জার্মানিতে ৪০ বছর: বাতিল খাট পাওয়ার আনন্দ

সেলিম আর আমি তখন একই সিঙ্গেল খাটে ডাবলিং করে চলছি। দীর্ঘ সময় ডাবলিং করা নিশ্চয়ই সুখের নয়?

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2017, 04:12 AM
Updated : 30 August 2017, 04:18 AM

প্রায়ই মনে হতো, যদি সিঙ্গেল খাটে একা শুতে পারতাম, তাহলে কতই না আরাম হতো! কিন্তু কোথায় পাব সেই কাঙ্ক্ষিত খাট, কতোই বা তার দাম- সেসব তো কিছুই জানি না।

ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা, বাইরে যাওয়ার দরকার হলে দুপুরের আগেই চেষ্টা করতাম প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতে। আর তাই বিকেলটা ছিল ফাঁকা। সে সময় মাঝে মাঝে আমরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতাম, কেমন পরিবেশ বা পথচারীদের যাতায়াত।

এমনি এক বিকেলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, পাশের কয়েকটি বাড়ি থেকে লোকজন কী সব বের করে যেন বাসার সামনে ফুটপাতে রাখছেন। কৌতুহলী হয়ে আমি জানলা খুলে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখি, আশেপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকে কেউ কেউ তাদের পুরনো আসবাবপত্র, অকেজো ফ্রিজ, টেলিভিশন ও মোটামুটি ভাল সোফা, বিছানা- এরকম জিনসপত্র রাখছেন। তার মানে, এসব জিনিসের যাদের আর প্রয়োজন নেই, তারাই রাখছেন।

পরে শুনেছি, তখন শহরে শহরে এরকম ব্যবস্থা ছিল। সিটি কর্পোরেশন থেকে এলাকায় এলাকায় জানিয়ে দেওয়া হতো যে কোন দিন কোন জায়গায় পরিত্যক্ত জিনিসপত্র ফেলা যাবে। সেই তারিখ অনুযায়ী এলাকাবাসী তাদের মালগুলো আগের দিন সন্ধ্যায় ফুটপাথের উপর রেখে দিতেন। পরদিন সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে সেগুলো নিয়ে যেত।

সেদিনই জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, পাশের একটা বাড়ির পরেরটা থেকে একটি সিঙ্গেল খাট রেখে দিয়ে চলে গেলেন একজন। দেখেই আমি খুশি হয়ে গেলাম। সেলিমকে বললাম, খাটটা নিয়ে আসি চল। যতো দ্রুত সম্ভব কাপড় পরে আমরা দু’জন ছুটলাম ওই মালপত্রের দিকে। ভাবলাম, এবার মনে হয় আমাদের কষ্টের শেষ হলো। আবার আমরা যার যার খাটে আবার ঘুমুতে পারবো। কিন্তু গিয়ে হতাশ হলাম। কারণ দেখলাম, অন্য কোনো মালপত্রের পাশে নয়, সেই খাটটির সামনে একজন ইউরোপের কোনো এক দেশের মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন । তার মানে তিনি ওই খাটটি নিতে চাচ্ছেন।

কি আর করা, এই দৃশ্য দেখে আমাদের দু’জনের চেহারাই মনে হয় করুণ দেখাচ্ছিলো। সেটা সেই ভদ্রলোক হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন। তাই মনে হলো তিনি এক-দুই মিনিট ভেবে আমাদেরকে বললেন, তোমরা যদি নিতে চাও, তাহলে খাটটি নিতে পারো। এবার মনে হয় আমাদের দু’জনের মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো।

ভাল কথা, ওই খাটের সাথে প্রায় নতুন জাজিমও ছিলো। আমরা সেই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই খাট আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলাম। ঘরে খাট-জাজিম বিছানোর পর সেদিন থেকে আমাদের আর ডাবলিং করতে হয় নাই।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে তার বেশ অনেক বছর পরের ঘটনা। তখন ঢাকার নিউ মার্কেট লাইব্রেরির মালিক কাইয়ুম ভাই প্রায় আসতেন জার্মানিতে। সেবার তিনি এসেছিলেন তার মেজো ছেলে জুম্মাকে নিয়ে। এক সন্ধ্যায় আমরা তিনজন একজন বাঙালির বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে দেখি ওই এলাকায় জিনিসপত্র ফেলার তারিখ ছিল। তাই মানুষ মালপত্র রাস্তায় রেখে দিয়েছেন।

সেই পরিত্যক্ত মালপত্রের মধ্যে কাইয়ুম ভাইয়ের চোখে পড়লো ভালো অবস্থার একটি রিভলভিং চেয়ার। সাথে সাথে তিনি বলে উঠলেন, এই চেয়ারের দাম দেশে পাঁচ হাজার টাকা। আর ছেলে জুম্মাকে বললেন, “নে, এই চেয়ারটা আঙ্কেলের ঘরে নিয়ে যা।”

আমি হেসে উঠলাম আর কাইয়ুম ভাইকে বললাম, “আমি এই চেয়ার দিয়ে কী করবো?” তবে সেদিন তার কথা শুনে খুব মজা পেয়েছিলাম। আগে যে আসবাবপত্র ফেলা হতো, সেগুলোর অবস্থা বেশ ভালোই থাকতো। পড়েও থাকতো অনেক সময়। আর এখন যে মালপত্র ফেলা হয়, সেগুলো ফেলার সাথে সাথে পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা লোকজন উঠিয়ে নিয়ে যায়। কারণ এখন তাদের এই মালপত্রেরও চাহিদা অনেক।

এই জার্মানি বা ইউরোপের অর্থনৈতিক ভিত্তি হচ্ছে ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার দর্শন। মানুষ পণ্য কেনে, কিন্তু তার টেকার আয়ু শেষ হওয়ার অনেক আগেই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আবার কেনে নতুন পণ্য। এভাবেই চলছে এই সমাজ।

চলবে...

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!