটি চ্যানেলে অনুষ্ঠান দেখার চেষ্টা করি ।
একদিন সন্ধ্যায় দেখি, টেলিভিশন আর কাজ করছে না। মানে ছবি দেখা যাচ্ছে না। আমরা আমাদের জানা সুইচ নাড়াচাড়া আর ধাক্কার বিদ্যা সেটটির উপর প্রয়োগ করলাম। কিন্তু কাজ হলো না। কী আর করা, আমাদের সবার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল।
ওই টেলিভিশন সেটটি ছিল অনেক পুরনো। তাই এরকম মাঝে মাঝে না কাজ করাও ছিল খুব স্বাভাবিক। এটাকে তো আমাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয়। তাই একমাত্র ভরসা বাড়িওয়ালা। সুতরাং তার অপেক্ষা করা ছাড়া আর আমাদের কোনো উপায় রইলো না।
বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি অবশ্যা। দুই দিন পরই বাড়িওয়ালা এলেন। আমরা যারা তখন বাসায় ছিলাম, সবাই খুশি। তবে তাকে দেখে নয়, আমরা খুশি যে এবার আমাদের টিভি সেটের একটা বিহিত হবে।
আমাদের মধ্যে কাজল মনে হয় সবার থেকে টিভি দেখার জন্য বেশি উদগ্রীব ছিলো। তাই বাড়িওয়ালা ঢোকার সাথে সাথেই ও বলে উঠলো, সেফ সেফ (আমরা বাড়িওয়ালাকে সবাই ‘সেফ’ বলতাম), আওয়ার টিভি ইজ ক্রাঙ্ক।’
এই বাক্যের মাঝে রয়েছে ইংরেজি আর জার্মান শব্দের মিশ্রণ। আর যার জন্য আমার কথাটি মনে পড়লে হাসি পায়। কারণ, জার্মান ‘ক্রাঙ্ক (Krank)’ শব্দের অর্থ হলো অসুস্থ। আর টিভি কখনও অসুস্থ হয় না, খারাপ হয় বা সমস্যা করে।
আসলে, আমাদের সেই সময় কোনো জার্মান বা বিদেশির সাথে কথা বলতে গেলে কমবেশি সবার বাংলা, ইংরেজি ও জার্মান ভাষার মিশ্রণে একটা হাসির বাক্য তৈরি হতো। আমরা এ নিয়ে তখন অনেক মজা করেছি। বাড়িওয়ালা সেটটি দেখে কিছু একটা করার পর টিভি আবার চালু হলো। আমরা সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
জার্মানিতে এসে প্রথমে যে শব্দগুলো জানা খুব প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, তার মধ্যে ‘ক্রাঙ্ক’ একটি। কারণ, কেউ যদি চাকরি পায় এবং কাজ করতে শুরু করে, আর আচমকা একদিন সে কাজে যেতে পারলো না, তাহলে তার কাজের জায়গায় জানাতে হতো যে সে অসুস্থ। তাই সে কাজে আসতে পারবে না। এই কথাটি দুটি জার্মান শব্দ দিয়ে যেমন ‘ইস ক্রাঙ্ক (Ich Krank)’ বললেই চলতো। এর অর্থ ‘আমি অসুস্থ’।
আসলে শুদ্ধ জার্মান বাক্য হবে ‘ইস বিন ক্রাঙ্ক (Ich bin Krank)। প্রথম প্রথম প্রায় সবাই ‘আমি হই’, ‘তুমি হও’ বা ‘সে হয়’- এসব ছাড়াই নতুন ভাষা চালিয়ে যায়। আমরাও তাই করেছি।
এর মধ্যে একদিন আমার ভবিষ্যতের অর্থ উপার্জনের জায়গা, মানে ফ্রাঙ্কফুর্টের দৈনিক পত্রিকা বিক্রির জন্য যেখান থেকে বিতরণ করা হতো, সেখানে গেলাম। সেখানে আগেরবার এসে যাদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, তাদের সাথে আবার দেখা হলো। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন যে আজ থেকে আপনি পত্রিকা বিক্রির জন্য না চাইলেও ‘ইয়ান’ (মানে, যে পত্রিকা বিক্রির জন্য বিতরণ করেন তার নাম), ওর সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করেন।
সেদিন যারা বিক্রির জন্য পত্রিকা পেল, তারা পত্রিকাগুলো ট্রলির মধ্যে নিয়ে তাদের নির্দিষ্ট স্থানের দিকে যাত্রা করলেন। যখন দেখলাম, ইয়ানের কাউন্টার ফাঁকা, তখন আমি সেখানে ইয়ানকে বললাম যে আমি পত্রিকা বিক্রি করতে চাই। শুনে ইয়ান বললেন, আপনার কি ভিসা আছে?
আমি আমার পাসপোর্ট বের করে দেখালাম। দেখে বললেন, এখন তো বেশ লোকজন। তাই যখন কোনো জায়গা খালি হবে, তখন দেখা যাবে। কি আর করা! আবার আমার এই একমাত্র সম্ভাব্য উপার্জনের জায়গায়ও অনিশ্চিত মনে হচ্ছিলো।
চলবে ...
লেখক:
প্রবাসী বাংলাদেশি
এই লেখকের আরও পড়ুন-
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |