জার্মানিতে ৪০ বছর: ইংরেজি মাসের জার্মান নাম

নতুন বছর ১৯৭৮ সালকে বরণ করে নিলাম। এবার এই বছরটির উপর নির্ভর করবে, আমি এই নতুন দেশ, আবহাওয়া, ভাষা ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকতে পারবো কিনা?

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2017, 06:35 AM
Updated : 2 Nov 2017, 06:35 AM

আমার ভাষা কোর্স শুরু হওয়ার কথা ছিল ৯ জানুয়ারি। তখন প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা থেকে ইংরেজি-জার্মান ভাষা শেখার বই থেকে কিছু কিছু জার্মান শব্দ ও বাক্য জানার চেষ্টা করতাম। ইতোমধ্যে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুণতে শিখে গেছি।

জার্মান ভাষায় এককে বলা হয় ‘আইনস’, দুইকে ‘ছোআই’, তিনকে ‘দ্রাই’, চারকে ‘ফিয়ার’, পাঁচকে ‘ফুনফ’, ছয়কে ‘জেকস’, সাতকে ‘জিবেন’, আটকে ‘আকট’, নয়কে ‘নয়েন’ আর  দশকে ‘ছেহন’ বলা হয়।

মাসের জার্মান নামগুলোর মধ্যে অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরকে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেছিলাম। কারণ, এই তিনটি মাসের নামের উচ্চারণ ইংরেজি মাসগুলোর সাথে প্রায় মিলে যায়। শুধু বানানের হেরফের আছে একটু।

যেমন ইংরেজি October-কে জার্মানরা Oktober লেখে। শুধু ‘C’-এর জায়গায় জার্মান ভাষায় ‘K’ থাকে। ইংরেজি নভেম্বর মাসকে জার্মানি ভাষায় নভেম্বরই বলে এখানে, বানান ও উচ্চারণে কোনো পার্থক্য নেই। আর ডিসেম্বরের উচ্চারণ প্রায় একই, শুধু বানানটা Dezember।

জানুয়ারির জার্মান উচ্চারণ শিখতে হলে প্রথমে জানার দরকার, জার্মান ভাষায় ‘J’-কে কী বলা হয়। এখানে ‘J’ কে ‘ইয়ট’ বলা হয়। তাই জানুয়ারিকে এরা ‘ইয়ানুয়ার’ বলে। একইভাবে জুনকে ‘ইউনি’, আর জুলাইকে ‘ইউলি’ বলা হয়।

বাকি থাকলো ফেব্রুয়ারি। এই মাসকে জার্মান ভাষায় বলা হয় ‘ফেব্রুয়ার’, মার্চকে ‘মেরজ’। এপ্রিলের তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। এপ্রিলের ‘A’কে ‘আ’ উচ্চারণ করে ‘আপ্রিল’ বলা হয়। মে মাসকে ‘মাই’ বলা হয়। অগাস্টকে অগাস্ট আর সেপ্টেম্বরকে সেপ্টেম্বরই বলা হয়। আমি এভাবে মিল আর অমিলের জায়গাগুলো লক্ষ করে এসব দ্রুতই শিখে ফেলেছিলাম।

আমাদের বাড়িওয়ালা আমদের ফ্লাটে তখন প্রায়ই আসতেন। আসার কারণ অবশ্য ছিলো, তখন তিনি আমাদের রান্নাঘর ও বাথরুমের কিছু প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কাজ করাচ্ছিলেন। আর এই কাজের জন্য ক্লজ নামে একজন জার্মানকে নিয়োগ করেছিলেন। সুঠাম দেহ ও দীর্ঘাকার ক্লজ প্রতিদিন সকালে আমদের ফ্লাটে আসতেন এবং কাজ শুরু করে দিতেন। আমাদের দেশে এই কাজকে বলা হয় ওস্তাগরের কাজ। মানে তিনি ছিলেন ওস্তাগার ও মিস্ত্রী।

প্রথম কয়েকদিন আমদের সাথে সে ‘হাই-হ্যালো’ ও ‘গুটেন মরগেন’ বিনিময় করতেন। তারপর আমরা তাকে চা পান করার প্রস্তাব দিলে সে খুশিমনে পান করতো। দুপুরে যখন আমরা রান্না করতাম, তখন মাঝে মাঝে খেতে বললে তিনি খেতেনও। আমাদের সাথে ওর আলাপ বাড়তে থাকে।

একদিন সে আমাদের জিজ্ঞাসা করলো, “আচ্ছা, তোমরা তো বেশ কিছুদিন যাবত জার্মানিতে আছো। তোমরা কি কখনো ডিসকোতে গিয়েছ?” আমারা যাইনি, তা জানালাম। কারণ, তখন আমাদের ডিসকো যাওয়ার কথা মাথায়ই আসেনি। আমাদের মাথায় তখন নতুন দেশে, নতুন ভাষা আর আবহাওয়ার সাথে লড়াই করে টিকে থাকার চিন্তাটাই প্রধান। ক্লজ বলল, “ঠিক আছে। তোমরা যদি চাও, তাহলে আমি তোমাদেরকে এক সন্ধ্যায় ডিসকোতে নিয়ে যাব।” আমরা রাজি হয়ে গেলাম।

একদিন আমাদের ফ্লাটে কাজ সেরে সে বাসায় গিয়ে সন্ধ্যায় আবার আমাদের ওখানে চলে আসলো। এবার ক্লজকে দেখে একটু অন্যরকম লাগলো। কারণ, এতদিন তো তাকে শুধু কাজের  পোশাকে কাজ করতে দেখেছি। কিন্তু আজ দেখলাম, ক্লিন শেভে, সুন্দর পোশাক পরে, কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট বেঁধে এসেছে সে।

সন্ধ্যার কিছু পর পরই আমাদের তিনজনকে নিয়ে ওর গাড়ি কাছে দাঁড়ালো। আজই প্রথম দেখলাম, ক্লজের মার্সিডিজ গাড়িটা। আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। সে আমাদের জানালো যে এই ওফেনবাখ শহরের কিছু দূরে একটি ভালো ডিসকো আছে। সে আমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।

রাত ৮টার সময় আমরা ডিসকোর সামনে পৌঁছালাম। ক্লজ আমাদেরকে নিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে চাইলো। কিন্তু আমাদের সবাইকে হতাশ করে গেটকিপার জানালো, শুধু এখানকার সদস্যদের জন্য এই ডিসকো। তাই আমরা ঢুকতে পারবো না। ক্লজ কিছু সময় গেটকিপারের সাথে বাক-বিতণ্ডা করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আমাদের ফিরতে হলো।

পথে একটি বারে ঢুকে এক গ্লাস করে বিয়ার পান করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর পর ক্লজ আবার আমদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল। সেদিন শুধু আমরাই হতাশ হয়নি, তার থেকে বেশি মনে হয় ক্লজের মন খারাপ হয়েছিলো। পরে বিষয়টি নিয়ে আমি ভেবেছি। আমার মনে হয়েছে, ওই সময় শহরের বাইরে যারা থাকতেন, তারা বেশ রক্ষণশীল ছিলেন। তারা চাইতেন না, কেউ শুধু দেখার জন্য এই ডিসকোতে প্রবেশ করুক।

আসলেও তো তাই, আমরা তো নাচার জন্য সেখানে যাইনি। ক্লজ আমাদের নিয়ে গিয়েছিল দেখানোর জন্য। সেটা আমাদের দেখে গেটকিপার ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। ইউরোপিয়ান সমাজ এ ধরনের পরিবেশে চায় না যে তাদের ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে নাচ-গান, আনন্দ-ফূর্তি কেউ পর্যবেক্ষণ করুক। এতে তারা বিরক্তি বোধ করে। এখন খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি এই বিরক্তবোধের কারণ।

এর কয়েকদিন পর ক্লজ একদিন আমাদেরকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করলো। আমরা গেলাম। গিয়ে দেখি সুন্দর পরিপাটি তার একটি ফ্ল্যাট আছে। তখন তিনি একাই থাকতেন, আমাদের সে জার্মান খাবার রান্না করে খাওয়ালো।

ক্লজের কথা যখন মনে হয়, তখন ভাবি- কী প্রয়োজন ছিলো ক্লজের আমাদেরকে ডিসকোতে নিয়ে যাওয়ার বা নিজের বাসায় নিমন্ত্রণ করার? ক্লজ কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলো না। সে যেটুকু আমাদের জন্য করার চেষ্টা করেছে, তা হচ্ছে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে।

আমি আজ ৪০ বছর পর এখনও মনে করি যে জার্মানিতে এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ (যদিও উগ্র দক্ষিণপন্থী নব্য নাৎসিদের কর্মকাণ্ড কিছুটা বেড়েছে )। তাই এখনও শরণার্থী বা বিদেশিরা এখানে এসে ভালোভাবে বসবাসের সুযোগ পাচ্ছেন।


চলবে ...

লেখক: 

প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!